মার্গে অনন্য সম্মান খুশী সরকার (সর্বোত্তম)

অনন্য সৃষ্টি সাহিত্য পরিবার

পাক্ষিক প্রতিযোগিতা পর্ব – ২৪
বিষয় – শীতকাল

শীতের লীলা

কয়েকদিন ধরেই শীত বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই সন্ধ্যা দেবী শুষ্ক রুক্ষ এলোচুলে নেমে এসেছে ধরায়।
প্রচন্ড ঠান্ডাতে লীলার পা দুটো ফুলে ঢোল।আজ আর বোধহয় যেতে পারবে না— বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছে লীলা। তখনই রাম ডাক দেয়, মাসি, ও মাসি চারটা বেজে গেছে তো,একটু পরেই তো ট্রেনটা চলে আসবে গো।
–হ্যাঁ,রে তাই তো ভাবছি কিন্তু কি করি বল তো, আজ আর পা দুটো তো তুলতে পারছি না– দ্বিধাগ্রস্ত গলায় উত্তর দেয় লীলা। বলতে বলতেই হঠাৎই লেপ সরিয়ে উঠে পড়ে লীলা। মনে মনে ভাবে, না গেলে কি করে চলবে তার? দুটো প্রাণীর দু’মুঠো ভাত জোগাড় হয় তার এই দুধের ব্যবসাতেই। এমন পোড়া কপাল, শরীর খারাপ হলেও একদিন বসে খাবার জো নেই। অগত্যা ঘর-দুয়ার ঝাঁটা দিয়ে দুধের বালতি নিয়ে বের হয়। চারদিক ঘন কুয়াশায় ঢাকা। কিছু দেখতে পাচ্ছে না। শীতের ভোর। রাস্তা নির্জন, শুধু ঘন কুয়াশায় রাস্তার আলোগুলো ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছে উদাসীন বাউলের মতো। তার মধ্যেই শুনতে পাই হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন আসছে ওই পোলা পা দুটো যেন কিছুতেই সরতে চাইছে না, তবু কোনোমতে টেনে টেনে পা চালায় লীলা। স্টেশনে পৌঁছে দেখে দুধ প্রায় শেষ। শুধু একজনের কাছে কেজি পাঁচেক দুধ পড়ে আছে। শেষ পর্যন্ত ওই দুধটুকু নিয়েই সে তার বাঁধা যোগানদারদের দিয়ে ফিরে আসে প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ। প্রচণ্ড ক্লান্তিতে বসে পড়ে দাওয়ায়। মনে মনে ভাবে, অন্তত এক কাপ চা যদি কেউ এই সময় তাকে এগিয়ে দিত তাহলে শুকনো ঠোঁট দুটো হয়তো একটু ভিজতো। কিন্তু সে কপাল কি সে করে এসেছে? আপনজন থেকেও কেউ নেই আজ তার,ভেবেই যেন চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাই। রাম পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে, মাসি, আমি স্কুলে যাব তো। ভাত বসাবে না?
— হ্যাঁ বসাবো তো বাবা, বলেই মুখ আড়াল করে চোখের জল মুছে। রান্নার জন্য একটি মাটির উনুন। খড়কুটো দিয়ে রান্না। ভাতের হাড়ি বসায় কোনোমতে। আলুসিদ্ধ ভাত চাপিয়ে দেয়। বসে উদাস ভাবে চেয়ে থাকে দূরে। ভাবতে থাকে, আজ তার কত সুখের দিন হতে পারতো। ছেলেটা তো ভালোই রোজগার করে। কিন্তু সে কি তার এই বিধবা মায়ের জন্য! নিজের সংসারের জন্য। অথচ কত কষ্টই না করে সেই হা-ভাতের ঘরে বড় করেছে তাকে। মনে পড়ে তার সেই দিনটা। সবে 13 বছর বয়স। বিয়ে হলো ভালো ঘর বর দেখে। গোয়ালার ঘর, কত দুধ মাখন বাড়িতে। ভালো ব্যবসা করে স্বামী মুকুন্দ। সংসারে বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে কিন্তু বছর যেতে না যেতেই হঠাৎ মারা গেল বসন্ত রোগে। চলে যাওয়ার পর শ্বশুর শাশুড়ির চোখে লীলা হয়ে গেল অপয়া, রাক্ষসী। কতই না গালমন্দ দিয়েছে তাকে শাশুড়ি। গালমন্দ সহ্য করেও তাদের কাছে শুধু মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকু চেয়েছিল তখন সে ছমাসের পোয়াতি। শাশুড়ির পা ধরে বলেছিলো, ‘আমাকে শুধু একটু থাকতে দাও মা’। তোমার ছেলের সন্তান আমার পেটে। কিন্তু না, কোনো কথায় শোনেন নি বরং মুখ ঝামটে বলেছিল, আ মোলো, ছেলেই নাই, তার আবার ছেলে ! তুমি রাক্ষসী
। আমার ছেলেকে খেয়ে ফেললে, তোমার মুখ দেখতে চাই না আমরা।তুমি আমাদের চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যাও।
লীলার কান্না শুনে পাড়া-প্রতিবেশ‌ীও ছুটে এসেছিল সেদিন কিন্তু কোনো কাজ হয় নি। মুকুন্দকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার পরেই তাকেও বাড়ি ছাড়া হতে হয়। তখন সদ্য বিধবা লীলার একদিকে স্বামী হারানোর হাহাকার অন্যদিকে সংসার থেকে বিতাড়িত হওয়ার কষ্ট— কি ভয়ানক ছিল সেদিনটা! আজও সেই দগদগে ঘা শুকায় নি। তার পর একটার পর একটা ঘটনার পট পরিবর্তন হয়েছে নাটকের মতো। তার জীবনে বাপের বাড়ি, সন্তানের জন্ম, বাপ-মা চলে যাওয়া, তার দায়িত্ব নিতে ভাইয়ের অস্বীকার—- সব যেন ছবির মতো ফুটে উঠতে লাগলো লীলার মনের উপর। এমন সময় ,”ও মাসি, দাও না” রামের ডাকে সম্বিত ফেরে লীলার। তাড়াতাড়ি গরম ভাত আলু সিদ্ধ দিয়ে খেতে দেয়।রাম স্কুলে চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন রাগ হয় লীলার। মনে মনে বলে, এই তোর জন্যই তো আমার ছেলে আমার কাছে থাকে না। স্কুল না গিয়ে কোথাও চলে যেতে পারিস না হতভাগা, তাহলে অন্তত দুমুঠো ভাত ছেলের কাছে পাই। কিন্তু পরক্ষণেই মনটা কেমন যেন নরম হয়ে যায় তার। সঙ্গে সঙ্গে মন বলে ওঠে, না, না, কোথাও মাস না বাবা।ফিরে আসিস তোর এই হতভাগী মাসির কাছে। তুই-ই তো আমার জীবনের একমাত্র সম্বল। সে কোন ছোটবেলায় মা’টা অসুখে পড়ল। হাত দুটো ধরে বলেছিলো, ‘দিদি আমি মরে গেলে রামকে তুমি দেখো। রতন তো তোমার কাছে থাকে না, ও-ই তোমার সন্তানের অভাব পূরণ করবে। সেদিনও এমনি প্রচণ্ড শীত ছিল। সেই শীতেই বোনটা আমার চলে গেল। কি করবো, ওর মা-হারা মুখের দিকে চেয়ে বড় মায়া হয়েছিল যে। নিয়ে আসলাম। ভাবলাম, যা হোক আমার সঙ্গে খেয়ে না খেয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকবে তো। সেই থেকেই তো আমার জীবনে জড়িয়ে গেল অথচ আমার ছেলে, যাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখলাম, কত আশা করলাম— সে-ই আজ আমায় দেখে না। একবার খোঁজও নেয় না। অথচ স্বামী হারিয়ে বাপের সংসারে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত যে কত কষ্টে বড় করেছি সেটা একমাত্র ঈশ্বরই জানে। শেষ পর্যন্ত ওর লেখাপড়া, বড় করা —এসব ভেবেই তো দুধের ব্যবসা শুরু করলাম। শুধু কি তাই বাপের বাড়ি থেকে আলাদা করে ছেলেকে নিয়ে থাকবো বলে এই ঘরটুকুর ব্যবস্থা করলাম। তখন শরীরে কত শক্তি,কত সাহস! এইরকম জাঁকালো শীত কত পায়ে মেরেছি। শুধু একটাই আশা বুকে বেঁধেছিলাম, ছেলে বড় হলে এই দিন আমার শেষ হবে কিন্তু হায়! ‘অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে লীলা। হঠাৎ তাকিয়ে দেখে বেলা পড়ে গেছে। অমনি ধড়ফর করে উঠে পড়ে। কোনোমতে এক বালতি জলে স্নান সেরে নেয়। সেই আলুসিদ্ধ ভাত নিয়ে খেতে বসে কিন্তু পা দুটো জরো করতে পারে না, বড্ড ফুলেছে আজ।বড্ড কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কি করবে সে! কেই বা আছে তার, চিকিৎসা করাবে। শেষ পর্যন্ত পা ছড়িয়েই কোনোমতে ভাত খায়। অবেলায় ভাত খাওয়াতে ভীষণ ঠান্ডা লাগে তার।লেপটাও ছিঁড়ে গেছে কিন্তু পয়সা নেই যে নতুন একটা বানায়। দুধের ব্যবসায় যা রোজগার হয় তা তো মাসি বোনপোর খাওয়াতেই চলে যায়।
হঠাৎ মনের কোণে উঁকি দেয় একটা ইচ্ছা, এ সময় যদি রতনকে গিয়ে বলে বাবা, এতদিন তো তোর কাছে কিছুই চাই নি, এবার একটা নতুন লেপ বানিয়ে দিবি? দেবে না? নিশ্চয় দেবে, হাজার হোক পেটের ছেলে তো, না করতে পারবে না। চোখে মুখে যেন একটা আনন্দ ঢেউ খেলে যায়,ইস্, ছেলেটা যদি আমার কাছে থাকতো, নাতিটাকে নিয়েই আমার সময় কেটে যেত হেসে খেলে। কত আর খরচ পড়ত আমাকে খাওয়াতে। সঙ্গে সঙ্গে স্থির করে ফেলে, কাল‌ই যাবে সে রতনের বাড়ি। কিন্তু মুহূর্তেই যেন বিষাদের কুয়াশা ঘিরে ধরে তাকে। রতন যদি না থাকে? ওর বউ কি আমাকে যত্ন আত্মি করবে ? ছেলেটা তো কতদিন পর পর বাড়িতে আসে। লীলার চোখের সামনে ফুটে ওঠে রতনের সেই জ্বলজ্বলে চোখ মুখ। আনন্দে মনে পড়ে ছোটবেলায় কত আনন্দেই ছিলাম মা-বেটা। তখন আমার পায়ে পায়ে ঘুরতো। কতদিন কোলে কোলে নিয়ে যোগান বাড়িতে গেছি। কতজন চকলেট বিস্কুট হাতে দিত ওর।কুট কুট করে খেত। তারপর 6 বছরে ভর্তি করে দিলাম স্কুলে। পড়াশোনাতেও তো বেশ ভালো ছিল। কিন্তু কি যে হলো! নাইন ক্লাসে উঠেই আমাকে কিছু না বলেই চলে গেল বাইরে। কত খোঁজ করেছি পরে শেষ পর্যন্ত ওর দুঃখে ব্যবসাটাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। কেমন যেন বুকটা শূন্য হয়ে গিয়েছিল, মরুভূমির মতো কেমন যেন খাঁ খাঁ করত। ব্যবসা করে যা জমিয়ে ছিলাম, কিছুদিন বসে বসে খেলাম। কিন্তু বসে খেলে তো রাজার রাজভাণ্ডার‌ও ফুরিয়ে যায়, আমি তো অতি সামান্য ব্যবসায়ী। কথায় বলে, শোকেরর চেয়ে পেট বড়। তাই পেটের দায়েই আবার নামতে হলো ব্যবসায়। আর সেই শূন্য জীবনে এলো রাম। ভাবলাম, ঈশ্বর বুঝি রতনের পরিবর্তে রামকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। দীর্ঘ 10 বছর এই রামকে নিয়েই আছি। আবারও এক শীতের ভোরে হঠাৎ আবছা অন্ধকারে দেখতে পেলাম, কে যেন দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে। ‘কে ওখানে’ বলতেই সামনে এসে বললো, মা, আমি রতন। কথাটা প্রথমে বিশ্বাস হয় নি। তারপর যখন কুয়াশা ভেদ করে ও আমার সামনে এলো, তখন জড়িয়ে ধরলাম ওকে, খুব কেঁদেছিল ও, আমিও কেঁদেছিলাম খুব। ভেবেছিলাম, ভগবান দয়া করেছেন। একটা নয় দুটো ছেলে দিয়েছেন আমাকে।
কিন্তু কয়েকদিন পরেই আবার চলে গেল কাজের খোঁজে। এবার অবশ্য বলে গেছিল, কাজ পেলে ও টাকা পাঠাবে আমায়। আমি যেন এত কষ্টে আর দুধের ব্যবসা না করি। বিশেষ করে শীতের ভোরে হেঁটে হেঁটে স্টেশনে যাওয়াতে ওর খুব কষ্ট হতো। অথচ সেই রতন আজ ট্রাকের ড্রাইভার। কত রোজগার! বিয়ে করল, সংসার হলো কিন্তু সেই সংসারে আর মায়ের জায়গা হলো না। তবুও একদিন
ওর বাড়িতে গিয়ে বললাম, বাবা, তোর বাড়িতে কি আমার একটু জায়গা হবে না? এত কষ্ট করে বড় করলাম তোকে।
সেদিন স্পষ্ট করেই বলল রতন, কেন? তোমার ছেলে তো তোমার কাছেই থাকে। তাছাড়া তোমার দুধের ব্যবসা আছে। অভাব কোথায়?
— তুই কি আমার ছেলে না? ও তো মা-হারা একটা অনাথ ছেলে, তুই ছিলি না বলেই ওকে নিয়েছিলাম কাছে।
— তাহলে আমার কাছে থাকতে চাইছ কেন?
— সব মা’ই তো ছেলের কাছে থাকতে চায়, বল।
— সে তো ঠিক কিন্তু তোমার দায়িত্ব নিলেও আমি তো ওর দায়িত্ব নিতে পারবো না। ওকে আগে ছাড়ো তবেই আমার কাছে থাকতে পারবে।
— ওই ছেলেটাকে কোথায় ছেড়ে দিব বল? ও আরেকটু বড় হলে নিজেই নিজের ব্যবস্থা করে নেবে, তুই শুধু কয়েকটা বছর রাখ না বাবা।
— তা হবে না।
— সেদিন মুখের উপর বলেছিল, আগে ওর ব্যবস্থা করো, তবেই ছেলের কাছে আসার চেষ্টা করো।
সেই দিন থেকে আর যায় নি রতনের কাছে। কোনো খবর রাখল না আর। এখন যদি যাই আজো সে হয়তো একই কথা বলবে।
সে সময় রাম স্কুল থেকে ফিরে আসে। আবার সেই একই খাবার দেখে বড্ড রাগ করে রাম। চিৎকার করে বলে, রোজ রোজ একই খাবার খেতে ভালো লাগে না। তুমি কি—ই সব রান্না করে রাখো।
এবার আর ধৈর্য থাকে না লীলার। প্রচন্ড রেগে গিয়ে বলে, রোজ রোজ কোথায় পাবো টাকা? কত টাকা আয় হয় দুধের ব্যবসায়? খেতে ভালো লাগে না তো নিজে কামাই করে নিয়ে খা। যা না কতো ভালো ভালো খাবার খাবি?
— ও খাওয়ার খোটা দিচ্ছো। দুমুঠো সেদ্ধ ভাত খাওয়াও,তাই?
–হ্যাঁ দিচ্ছি, যা, কোথায় ভালো ভালো খাবার পাস, চলে যা।
সেই যে থালা ছেড়ে গেল রাম, অনেক রাত হয়ে গেলো তবুও বাড়ি ফেরে না। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও না পেয়ে বড় দুশ্চিন্তায় দাঁড়িয়ে রইলো লীলা দরজায়। হিমেল ঠান্ডায় অপেক্ষা করতে থাকলো।
সেই মুহূর্তে বড় অপরাধী মনে হচ্ছিল তার নিজেকে। ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল কিন্তু ঘুম আসছে না। মনে পড়ল সেই রামের মায়ের মুমূর্ষু মুখ। মৃত্যুর আগে দেওয়া কথা। মা মারা যাওয়ার পর রাম লীলার কোলে মুখ গুঁজে কেঁদেছিল। লীলা আদর করে বলেছিল, মা গেল তো কি হয়েছে বাবা, আমি তো আছি। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন আমার কাছে থাকবি। সেই থেকেই রাম তার সন্তানের অভাব পুরণ করে হৃদয় ভরে রেখেছিল। অথচ আজ সে নিজেই ছেলেটাকে অত করে বকলো।
লীলার বারবার মনে হতে লাগল যদি রাম দুঃখে কোনো বাস কিংবা ট্রেনের তলায় ঝাঁপ দেয়, যদি আর কোনোদিনও ফিরে না আসে তার কাছে, তাহলে ঈশ্বর বোধহয় তাকে ক্ষমা করবে না কোনোদিন—- ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারে নি। হঠাৎ ধরফর করে বিছানা ছেড়ে বাইরে আসতেই দেখে, রাম দাওয়ার এক কোণে কুকড়ে শুয়ে আছে।
বড় মায়া হল ছেলেটাকে দেখে। ঘুমন্ত অবস্থায় কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো লীলা। ছেঁড়া লেপটা ঢাকা দিয়ে চলে গেল স্টেশনে। একে পা দুটো ফোলা, তার উপর প্রচন্ড শীত। সারারাতের নির্ঘুম
চোখে কোনোমতেই পা টেনে টেনে পৌঁছালো স্টেশনে কিন্তু ভীষণ শরীর খারাপ লাগছিল তার
তাই কোনমতে স্টেশনে পৌঁছে প্লাটফর্মের এক কোণে বসে পড়ে ধপাস করে। ট্রেনটাও স্টেশনের কেন যেন আগেই দাঁড়িয়েছিল। তাই ভাবল একটু বিশ্রাম নিয়ে নি। মাথাটা হঠাৎই ঘুরে গেল। কেমন যেন অন্ধকার হয়ে এলো চারিদিকে। তারপরেই—–
রাম এদিকে সকালে ঘুম ভেঙে দেখে, ও বিছানায় শুয়ে আছে। ভাবলো মাসি বুঝি ঠিক তাকে দাওয়া থেকে তুলে এনে দিয়েছে বিছানায় কিন্তু মাসি তো বিছানায় নেই। মনে মনে ভাবল মাসিক ঠিক স্টেশনে গেছে দুধ আনতে। কিন্তু দশটা বেজে গেল মাসি তো আসে না, বড় চিন্তা হলো মাসির জন্য। কষ্টে মনে হলো মাসির পা দুটো কেমন যেন ঢোল হয়ে ফুলে গেছে, হয়তো হাঁটতে দেরি হচ্ছে। আর কিছুক্ষণ দেখি।
বেলা গড়ে যায় কিন্তু লীলা ফেরে না।থাকতে না পেরে রাম স্টেশনে যায় খোঁজ নিতে। গিয়েই দেখে প্লাটফর্মে অনেক লোক এক জায়গায় ভিড় করে কি যেন বলাবলি করছে। এদিক-ওদিক না পেয়ে এগিয়ে যায় ভিড়ের মধ্যে।বুকটা কেমন যেন ধরাস করে উঠলো। ভেতরে তাকাতেই রাম হতবাক! একি! এ তো মাসি। অমনি চিৎকার করে ভেতরে ঢুকেই মাসির মাথাটা কোলে নিয়ে বসে। উপরে তাকিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে, তোমরা একটু মাসিকে হাসপাতালে নিয়ে চলো না। কে একজন ভিড়ের মধ্য থেকেই বলে ওঠে, হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে কি হবে? উনি তো মারা গেছেন। কান্নায় ভেঙে পড়ে রাম। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে, ও মাসি, আমি আর রাগ করবো না গো। ওঠো না মাসি?
পাশ থেকে একজন বলল, আমি তো সেই ভোর বেলায় দেখেছি, উনি এখানে বসে ঠান্ডায় কাঁপছিলো, কেমন যেন চুপ করে বসেছিলো।
তারপর ট্রেন এসে গেলে আমি আমার জিনিস নিয়ে বাড়ি চলে যাই। আবার এখন এই পথে আসতেই দেখি এখানে ভিড়। দেখি সেই মহিলা। উনি হয়তো অসুস্থ ছিলেন আগেই। আর একজন বলে উঠল, এই ছেলে, তুমি জানতে না, তোমার মাসি অসুস্থ। ওকে স্টেশনে আসতে দিলে কেন?
রাম কোনো কথার উত্তর না দিয়ে কেঁদেই চললো। শেষ পর্যন্ত কয়েকজনকে নিয়ে মৃতদেহ বাড়ি নিয়ে আসলো রাম। কিছুক্ষণ পরেই লোকমুখে খবর পেয়ে ছুটে আসে রতন। সে প্রচণ্ড চিৎকার করে রামকে বলতে থাকে, তোর জন্য আমার মা মারা গেছে। তুই না থাকলে আমার মা আমার কাছেই থাকতো। হঠাৎ হাত ধরে টেনে রামকে দূরে সরিয়ে দেয়,বলে, আমার মা, আমি সব ব্যবস্থা করবো। রাম দূরে বসে শুধু কাঁদতে থাকে। পাড়ার কয়েকজনকে নিয়ে রতন প্রচণ্ড শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে লীলার মৃতদেহ নিয়ে যায় শ্মশানে। শ্মশানের দূরে গাছের গোড়ায় বসে রাম মাটি আঁকড়ে তাকিয়ে থাকে চিতার দিকে। চিতা জ্বলে ওঠে। কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে সেই অন্ধকারে চিতার ধোঁয়ায় রাম দেখতে পায়, মাসি যেন হাত নেড়ে বলছে, ‘ভয় পাস না রাম। আমি আছি তো বাবা’। ধীরে ধীরে চিতার আগুন নিভিয়ে সব চলে যায়। নির্জন অন্ধকার শ্মশানের বুকে বসে থাকে রাম। শুধুই অন্ধকার তার চোখে। পৃথিবীর সবাই যেন তখন শীতঘুমে আচ্ছন্ন। শীতের লীলা চিরতরে মিশে যায় নীল আকাশে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।