ক্যাফে গল্পে মৌসুমী

মশারি

না , আগে থেকেই হাসার কিছু নেই । তলিয়ে ভেবে দেখুন , বাঙালীর সব কিছুই তো আজ উচ্ছন্নে যেতে বসেছে ! দুদিন বাদে আমাদের উত্তরপুরুষ বলবে , ওয়ান্স আপন এ টাইম , দেয়ার ওয়াজ এ জাতি কলড বাঙালী …..ওটা নিয়ে ভেবে কোনো লাভ নেই । কিন্তু সেই সাথে এটাও ভাবতে হবে , আজ যেমন হরপ্পা মহেঞ্জোদাড়ো সীলমোহর , সম্রাট অশোকের শিলালিপি , বুদ্ধের জাতক …..যা পড়েছি বলেই আমরা আজ পন্ডিতি করছি মহেঞ্জোদাড়োর মেয়েরা কেমন দেখতে ছিলো , বিম্বিসার এত আয়নায় মুখ দেখতেন কেন , বুদ্ধদেব রক্ত আমাশয় হয়ে মারা গিয়েছিলেন …..তাছাড়া আমার তো মনে হয় , রোজই একটা না একটা জায়গায় গাঁইতি মারা শুরু হয় , না হলে ইতিহাস বইগুলো প্রতি বছর এত মোটা হত না । আমরা যারা এই ফেসবুকে হাবিজাবি লিখি আর লোকের লাইক কুড়োই , কে বলতে পারে , আমাদের এই লেখা থেকেই একদিন বাঙালী কেমন ছিলো , এটা জানা যাবে না ? বইয়ের ওপর আর ভরসা করতে ইচ্ছে হয় না , কারণ একটা বর্ষার পর বই রোদে দিতে গিয়ে দেখলাম , খান তিরিশ বইয়ে ড্যাম্প , ভ্যাপসা গন্ধ , লম্বা লম্বা পোকা ছোটাছুটি করছে । এত যত্ন করেও যদি এই অবস্থা হয় , তবে ভবিষ্যতে কি হবে সেটা আর নাই বললাম । তাই হে বাঙালী , উঠেপড়ে লাগো …..নিজেদের ঐতিহ্য সম্পর্কে অবহিত হও ।
ছোটবেলায় দেখেছি সুতির সাদা মশারি । তার ভেতরে ঢুকে থাকলে কার সাধ্যি খোঁজে ? দাদুর খাটে মশারি খাটানো থাকলে আমরা তার ভেতরে গিয়ে লুকোচুরি খেলতাম । যেদিন সেই জগদ্দল মাল কাচা হত , সেদিন মা ঠাকুমার বিষতেতো মুখ দেখে আর কাছে এগোতে ভরসা পেতাম না ।
আপনারা ভাবুন তো , পরাশর মুনি মৎস্যগন্ধা সত্যবতীকে দেখে আকৃষ্ট হলেন …..মিলন প্রার্থনা করলেন । মুনিঋষিদের তো সবুর সইত না , তপস্যা করে করে একঘেয়ে হয়ে যেত কিনা ! তা , তিনি সেই নৌকোতেই মিলিত হলেন সত্যবতীর সাথে , আর যাতে কেউ না দেখতে পায় , তাই নৌকোর চারপাশে একটা কুয়াশার আবরণ তৈরী করলেন । এটা কী করে সম্ভব ? আমার তো মনে হয় , চুনো মাছ ধরার জন্য সত্যবতীর নৌকায় একটা পেল্লায় সুতির মশারি রাখা থাকত , বেগতিক দেখে সত্যবতী ওটা টাঙিয়ে নিয়েছিলেন । মেয়েরা সব সময়েই পুরুষদের চেয়ে প্র্যাকটিক্যাল কিনা ……তা , আমার এই থিওরি অ্যাপ্লাই করে দেখুন তো , অপছন্দ হয় কিনা ?
ওই সুতির মশারির ভেতর যথেষ্ট পরিমাণ হাওয়া ঢুকত কিনা সেটা মনে নেই , কারণ তখন শরীরে আশি কিলো মেদ কম ছিলো , অনিদ্রা কাকে বলে জানতাম না । সবাই জানতাম , এটাই স্বাভাবিক অবস্থা , এইভাবেই শুতে হয় , তা সে নবদম্পতিই হোক , বা ঘাটের মড়া ।
এর পর এলো নাইলনের নীল মশারি । মনে আছে , আমাদের বাড়িওয়ালার মেয়ের সাথে খেলতে গিয়ে ওদের খাটে প্রথম ওই মশারি টাঙানো দেখে অপলক হয়ে গিয়েছিলাম …..ভাবলাম , এরা কত বড়লোক ! নিচে নেমেই মায়ের কাছে বায়না ধরলাম । কিছুদিন পর আমাদেরও এলো ওই মশারি …..আহা , সে যেন স্বপ্ন ! মশারির মধ্যে ঢুকে মনে হল আলীবাবার গুহায় ঢুকলাম ! আর কী হাওয়া ! কে জানত , মশারির ভেতর এত হাওয়া পাওয়া যায় ? তখন ওই আদরের সুতির মশারি অবসোলিট ! কী হল সেগুলো , কে জানে । তার পর থেকেই ধারণা হল , শুধু গরীবরাই ওই মশারি টাঙায় ….আমরা এতদিন গরীব ছিলাম …..এখন বড়লোক হয়েছি ।
মশারি ছাড়া যে শোওয়া যায় , তা প্রথম জানলাম ফুলশয্যার রাতে । ফুলের মশারির ওপর আর আসল মশারি চাপাবার কাব্যহীনতা কেউই করেননি । তারপর অনেকদিন সংসার করা হয়ে গেলো , একদিন বাড়িতে আসা এক ফেরিওয়ালার কাছে দেখি বাংলাদেশী মশারি । তার যে কত কারুকাজ ! মুগ্ধ হয়ে কিনে ফেললাম ….বোধহয় খুব ঠকেও গেলাম , তাও ওই হালকা গোলাপীর ওপর লতাপাতা কাটা নেটের মশারি দেখে মনে হল হমীন অস্ত ! নিবু নিবু প্রেম আবার যেন রিনিউ হল কটা দিন । তবে ওই মশারি টাঙানো আর গোঁজার ডিউটিটা এলেই সব কাব্যি উড়ে যেত । খাটের ছত্রিতে শাড়ি , শার্ট , পেটিকোট ঝোলানো হত বলে একদিন রেগেমেগে ছত্রিগুলো খুলে নিয়ে ছুতোর মিস্ত্রীকে দিয়ে বললাম , সিঁড়ির রেলিঙের ওপর বসিয়ে দিতে । নিজের পিঠ নিজে চাপড়ানো যায় না , নাহলে এমন একটা ব্রেনওয়েভের পর সেটাই আমার করা উচিত ছিলো । যাই হোক , এদিকে মশারির দড়ি তো ছত্রির মাপে তৈরি ……এক দিক জানলার গ্রীলে , একদিক দেওয়ালের ক্যালেন্ডারের হুকে , একদিক দরজার ছিটকিনিতে ….এইভাবে ম্যানেজ করা হল , আর গেঞ্জির দড়িটা কোনদিকে , শাড়ির পাড়ের দড়িটাই বা কোন হুকে , সেটা শুধু আমিই জানতাম । ততদিনে মশারি তার সমস্ত রোম্যান্টিসিজম হারিয়ে বাঁশ হয়ে দাঁড়িয়েছে । কেবলই মনে হয় , দম আটকে আসছে । অগত্যা মশারি বাদ …এলো কচ্ছপধূপ । তাতে আবার আমার নিঃশ্বাসের কষ্ট ! মাঝে আর একটা মশামারা ধূপ এসেছিলো , সে এতই মোটা যে গুঁজে রাখার মত ধূপদানি পাওয়া যেত না …..আর তেমনি বিষাক্ত ধোঁয়া ! মশারা ভেতরেই থাকত , আমরা বাইরে বেরিয়ে হাঁপ ছাড়তাম ।
এখন তো টেনশন ফ্রি …..অলআউট , গুডনাইট হরেকরকম লিকুইড হামেহাল মজুত ! মাঝে আবার রুপো দেওয়া গুডনাইটও বেরিয়েছিলো ……আমার মেদের ওপর মেদ জমতে থাকা শরীরে স্বস্তি , মশারি টাঙানোর মত একটা থ্যাঙ্কলেস জব থেকে মুক্তি । তখন মাঝে মাঝে ওই ঘরের ভেতরে ঘর বানিয়ে দেওয়া সুতির মশারির জন্য মন কেমন করত । না কী ছেলেবেলার জন্য , কে জানে ? আর ওই নেটের মশারি !! মশাদের এত প্রকৃত বন্ধু আমি আজ পর্যন্ত দেখি নি । নতুন মশারি সাতদিন টাঙানোর পরই তাতে ইয়া ইয়া ফুটো হয়ে যেত …..মশারা “এবার কালী তোমায় খাবো ” গাইতে গাইতে মহানন্দে রক্ত চুষে ধানের মত পেট নিয়ে মশারির গায়ে বসে থাকত , হাঁটু গেড়ে বসে একটাকে মারলেই প্যাচ করে রক্ত হাতের তালুতে ……বড্ড ঘেন্না করত , নিজের রক্ত হওয়া সত্ত্বেও ।
কিছুদিন আগে বাড়ির পেছনের কুয়োতলায় গাছ লাগাতে গিয়ে দেখি , মশার কামড়ে পায়ে আমবাতের মত হয়ে গেছে । ঝট করে ছোটবেলাটা এসে গেলো সামনে । ওই ফুলোগুলো চুলকোতে আর হাত বুলোতে কী যে মজা লাগতো ! এখন আবার মশাগুলো কানের কাছে গান গায় বেশী …..কামড়ায় কম । তবে যেটুকু কামড়ায় , মোক্ষম ! ডেঙ্গু , ম্যালেরিয়া , সব নিয়ে ভ্যারাইটি স্টোরস খুলেছে । এবার মশার কামড়ে এইডসটা হলেই ষোলকলা পূর্ণ ! কত কি বিধিনিষেধ …..ডাবের খোলায় জল জমাবেন না , পরিষ্কার জমা জল ফেলে দিন , হ্যানো ত্যানো …..বিরক্তি লাগে বাপু ! মশাগুলো কবে থেকে এত স্মার্ট হয়ে গেলো , কে জানে ! তাই আমাদেরও বাধ্য হয়ে ওভারস্মার্ট হতে হচ্ছে …..আফটার অল , মানুষ বলে কথা ! কাঁহাতক ওই ক্ষুদেগুলোর কাছে হার মানা যায় ?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।