সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (ইতিহাস কথা পর্ব – ১৭)

শ্রীরামপুরের কথা

১৮১৮ সালে যখন কলেজে শুরু হল ক্লাস, তখন তৈরি হয় নি কোনো সুরম্য ভবন। অগত্যা গঙ্গার তীরে অল্ডিন হাউসের ছোট্ট বাড়িতেই শুরু হল ক্লাস। ভরেও গেল ক্লাসরুম। কলেজের প্রথম প্রিন্সিপাল হিসাবে দায়িত্ব নিলেন কর্মযোগী স্বয়ং কেরীসাহেব। এরপর প্রচুর ঝড়ঝাপটার সামলে ১৮২২ সালে তৈরি হল বিশাল কলেজ বাড়িটি। যা আজও গঙ্গার তীরে সকলের চোখ টানে। কলেজ ভবনের জন্য জমি দিয়ে এবং মেনগেট ও লোহার সিঁড়ি কোপেনহেগেন থেকে উপহার হিসাবে পাঠিয়ে দিয়ে ডেনমার্ক রাজ ষষ্ঠ ফ্রেডরিকের প্রত্যক্ষ ভাবে মিশনারীদের সহায়তার কথা আগেই বলেছি। ১৮২৭ সালে রাজকীয় সনদের বলে কলেজ পরিণত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেরী ও মার্শম্যানের মৃত্যুর পরে যে দুজন অগ্রগণ্য মানুষ কলেজের দায়িত্ব সামলেছিলেন তাঁরা হলেন অধ্যাপক জন ম্যাক ও মার্শম্যান পুত্র জন ক্লার্ক মার্শম্যান। প্রথম বাংলা সাপ্তাহিকী সমাচার দর্পণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর জন ক্লার্ক মার্শম্যানই আবার হাতে ধরে তা প্রকাশ করেন। যদিও পরে আবার সমাচার দর্পণের প্রকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। জন ম্যাক ছিলেন রসায়নের শিক্ষক। তাঁর লেখা ‘Principles of Chemistry’ শ্রীরামপুর প্রেস থেকে বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশিত হয়। বইটির নাম দেয়া হয় ‘কিমিয়া বিদ্যাসার’। এই ১৬৯ পাতার বইটিই বাংলায় লেখা প্রথম রসায়নের বই হিসাবে ধরা হয়। এমনকি অধ্যাপক ম্যাকের হাত ধরেই শ্রীরামপুর প্রেস থেকে প্রথম প্রকাশ হয় ভারতের মানচিত্র। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ১৮৪৫ সালে দেহ রাখেন জন ম্যাক সাহেব। এরপর কলেজের অধ্যক্ষ হন ডেনহাম। একসময় লন্ডনে অবস্থিত ব্যাপটিস্ট মিশনারী সোসাইটির উপর কলেজ পরিচালনার সসম্পূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে শ্রীরামপুর ত্যাগ করে নিজের দেশে ফিরে যান জন ক্লার্ক মার্শম্যান। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। কলেজ পরিচালিত হতে থাকে সোসাইটির হাতে। ডেনহামের পর একে একে ট্র‍্যাফোর্ড, উইলিয়ামস কলেজের অধ্যক্ষ হন। আজও কলেজের ধর্মতত্ত্ব বা থিওলজি বিভাগ এশিয়ার একটি অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়। সমগ্র এশিয়ায় যার অন্তর্ভুক্ত প্রায় পঞ্চাশটিরও বেশি কলেজ ধর্মতত্ত্বের শিক্ষায় ছাত্রদের শিক্ষিত করে চলেছে অনবরত। দেশ বিদেশ থেকে ছাত্ররা ছুটে আসেন কেরী মার্শম্যানের আদর্শে খ্রীষ্টান ধর্মতত্ত্ব ও বাইবেল জানবার তাগিদে। কিন্তু কখনোই সুগম ছিল না মাঝখানের এই পথ। কলেজে ধর্মতত্ত্বের সাথে সাথে সমান্তরালে বিজ্ঞান ও কলা শিক্ষা দেবার জন্য লড়াই করে গেছেন স্বয়ং কেরীসাহেব।
তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতেই আগাগোড়া তৈরি হয়েছে কলেজের মেরুদণ্ড। ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হওয়ার পর যে আটটি কলেজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল, শ্রীরামপুর কলেজ তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু ১৮৮২ সালে রেঃ সামর্স অধ্যক্ষ থাকাকালীন ব্যাপটিস্ট মিশনারী শুধুমাত্র খ্রীষ্টিয় দর্শন শিক্ষা দেবার জন্য থিওলজি বিভাগটি ছাড়া অন্যান্য বিভাগগুলি ছাত্র না থাকার অজুহাতে বন্ধ করে দেয়। এর ফলস্বরূপ সেই বছরেই কলেজের সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। ইতিমধ্যে কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্বভার নেন ডঃ রেঃ জর্জ হাওয়েলস্। শ্রীরামপুর কলেজের ইতিহাসে তিনি এক উল্লেখযোগ্য নাম। ১৯১০ সালে কলেজের বিজ্ঞান ও কলা বিভাগের পড়াশোনা আবার চালু করে তিনি প্রতিষ্ঠানের দরজা আবার সকলের জন্য খুলে দেন। তিনিই কলেজের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে মানুষের মনে জায়গা করে নেন। বিলেত থেকে মিশনারীর কাজে উড়িষ্যায় প্রথমে পা রেখেছিলেন হাওয়েলস্। তারপরই তাঁর শ্রীরামপুর কলেজে আগমন। ১৯০৬ সালে ডঃ সামর্সের অবসরের পর কলেজের দায়িত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নেন তিনি। আগে ডিপ্লোমা প্রদান করা হলেও ১৯১৫ সালে রাজকীর সনদের বলে কলেজের ধর্মতত্ত্ব বিভাগ ছাত্রদের ‘ব্যাচেলর অফ ডিভিনিট’ ডিগ্রী প্রদান করে।
কেরী লাইব্রেরী ও রিসার্চ সেন্টার আজও শ্রীরামপুরের ইতিহাসকে বুকে করে ধরে রেখেছে। আজকের মানুষের ভুলে যাওয়া একটা অধ্যায় যত্ন করে তোলা রয়েছে লাইব্রেরীর ঘরগুলোয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ১৮১৮ সাল থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা সমাচার দর্পণের কপি। এছাড়াও ২০০ বছরের দুর্মূল্য সব বই, কেরীসাহেবের উপহারসামগ্রী, শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত বাইবেল, মহাভারতের পাণ্ডুলিপিও রাখা রয়েছে লাইব্রেরীতে। রয়েছে কেরীর বিখ্যাত উদ্ভিদ বাগানের (যা এখন ইন্ডিয়া জুটমিলের জায়গা) গাছের ছাল। কেরী, মার্শম্যান, ওয়ার্ড ও হানা মার্শম্যানের ব্যবহৃত বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। কেরীসাহেবের সোনার হস্তাক্ষর ও তিল তিল করে সঞ্চয় করা বিভিন্ন দেশবিদেশের মুদ্রা,পাথর ও অন্যান্য জিনিস। বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎ হিন্দু কলেজ আর নেই। নেই ওয়েলেসলীর প্রতিষ্ঠা করা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজও। কিন্তু আজও গঙ্গাতীরে জীবন্ত ইতিহাস বুকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে শ্রীরামপুর কলেজ। ভাগীরথীর প্রতিটা ভাঙা ঢেউ আজও সাক্ষী দিয়ে যায় শুধুমাত্র বাঙালী সমাজে একটু শিক্ষা পৌঁছে দেবার জন্য রেভারেন্ড ডঃ উইলিয়াম কেরীর আমৃত্যু ছুটে চলাটুকু।

ক্রমশ..

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।