• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (ইতিহাস কথা পর্ব – ২০)

শ্রীরামপুরের কথা

শ্রীচৈতন্য পার্ষদ কাশীশ্বর পণ্ডিত তাঁর সেবিত রাধাগোবিন্দ বিগ্রহ অন্য কেউ পুজো করবেন তা একেবারেই পছন্দ করতেন না। বৈষ্ণব চূড়ামণির নিজহাতে প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহ। কিন্তু ঘটনাচক্রে কোনও একদিন ভাগ্নে রুদ্র পণ্ডিত সেবা দিলেন মামার রাধাগোবিন্দ বিগ্রহের। শাক্তধর্মে অনুরাগী রুদ্র পণ্ডিতের এহেন কাজে বেজায় চটলেন কাশীশ্বর। এরপর শ্রীরামপুরের মাটিতে শুরু হল এক নতুন অধ্যায়। স্থানীয়দের সহায়তায় গঙ্গাতীরে মন্দির প্রতিষ্ঠা করে এবং নতুন বিগ্রহ স্থাপন করে নিজে রাধাগোবিন্দের সেবা করবেন বলে মনস্থির করলেন রুদ্ররাম। দৈবক্রমে এসেও গেল উপায়। স্বপ্নাদেশ পেলেন রুদ্ররাম। বিগ্রহ স্থাপনের জন্য গৌড়ের সুলতানের রাজপ্রাসাদ থেকে সংগ্রহ করতে হবে পাথর। ছুটলেন রুদ্ররাম। সুলতানের মন জয় করে তাঁর প্রাসাদের প্রধান ফটক থেকে সংগ্রহ করলেন শিলাখণ্ড। আর তা থেকেই তৈরি হল তিন ঠাকুর। খড়দহের শ্যামসুন্দর, বল্লভপুরের রাধাবল্লভ আর সাঁইবনার নন্দদুলাল। যদিও এই লোককথার অন্যমতও শোনা যায়। যেমন অনেকে বলেন শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর পুত্র বীরচন্দ্রের ইচ্ছায় এই তিন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা। আবার কারো কারো বিশ্বাস এই পাথর ভেসে আসে গঙ্গার উজানে ও তার থেকেই তৈরি হয় দেববিগ্রহ। যাই হোক, সমস্ত লোককাহিনীর মধ্যমণি আমাদের শ্রীরামপুরের রাধাবল্লভ। প্রতিদিন এই কালো কষ্টিপাথরে নির্মিত যুগলমূর্তি দেখতে বিভিন্ন দিক থেকে ছুটে আসেন ভক্তরা। বিশেষ করে মাঘীপূর্ণিমা তিথিতে তিন ঠাকুর দর্শনে ভিড় হয় চোখে পড়বার মতো।
এর আগেই পুরনো রাধাবল্লভ মন্দিরের কথা বলেছি। আজকের হেনরী মার্টিন প্যাগোডা আসলে রাধাবল্লভের পুরনো বাড়ি। গঙ্গার ভাঙনের ভয়ে রাধাবল্লভকে নতুন মন্দিরে নিয়ে আসা হয় ১৭৬৪ সালে। আজকের সুন্দর মন্দিরটি নির্মাণ করে দেন কলকাতার নয়ানচাঁদ মল্লিক। মন্দিরের উচ্চতা ৬০ ফুট। মন্দির নির্মাণে শোভাবাজারের রাজা ও ক্লাইভের মুন্সী নবকৃষ্ণ দেবের ভুমিকাও না বললেই নয়। তিনিও রাধাবল্লভের পরম ভক্ত। মন্দির নির্মাণে তাঁর দানও উল্লেখযোগ্য। শোনা যায় ১৭৭১ সালে মায়ের শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে রাধাবল্লভকে শোভাবাজার নিয়ে যান নবকৃষ্ণ। পরে বিগ্রহ ফেরত দিতে অনিচ্ছুক হলেও সেবায়েতদের প্রবল চাপে তা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন তিনি। কিন্তু সঙ্গে প্রচুর সম্পত্তি ও গয়না দান করেন দেবতার উদ্দেশ্যে।
এরপর আসি রাধাবল্লভের ফেলে যাওয়া পুরনো মন্দিরের কথায়। ১৮০৬ সালের পর থেকে গঙ্গার তীরে এই পরিত্যক্ত মন্দিরটিই মিশনারী হেনরী মার্টিন সাহেবের বাসভবন। এই মন্দিরের কথা আগেও বলেছি। মার্টিন সাহেবের এই মন্দিরই (লোকমুখে প্যাগোডা) কেরী সাহেবের ধর্মমূলক প্রচারসভার প্রধান কেন্দ্রস্থল। হিন্দু মন্দির থেকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই দেবালয় রূপান্তরিত হয় খ্রীষ্টান গীর্জায়। মিশনারীদের ভজনালয় হিসাবে এটি একসময় বিখ্যাত হয়ে ওঠে। কিন্তু ড্যানিশ ঔপনিবেশিক শ্রীরামপুরে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে অনেকগুলি গীর্জা। ১৮০০ সালে ড্যানিশ শাসক কর্নেল ও বাইয়ের সময়ে গড়ে ওঠা সেন্ট ওলাভ গীর্জা তার মধ্যে অন্যতম। প্রোটেস্টান্ট খ্রীষ্টানদের উপাসনালয় হিসাবে মাথা তোলে শ্রীরামপুর শহরের এই অন্যতম গীর্জা ভবন। তৈরি হবার আগেই ও বাই সাহেব ইহলোক ত্যাগ করলেও কিছু বছর পরে নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় এই উপাসনালয়ের। এরপরই পরিত্যক্ত হতে শুরু করে রাধাবল্লভের পুরনো বাসভবন তথা হেনরী মার্টিন প্যাগোডা। পড়ে থাকা প্যাগোডার ঘর শেষমেশ রূপান্তরিত হয় মদ তৈরির কারখানায়। হেরনী মার্টিন প্যাগোডায় বানানো মদ আশেপাশের সমস্ত জায়গায় খ্যাত হয় ‘প্যাগোডা রাম’ নামে। সময়ের সাথে সাথে এভাবেই রাধাবল্লভ মন্দির মার্টিন সাহেবের বাড়ি, খ্রীষ্টান গীর্জা, মিশনারীদের সভাক্ষেত্র থেকে হয়ে যায় মদের ফ্যাকটরি। সময়ের এই অদ্ভুত চক্রাবর্তের সাক্ষী কেবলমাত্র শ্রীরামপুর।
১৮৬৪ সালে কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যায় ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড়। এই ঝড়ে ভেঙে পড়ে প্যাগোডার একটা অংশ। যে ঝড়ে হাওড়ার বিখ্যাত বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রাচীন বটগাছেরও অপূরণীয় ক্ষতি হয় ও মূল কাণ্ডটি ভেঙে পড়ে। প্রসঙ্গত বলি, ইংরেজরা সদ্য কলকাতায় পা দেবার পরপরই ১৭৩৭ সালে মুখোমুখি হয় এক ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়ের। নতুন গড়ে ওঠা কলকাতা শহরটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে একরাতেই। শ্রীরামপুর শহরেও তীব্র ঘুর্ণিঝড়ে কেরীসাহেবের বাগান সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবার কথা আগে বলেছি। সভ্যতার প্রতিটি পদক্ষেপে এভাবেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলা করতে হয়েছে মানুষকে। শ্রীরামপুরও তার ব্যতিক্রম নয়। সৃষ্টি আর ধ্বংসের মধ্যে আজও নতুন রূপে সমস্ত ইতিহাসকে বুকে আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে হেনরী মার্টিন প্যাগোডা তথা এই শহরের সমস্ত ঐতিহাসিক অমূল্য সৌধগুলি। সমস্ত প্রচারের আলো রাজধানী কলকাতার দিকে হলেও ঐতিহাসিক গুরুত্বে এতটুকু ম্লান হয় নয় একসময়ের ইউরোপীয় শহর শ্রীরামপুর। প্রতি শীতে অসংখ্য মানুষের ভিড় নাও হতে পারে, সৌধ রক্ষার্থে নিয়ম করে নাও পড়তে পারে সরকারি সুনজর, কিন্তু শ্রীরামপুর আছে শ্রীরামপুরেই। শহরের ইতিউতি পড়ে থাকা প্রতিটি ইট-কাট-পাথর বলে যাবে সেই দিনগুলোর কথা। আর ইচ্ছুক মানুষ কান পাতলে ঠিকই শুনতে পাবে সেইসব হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর পায়ের শব্দ।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।