সাপ্তাহিক গল্প নেই-তে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় – ২৭

গল্প নেই – ২৭

মাঝে মাঝে নিজের চোখ দুটিকে বিশ্বাস করতে পারি না। চোখের সঙ্গে দুটি কানের কথা না বললে ওরা হয়ত আমার কান ধরে বলবে, ‘আমাদের কথা বললে না যে! কষ্ট তো আমাদেরও হচ্ছে।’
চোখ ও কানের কষ্ট হলে আমিও ভালো থাকি না। ওদের কষ্টে থাকা আমাকে আহত ও বিচলিত করে। বেশ কিছুদিন ধরে এই সমস্যার মধ্যে আছি।
সেই যে রামায়ণে নিকুম্ভিলা যজ্ঞে ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ আর মহাভারতে সুচের ডগায় ওঠা সামান্য মাটিও বিনা যুদ্ধে না দেওয়ার ঘোষণা শুরু হয়েছিল তা আজও বহমান।
গোটা পৃথিবী আধুনিক হয়েছে। দেখে মনে হয় যেন কত সভ্য। আরও উন্নত হওয়ার বাসনায় চলছে নিত্যনতুন আবিষ্কারের ঘটা,তবু যুদ্ধ কিন্তু কমছে না। তা লেগেই আছে। বিশ্বশান্তি বলে একটা কথা শোনা গেলেও যুদ্ধের প্রস্তুতিতে সেই আশা কখোনো ছিল না। এখনও ম্লান।
সম্প্রতি করোনা গোটা বিশ্বকে এক বিপদের সুতোয় বেঁধে ফেলেছে। এটা প্রকৃতিকে নানাভাবে প্রতিনিয়ত আঘাত করার জন্য পেয়েছি, না এই করোনা দিয়ে কেউ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে বিশ্বজয় করতে চাইছে এর সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বোধহয় এখনও আসেনি। তবে এটা বোঝা গেছে অন্যের ক্ষতির জন্য এই করোনা অস্ত্র প্রয়োগ করতে গেলে নিজেরাও রেহাই পাবে না।
একসময় বড়োদের কাছে শুনতাম, অন্য কাউকে বারো হাত জলে ডুবিয়ে মারতে হলে নিজেকেও দশ হাত জলে নামতে হয়।
কথাটা খুব সত্যি। তবে এই খারাপ কাজের ফলটা তৎক্ষণাৎ না পেলেও একসময় পেতেই হয়। প্রকৃতি কোনো পাওনা বাকি রাখে না। গোনা গুনতি করে সব বুঝিয়ে দেয়।
আমরা পাঁচ বছর অন্তর সুযোগটা পাই বলে একেবারে আদেখেলের মতো ভোটের কথা শুনলেই নিজেকে খুব মূল্যবান ভাবতে শুরু করি। ভোটের দিন কখন বেরুব ভোট দিতে এই নিয়ে কয়েকদিন আগে থাকতেই বাড়িতে আলোচনা সভা বসে। যে আবেগ নিয়ে ভোটের লাইনে দাঁড়াই সেটা যত দিন যায় ততই যেন উবে যেতে থাকে। তখন কিছুই ভালো লাগে না।
যখন টিভি ছিল না তখন খবরের কাগজে একটা সন্ত্রাসের খবর পেয়েছিলাম। ওই অল্প বয়সে শিউরে উঠতে হয়েছিল। রক্ত দিয়ে ভাত মাখার কথা মনে পড়তে খেতে বসে গা গুলিয়ে উঠত। তারপর দীর্ঘদিন ধরে দেখেছি সন্ত্রাসের নানা বর্ণ। সেই সন্ত্রাসে আগুনের হলকা নিজেও অনুভব করেছি অনেকবার। যারা এসব করেছে তাদের এখন বিপন্ন অস্তিত্ব। ইতিহাস বুঝি এইভাবেই কথা বলে।
ঘড়ির কাঁটা ডান দিকেই ঘুরতে থাকে তাই সময়কে আর ফিরিয়ে আনা না গেলেও যে আগুন একদিন জ্বালানো হয়েছিল তার একটা ফুলকি যে দাবানল সৃষ্টি করতে পারে এ কথা হয়ত ভাবা যায়নি।
যদিও কোনোটাই আমাদের কাম্য নয়। তবে সবকিছু যে আমাদের চাওয়ার ওপরে ভিত্তি করে ঘটবে তার কোনো মানে নেই।
এমন মনে হয়েছিল যে সবাই বুঝি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবে। ভাবনাটুকুই সার। তা হয় না। ক্ষমতা এমন এক প্রলোভন তা ভোগ করতে চাইলে অন্য সমস্ত বোধ অদৃশ্য হয়ে থাকে।
ফলে সেই কুরুক্ষেত্র যেন এসে হাজির হয়েছে একেবারে দুয়ারে।
আত্মীয়-স্বজনদের মারা যাওয়ার আগাম দৃশ্য দেখে অর্জুন শোকে যুদ্ধ করতে চায়নি। শ্রীকৃষ্ণ এমন বোঝান বোঝালো যে অর্জুনের মাথা ঘুরে গেল। ফলে যা হওয়ার তাই হল। তাই এখন যে শোক জয় করতে পারবে, সেই করে কম্মে খেতে পারবে। তবে শ্রীকৃষ্ণ যে অত কৌশল শেখাল তা যদুবংশ শেষ হওয়ার সময় কাজে লাগানো গেল না। নিজেকেও চলে যেতে হল একেবারে এলেবেলে ভাবে।
কত কিছু ভাবনার মধ্যে ছিল। দিনের-পর-দিন টিভিতে দেখা গেছে বেহাল রাস্তার ছবি। বেহাল মানুষের অবস্থা। আরও এমন অনেক কিছু যা দেখে মনে হয়েছিল, এবার সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে।
বহুবার এমন দেখেছি। কয়েকদিন আগে ফের আচমকা একটা ঝড় ইয়াস এসে দেখিয়ে দিল আসলে যা কিছু ছিল বহুদিন আগের থেকে বা আছে সবই যেন তাসের ঘর। অতি সহজেই সব ভেঙে যায়। আমাদের স্বপ্ন টুকরো টুকরো হয়। নোনা জলে ভেসে যায় জীবন ও জীবনের ছোটো বড়ো আশা। তাহলে এত কাল ফুল বেলপাতা দিয়ে নারকোল ভেঙে ঢাক পিটিয়ে যা করা হয়েছিল তার সবই পলকা? ঠিকমত গড়া হয়নি? কেন?
এবার নিশ্চয়ই এমন হবে যে প্রবল জলস্রোতেও স্থির দাঁড়িয়ে থাকবে মানুষের জীবনযাপন। তাকে বানভাসি জলে দাঁড়িয়ে প্রত্যাশায় থাকতে হবে না কখন সাহায্য আসে। সে পরিশ্রম করার উপযুক্ত পরিবেশ পাবে। পাবে যোগ্য পারিশ্রমিক। সে ভাতের গরাস সন্তানের মুখে তুলে দেবে গর্বের সঙ্গে।
আমরা সাধারণ মানুষেরা এমনটা ভাবতে পারি। সবাই করতে পারি না। কিছু করবার জন্য যে কেউ এগিয়ে আসেনি তা নয়। অনেক মানুষের মানবিক মুখ দেখেছি। তবে শুধু আর্থিক যোগ্যতা থাকলেই যে হবে তা নয়। তাতে হয়ত কিছুদিনের জন্য মাত্র সাহায্য করা যেতে পারে।
সাহায্য দিয়ে মানুষকে অচল করে দেওয়া এটা চিরকালীন বন্দোবস্ত হতে পারে না। মানুষকে সঠিক বোঝাতে পারলে সে কাজ করতে তখন উৎসাহ পাবে। তা করতে পারে একমাত্র সঠিক প্রশাসক। ও সুস্থ প্রসাশন।
যাকে মানুষ নির্বাচিত করেছে তিনি তখন নির্দিষ্ট কারও জন্য নন। সবার। সবারই ভালো মন্দ নিয়ে ভাবনার ফলে তিনি পেতে পারেন আরও সমর্থন। সমর্থন যারা করবে তারা ভয়ে করবে না। করবে ভক্তিতে। ভালোবাসায়। শ্রদ্ধায়।
হয়ত এসব ভাবনার কোনো মূল্য নেই। নানান হিংসার ঘটনা একসময় পড়তাম সংবাদপত্রে। এখন ঘরে বসে টিভির পর্দায় সব দেখা যায়। সেই সংবাদ যার পক্ষে যায় না তিনি বলেন, সব মিথ্যা।
তাহলে যা দেখি, তা কি সত্যিই দেখি না?
টিভির সংবাদেই তো দেখতে পাই কে কি বলছেন। যখন তাই নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তখন শোনা যায় তিনি এসব কথা বলেননি। তার মুখে সব বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবই প্রযুক্তির কারসাজি।
তাহলে যা শুনি, তা কি সত্যিই শুনি না?
দেখি এক একটা ঘটনায় কিছু মানুষের ক্রোধ হয়। সবাই মিলে শোরগোল তোলে। তখন গুচ্ছের মোমবাতি বিক্রি হয়। শুরু হয় ঘটনার ঘনঘটা। এরা কিন্তু আবার সব দেখতে পায় না।
মনে হয় কি দেখবে আর কোনটা নয় এসব যেন মালিক ঠিক করে দিয়ছে। যেভাবে রোবট তৈরি করা হয়। যতটুকু মালিক তৈরি করবার সময় চেয়েছে রোবট তার বাইরে যেমন কিছু করতে পারে না, বলতে পারে না এরাও যেন ঠিক তেমনই।
আমাদের মতো অনেক সাধারণ মানুষের খুব কষ্ট হয়। তারা ফোন করে কথা বলে। আলোচনার করতে গিয়ে জানায় জানায় তাদের অভিজ্ঞতার ও কষ্টের কথা। এসব নিয়ে শুধুমাত্র কষ্ট পাওয়া ছাড়া তাদের কিছু করবার নেই। আমারও না।
আমাদের কাছে কেউ মেসোমশাই বা পিসেমশাই নয় যে খাতির করে মন বুঝে কথা বলতে হবে। তেমন দায় অনুভব করি না। কেউ ভালো কিছু করলে আমরা খুশি হই। নতুবা কষ্ট পাই।
যারা পারে ক্ষমতার মাধ্যমে সব অন্যায় ঠিক করতে তারা সবাই এমন কথা বলে শুনলে সবকিছু কেমন গুলিয়ে যায়। মনে হয় তাহলে যা দেখছি তা সত্যি নয়! যা শুনছি তাও না!
নিজেরই চোখ কান এতটা প্রতারক?
সবকিছুর উপর থেকে বিশ্বাস হারাতে হচ্ছে। নিজের উপর থেকেও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছি।
তা না হলে এমন মৌন হয়ে আছি কেন? কেন মুখর হতে পারছি না?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।