• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক টুকরো হাসিতে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় – আঠারো

টুকরো হাসি – আঠারো

শুকোতে দিয়েছিল
উপেন চিঠি লিখেছে, রজতদা অনেক দুঃখে তোমাকে লিখছি।মনে আছে আমার দাদার ছেলে ও মেয়ে কিছুতেই লেখাপড়া ঠিক মতো করছিল না। তুমি আমাদের বাড়িতে এসে ভাইপো ভাইঝিকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে এক ঘন্টা ধরে কী আলোচনা করলে তা আমাদের জানালে না। যাবার সময় বলে গেলে, কাল থেকে ওদের আর লেখাপড়া করার কথা যেন না বলা হয়। আমরা তোমার কথা অমান্য করিনি। ওদের কখনো পড়তে বলিনি।
তুমি চলে যাবার পর থেকে ওরা নিজেরাই সময় মতো পড়তে বসত। দু’জনেই প্রতিটি পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। এখন ভালো চাকরি করে।
রজতদা যে জন্য লিখেছি তা বলতে লজ্জা করছে। তবু বলতে হবে। মনে হয় দাদা তুমিই এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে। যদি কয়েকদিনের জন্য আমার বাড়িতে আস তাহলে কৃতজ্ঞ থাকব।
আমর ছেলে ভন্টা মুখেভাতের দিন যে তোমার কোল থেকে নামতেই চাইছিল না। সে এখন বড়ো হয়েছে। লেখাপড়া করে না। কিসের অনুপ্রেরণায় যে সারাদিন ঘুরে বেড়ায়,কে জানে।
একদিন বলেছিলাম, পাশ করলে হয়ত একটা চাকরি হত। এই কথা শুনে ভন্টা ফ্যাক করে হেসে বলল, লেখাপড়া করলেই যদি চাকরি হবে তবে এম এ পাশ ত্রিদিবেশ সেদিন কেন আমার কাছে একটা সিগারেটের জন্য ভিখিরির মতো হাত পাতল।
কোনো জবাব দিতে পারলাম না। বুঝলাম ভন্টা সিগারেট ধরেছে। আর কি ধরেছে কে জানে! এখন মাদক শুনতে পাই জল ভাতের মতো সহজেই পাওয়া যায়। তাহলে আর সর্বনাশের বাকি কি রইল? দাদা তুমি এসে যদি আমার ছেলেটাকে একটু পথে আনতে পার, তাহলে আমি তোমার কাছে চিরদিনের জন্য কৃতজ্ঞ থাকব।’
উপেনের চিঠি পরে রজতের মনে একটা কষ্টের স্রোত বয়ে গেল।এই ছেলেটাই উপেনের সম্বল। একবার গিয়ে তো দেখা যাক। যদি উপেন যা চায় তেমন কিছু করা যায়।
যেতেই উপেন আর ওর বউ লতা খুব খুশি। শুনল ভন্টা বাড়িতেই আছে।
লতা ডাকল, ‘ভন্টা দেখে যা কে এসেছে।’
ভন্টা এল। মাথায় মুরগির ঝুটির মতো চুল। তাতে দু’রকম রঙ। হাঁটার তালে চুল দুলছে।
‘জেঠুকে প্রণাম কর।’ উপেন বলল।
‘কে জেঠু? এই হোদল কুৎ কুৎটা। কিম্ভূত কিমাকার। বাড়িতে আমাকে না বলে ঢুকে পড়া একটা বহিরাগত মালকে আমি হুট্‌ করে জেঠু বলব?’ বলল, ‘তাছাড়া তুমি আর তোমার নিজের দাদা তো রোগা পটকা। তোমাদের বাড়িতে এইরকম লোক আসে কী করে। এই রকম নাদুস নুদুস, ফুটুস ফাটুস, ফোলা ফোলা, গাপুস গাপুস।’
এই অবস্থা থেকে পালিয়ে যাবার জন্যই বোধহয় লতা বলল, ‘দাদা আমি আপনার জন্য চা নিয়ে আসি।’
উপেনও তড়িঘড়ি কাজ দেখিয়ে চলে গেল।বলল, ‘দাদা তুমি ভন্টার সঙ্গে কথা বল। আমি আসছি।’
ভন্টা রজতকে বলল, ‘পাঁচশ টাকা ছাড়ুন তো দেখি।’ রজত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ভন্টার দিকে।এই ছেলেটিই মুখেভাতের দিন তার কোল থেকে নামতে চাইছিল না। চারবার জামা ভিজিয়েছে। নামাতে গেলেই চিৎকার করে উঠেছে।
রজত বলল, ‘পাঁচশ টাকা কেন দেব?’
‘সঙ্গে যা লটবহর দেখছি তাতে মনে তো হচ্ছে আমাদের বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য বডি ফেললেন। এখানে থাকা আর ভোজনের খরচ তো বাবা নেবে না। হোটেলে থাকলে কি এইরকম ফোকটে থাকা যেত। নিন পাঁচশো ছাড়ুন। এটা তো দিতে হবেই। আমার সিন্ডিকেটের লোকেরা নিশ্চয়ই আমাদের বাড়িতে আপনাকে ল্যান্ড করতে দেখেছে। আমাদের খরচা আছে। ওরা হিসেব নিতে এলে কিন্তু কিচাইন হয়ে যাবে। তখন পাঁচশোতে রফা হবে না। হাজার, দু’হাজার গলতা হয়ে যাবে। এরপর আপনি যখন ভোজনে বসবেন তখন যদি সবাই এসে বলে, তুই কি টাকা দিয়েছিস যে খেতে বসেছিস। তখন পালাবার পথ পাবেন?’
রজত মিন মিন করে বলল, ‘এই রকম কথা হবে কেন? এটা তো বাংলার সংস্কৃতি নয়।’
‘দেখুন কোনটা বাংলার সংস্কৃতি সেটা আমি কোনো পেটমোটার কাছে শিখব না।’
ভন্টা একটু চুপ করে থেকে বলল,‘ফোলা ফোলা আপনাকে দেখলে বোঝা যায় আপনি শুধু কেলা খান। আমাদের বাড়িতে লালশাক,পালংশাক আরও অনেক কিছু খাবেন। এখানে খাওয়ার একটা ইজ্জত আছে। টাকাটা ছাড়ুন তা না হলে কোমরে দড়ি দিয়ে গোটা পাড়া ঘোরাব। মিস্টিতে পাথরের টুকরো দিয়ে খেতে দেব । তখন বুঝবেন সংস্কৃতি কাকে বলে।’
ইতিমধ্যে বাইরে গোলমাল শোনা গেল। চিৎকার করতে করতে লোকজন এদিকেই আসছে।
ভন্টা বলল, ‘মালটাকে সালটে এসেছিলাম। মনে হয় দিয়েছে কিচাইন করে। ফালতু বাওয়াল শুরু হবে।’
উপেন এসে বলল, ‘রজতদা কাল রাতে ঘুমাতে পারিনি। মনে হচ্ছে এখুনি আবার ঝামেলা শুরু হবে। আমি পাগল হয়ে যাব। আমাকে আপনি বাঁচান।’
রজত মনে মনে ভাবল এখন সে কোন উপায়ে উপেনের বাড়ি থেকে পালাবে সেটাই নিজে বুঝে উঠতে পারছে না। সে বাঁচাবে উপেনকে!
ইতিমধ্যে কিছু ছেলে ঘরে ঢুকে পড়ল। রজতকে দেখে একজন ভন্টাকে বলল, ‘এই মালটা কে বে। তোদের বাড়িতে বহিরাগত ঢুকে বসে আছে? ঠিক আছে এই কেসটা এখন তোলা থাক। পরে হিসেব নেব। তোকে থানায় বড়োবাবু ডেকেছে। ওই মালটাকে কাল অত করে বোঝালাম। বুঝল না। মালগুলিকে আবার কেলিয়ে টেবিলের তলায় বসিয়ে ফাইল দিয়ে মুখ না ঢাকালে চলবে না। চল দেখি কেন ডেকেছে। ভয় নেই আমরা তো আছি।’
সবাই বেরিয়ে গেলে উপেন বলল, ‘আমাদের এলাকায় ডাঙ্গাপাড়ার দিকে একটা লোককে মেরে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছে। এই নিয়ে ঝামেলা। একটা দলের লোকেরা বলছে লোকটা ওদের সমর্থক ছিল। ভন্টাকে কাল সারারাত ধরে থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। অবশ্য অনেকে বলেছে লোকটার নাকি হার্টের রোগ ছিল।’
রজত বলল, ‘হার্টের রুগির কত কষ্ট। সেই কষ্ট নিয়ে গাছে উঠে ঝুলে পড়েছে! এটা পুলিশ মেনে নেবে?’
‘মেনে তো নিচ্ছে। উপর মহলের ফোন পেয়েছে। বলছে লোকটার আরও অনেকরকম রোগ ছিল শরীরে।’
রজত বলল, ‘গাছের মগডালে কি ডাক্তারের চেম্বার আছে। ওখানে দেখাতে গিয়েছিল।’
লতা বলল, ‘আর বলবেন না দাদা। সবাই সব বোঝে। অবুঝ সেজে থাকে। কি জ্বালায় যে আমরা জ্বলছি। আমার ছেলেটার গায়ে যে কিসের হাওয়া লাগল। ছেলেটাকে যে কোন এলে ভূতে ধরল।হায় আমার কপাল। ’ কথাটা বলে সে কাঁদতে শুরু করল।
আবার লোকজনের হৈ হল্লা।ঘরের ভিতরে ঢুকল সবাই। একজন কলার তুলে খইনি ডলতে ডলতে বলল, ‘বুইলেন কাকু শুধু শুধু ভন্টার নামে দোষ দিচ্ছিল। মুখে ঝামা ঘসে দিয়েছি আমরা। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলছে লোকটা হার্টফেল করে মারা গেছে। রাতে যখন পুকুরে নেমেছিল, তখন।’
রজত বলল, ‘তবে গাছে ঝুলল কিভাবে?’
‘থানায় বড়োবাবুকে তো বললাম। আবার আপনাকেও বলতে হবে। আপনি কে?’
ঘাবড়ে গিয়ে রজত বলল, ‘না না আমাকে বলতে হবে না। আমি কেউ না।’ উপেনের দিকে তাকিয়ে রজত বলল, ‘আমি বাড়ি যাব।’
‘বাড়ি তো যাবেনই।’ খইনি মুখে চালান করে ছেলেটি বলল, ‘এত প্রশ্ন করলে এখানে আপনাকে থাকতে দেব? কালো পতাকা দেখাব। মাথায় আধলা টপকাব। শুনুন লোকটা পুকুরে আছাড় খেয়ে পড়ে ভিজে গিয়েছিল। দেখে ভন্টার খুব কষ্ট হয়েছিল। ও অন্যের কষ্ট একদম সহ্য করতে পারে না। এটা থানার বড়োবাবু বুঝে নিয়েছে। ভন্টার কোনো দোষ নেই। লোকটার ভালোর জন্যই তো গলায় দড়ি বেঁধে গাছের ডালে হাওয়ায় শুকোতে দিয়েছিল।’
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।