ধলেশ্বরীর অন্য ধারায় ভ্রমণ কাহিনীতে লোকমান হোসেন পলা

মুর্শিদ কুলি খানের মানব কলিজাখেকো কন্যার জীবন্ত সমাধি

বাংলার ইতিহাসে ঐশ্বর্য বৈভবের ছোঁয়া যেমন আমরা পাই, তেমনি রহস্যময়তাও কিছু কম নেই।আবার তেমনি বাংলার ইতিহাস ঘাঁটলে নিষ্ঠুরতার নিদর্শনও অনেক পাওয়া যায়। নবাব-বেগমদের জীবন যেমন রহস্যময় ছিল, তেমনি বেশকিছু নবাব এবং বেগম কুখ্যাত ছিলেন তাদেরই নিষ্ঠুরতার জন্য।
এমনই এক নিষ্ঠুর বেগম আজিমুন্নেসা। যে নারীর কঠোর হৃদয় দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল স্বয়ং তাঁর পিতা। বেগম আজিমুন্নিসা ছিলেন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর পালিতা কন্যা। মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার প্রথম নবাব ছিলেন। তার বেগম নৌর্সেরি বানু ছিলেন সন্তানহীনা। তাই এক পুত্র ও দুই কন্যাকে তারা লালন পালন করেন। কন্যারা হলেন আজামাতুননিসা এবং আজিমুন্নিসা।
মুর্শিদকুলি খাঁ আজিমুন্নিসাকে বিয়ে দেন উড়িষ্যার নবাব সুজাউদ্দিন মোহাম্মদ খানের সঙ্গে। যিনি পরে সুজাউদ্দৌলা নামে মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে বসেন। সুজাউদ্দিন ছিলেন মুর্শিদাবাদের তৃতীয় স্বাধীন নবাব। তাঁর পত্নী আজিমুন্নিসা বেগম ছিলেন সেই সময়কার সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং ধনশালী মহিলা।একবার তিনি অত্যন্ত দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হন ।তাঁর পিতা নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এবং স্বামী সুজাউদ্দৌলা অনেক ডাক্তার, কবিরাজ, হাকিম ডাকেন তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য। কিন্তু কোন কিছুতেই তিনি সুস্থ হচ্ছিলেন না। অবশেষে এক হাকিম তার এই দুরারোগ্য অসুখ সারাতে সমর্থ হন। ওষুধের পথ্য হিসেবে তিনি যা দিয়েছিলেন শুনলে সকলের গায়ে কাঁটা দেবে। সেটি হলো তিনি বেগমকে প্রত্যেকদিন একটি করে শিশুর কলিজা অর্থাৎ হৃদপিণ্ড খাওয়ার পরামর্শ দেন। হাকিম এর কথা অনুযায়ী বেগম প্রত্যেকদিন একটি করে শিশুর কলিজা খেতে থাকেন। কিছুদিন পর তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান। কিন্তু শিশুদের কলিজা খাওয়া তার নেশায় পরিণত হয়।
আজিমুন্নেসা বেগম সেই সময়কার অত্যন্ত প্রভাবশালী মহিলা ছিলেন ।তাই তার অনুচরেরা তার কথামতো প্রত্যেকদিন একটি করে শিশুর কলিজা তাকে এনে দিতেন। এমনিভাবে বেশ কিছুদিন চলার পর খবরটি নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এর কানে আসে ।তিনি ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য অনুসন্ধান শুরু করেন। শেষে যখন দেখা যায় ঘটনাটি সত্য ,তখন তিনি এ ঘটনার শাস্তি স্বরূপ কন্যা আজিমুন্নিসা কে জীবন্ত সমাধি দেন।
আবার অনেকের মতে নবাব সুজাউদ্দৌলা তার স্ত্রীকে জীবন্ত সমাধির আদেশ দিয়েছিলেন, কারণ তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক একেবারেই ভাল ছিল না। আজিমুন্নেসা সব সময় স্বামীর চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করতেন এবং বিভিন্ন বিষয় তাদের মধ্যে মতবিরোধ লেগে থাকত। আজিমুন্নেসা অত্যন্ত স্বাধীনচেতা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি পিতা মুর্শিদকুলি খাঁ এর মত একটি মসজিদ নির্মাণ করেন এবং সে মসজিদের নিচেই নিজের সমাধি তৈরি করে রাখেন। পরবর্তীতে সেই সমাধিস্থলেই তাকে জীবন্ত সমাধি দেওয়া হয়। আজিমুন্নেসা মনে করতেন তার সমাধির ওপরে পুণ্যবান মানুষের পায়ের ছাপ পড়লে তাদের চরণ স্পর্শে তার সমস্ত পাপ স্খলন হবে এবং তিনি মুক্তি লাভ করবেন ‌। আজিমুন্নেসা বেগম এর সমাধির উপরে আরো একটি সমাধি দেখতে পাওয়া যায়। তবে এই সমাধিটি আসলে কার সেটি সঠিকভাবে জানা যায়নি। কেউ কেউ বলেন সমাধিটি সেই হাকিমের আবার কেউ কেউ বলেন সমাধিটির বেগমের বিশ্বস্ত এক অনুচরের।প্রায় আড়াই শত বছর আগের ঘটা ঘটনার অমীমাংসিত রহস্য আজও মুর্শিদাবাদের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায়। আজিমুন্নেসা বেগমের মসজিদটি প্রবল ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যায়, তবে এর কারুকার্য করা একটি দেওয়াল এখনো বর্তমান। এই মসজিদটির সঙ্গে মুর্শিদকুলি খাঁ এর নির্মিত কাটরা মসজিদ এর অনেক মিল পাওয়া যায়।
১৯৮৫ সালে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই ভগ্নপ্রায় মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেন। এবং তারপরেই এটিকে সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ১৭৩৪ সালে নির্মিত এই মসজিদটিতে ঠিক কবে যে আজিমুন্নিসা বেগম কে জীবন্ত সমাধি দেয়া হয়েছিল তা ইতিহাস মনে রাখার প্রয়োজন মনে করেনি। তাই তার মৃত্যুর সঠিক সময় টি আমাদের অজানাই রয়ে গেছে। এখন মুর্শিদাবাদের মহিমাপুরে আজিমুন্নেসা বেগমের জীবন্ত সমাধি দর্শনে আসেন বহু মানুষ। তাদের চরণ স্পর্শে বেগমের মুক্তিলাভ ঘটেছে কিনা জানা নেই তবে তার জীবদ্দশায় তার করা কুকীর্তির কথা শুনে সকলেই মনে মনে শিহরিত হয়ে ওঠেন এটা এক বাক্যে বলা যায়। আজিমুন্নিসার মৃত্যু নিয়ে আরও নানা গল্প-গুজব ও রহস্য রয়েছে। মৃত্যুর প্রায় তিনশো বছর পরেও রহস্যের অন্তরালেই রয়ে গেলেন আজিমুন্নিসা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।