গল্পেরা জোনাকি -তে মৌসুমী বিশ্বাস

চামেলীর সংসার

চামেলী এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে হাত নেড়ে হীরা কে ডাকল। হীরা রিক্সা নিয়ে এগিয়ে এল। চামেলী রিক্সায় ওঠার পর রিক্সা চলতে শুরু করল।
রূপনারায়ণ পুরের ডাবর মোড়ে ছোট্ট একটা বাজার । এখানেই স্থানীয় লোকজন বাজার করতে আসে। যদি বেশি রকমের বাজার করার থাকে; তখন চিত্তরঞ্জন বাজারে যেতে হয়, নয়তো আসানসোল বাজারে । চামেলী সাধারণত ডাবল মোড় থেকেই দরকারি জিনিস পত্র কেনা কাটা করে । দরকার হলে চিত্তরঞ্জন বাজারেও যায় । সেখানে ভাই এর কোয়ার্টারে থেকে বাজার করতে সুবিধা হয় ।
চামেলী যখনই বাজারে আসে হীরার রিক্সাতেই আসে। উনি এখানকার স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের দিদিমনি। স্কুল লাগোয়া কোয়ার্টারে থাকে। কোয়ার্টারের পাশে মাটির ঘর করে হীরা পরিবার নিয়ে থাকে। স্কুলের ফাইফরমাস খেটে দেবে; এই শর্তে তাকে স্কুলের এরিয়ার মধ্যে থাকতে দেওয়া হয়েছে । স্কুলে ও কে সামান্য বেতন দেওয়া হয় । কিন্তু রিক্সা চালিয়েই মুলত ওর ঘর সংসার চলে।
আসা যাওয়ার পথে চামেলীর সাথে হীরার অনেক সুখ দুঃখের কথা হয়।
— হ্যাঁ রে হীরা, সামনেই তো পয়লা বৈশাখ; বাচ্চা দের কিছু কিনে দিলি!
— না দিদি, কোথা থেকে কিনব; হাতে একদম পয়সাকড়ি নেই।
— ঠিক আছে । আমি কিছু টাকা দিচ্ছি; বাচ্চা দের জামা কাপড় কিনে দিস।
— না দিদি, তা হবে না। আপনি আমাদের জন্য অনেক করেন। আমি আর নিতে পারব না।
— ধার নিবি! পরে শোধ করে দিবি!
— যদি না পারি!
— সে দেখা যাবেক্ষণ । এখন তো কাজ চালা!
হীরা আর কথা বাড়ায় না । জানে টাকা টা না নিলে দিদি খুব রাগ করবে।
তাছাড়া ঘরের ছেলে মেয়ে দুটো কে নতুন জামা দিতে না পারলেও মন খারাপ লাগবে।
কোয়ার্টারের সামনে এসে রিক্সা থামাল হীরা।
— কত দেব রে?
— দিদি, আপনাকে ভাড়া দিতে মানা করি; তবুও আপনি শোনেন না।
ওর কথায় পাত্তা দিল না চামেলী ।
— আগে যা ছিল ,তার থেকে নাকি ভাড়া বেড়েছে? কত দেব বল তো!
— দিন না দিদি; আপনি দশ টাকাই দিন।
চামেলী কুড়ি টাকার নোট ধরিয়ে বলল
— বারো টাকা কাটবি।
— না দিদি, দশ টাকা।
খানিক তর্ক বিতর্কের পর হীরা বারো টাকাই কাটতে বাধ্য হল।
হীরা জানে দিদি এ টা তাকে সাহায্য করল। গ্রামের গরিব মানুষ এ ভাবে দিদির কাছ থেকে অনেক সাহায্য পায়।
প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে চিত্তরঞ্জন বাজার থেকে নতুন জামাকাপড় কিনে চামেলী ছোট ছোট ভাইপো ভাইঝিদের উপহার দেন। খুব খুশি হয় ওরা । একমাত্র পিসির গলা জরিয়ে ধরে কত্ত আদর। পয়লা বৈশাখের আর বেশি দেরি নেই; বাজারে চৈত্র সেল দিচ্ছে । এখুনি কেনাকাটা সেরে রাখতে হবে ।
আজ রবিবার । স্কুল বন্ধ । চামেলী ঠিক করল আজ সকাল সকাল ভাই এর কোয়ার্টারে গিয়ে কেনাকাটা সেরে রাখবে।
গেটের সামনে এসে একটা জোরে হাঁক পারল চামেলী ।
— লক্ষ্মী- – – – – –
লক্ষ্মী হীরার বৌ। সকাল বেলা বাচ্চা দুটো কে মুড়ি চিনি শর্ষের তেল দিয়ে মাখিয়ে খেতে বসিয়ে দিয়েছে। দিদির ডাক শুনে সে তরিঘরি ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল।
— ডাক ছিলেন দিদি?
— হ্যাঁ রে , এই টাকা টা রাখ।
বলে তিন হাজার টাকা লক্ষ্মীর হাতে ধরিয়ে দিল। সে অবাক হয়ে হাতে ধরা টাকার দিকে তাকিয়ে রইল। সেটা লক্ষ্য করে দিদি বলল
— রাখ; হীরার সাথে কথা হয়ে গেছে । বাচ্চা দু’টো কে নতুন জামা কিনে দিবি। আর শোন , এখন আমি চিত্তরঞ্জন যাচ্ছি । ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে। ঘরের কাজ কর্ম করে চাবি টা নিজের কাছে রেখে দিবি।
চামেলীর কথা শেষ হতেই লক্ষ্মী বলল
— দিদি, প্রতিবার তো ভাই এর ওখান থেকেই বাজার করেন ; এবার আসানসোলে যান না! খুব ভালো চৈত্র সেল দিচ্ছে ।
বলে দোকানের একটা নাম বলল।
চামেলী র মনে কথা টা ধরল।
যাবে না কি একবার! একটুক্ষণ ভেবে বলল
— তাহলে যাই বল !
লক্ষ্মী দু’ পাশে মাথা নাড়ল ।
— হীরা কে বলছি; আপনাকে ডাবর মোর পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। বাসে করে সোজা আসানসোল বাজারে যেতে পারবেন।
আজ রোঁদ বেশ ভালোই উঠেছে। পরিষ্কার আকাশ রোঁদে ঝলমল করছে । গরম ও খুব একটা নেই।
বাস টা এসে থামল আসানসোল বাসস্ট্যান্ডে ।
হুরমুরিয়ে সব যাত্রী একসাথে নামবে। কে কার আগে নামবে তারি প্রতিযোগিতা চলছে। এতোক্ষণ যে যার আসনে ধৈর্য্য ধরে বসে গন্তব্যে পৌঁছানোর অপেক্ষা করছিল। গন্তব্যে পৌঁছাতেই সবাই অধৈর্য। চামেলী একপাশে সরে দাঁড়াল। আগে সবাই নামুক; তারপর সে নামবে।
সবার শেষে হাতে ব্যাগটা নিয়ে নেমে দাঁড়াল চামেলী । লক্ষ্মীর বলা নির্দিষ্ট দোকান টা চিনবে না; তাই একটা রিক্সা নিয়ে নিল।
চারতলা বড় দোকান । দোকানের এক জায়গায় সবাই নিজের ব্যাগ জমা রাখছে। চামেলী সোজা দোকানে ঢোকার জন্য পা বাড়াল। গেটে একজন দারোয়ান চামেলির পথ আটকে দাঁড়াল ।
— ম্যাডাম, আগে আপনার ব্যাগ টা ওখানে জমা করে আসুন।
বলে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ব্যাগ জমা করার জায়গা ।
চামেলী একটু বিরক্ত বোধ করল।
— এই ব্যাগে শুধু আমার মানি পার্স আছে। চেক করে নিতে পারেন।
দারোয়ান একটু ইতস্তত করে বলল
— ঠিক আছে । চেক করার দরকার নেই । আপনি ঢুকতে পারেন ।
দোকানের ভেতরে কত্ত লোক! বাইরে থেকে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছিল না । চারিদিকে কত পোষাক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ।
আজ ভাই এর জন্যও জামা কাপড় কিনবে। বিয়ের পর ভাইটা কে আর নতুন জামা কাপড় দেওয়া হয় নি।
ভাই টা যখন খুব ছোট ছিল; বাবার কাছে নতুন জামা কিনে দেবার জন্য শুধু বায়না করত। বাবা কিনে দিতে পারত না । বেতন বেশি ছিল না । চারজনের সংসার চালাতেই হিমসিম খেতেন। বাবার অসহায়তা চামেলী বুঝত। বাবা মা কে তাই কখনোই বিব্রত করত না । একটা জামা পড়েই কতদিন কাটিয়ে দিত। জামা ছিঁড়ে গেলে বলতে বলতে তিন চার মাস পর নতুন জামা আসত।
মেয়ে বড় হয়েছে; লজ্জা নিবারণের জন্য শরীরের আচ্ছাদন দরকার । বাবা বুঝলেও করার প্রায় কিছু ছিল না।
চামেলী সরকারি স্কুলে পড়াশোনা করত। স্কুল থেকে সরকারি পোষাক পেত। স্কুলে কি পরে যাবে তাই নিয়ে ভাবনা ছিল না । ঘরেও কতদিন স্কুলের ড্রেস পরে কাটিয়ে দিয়েছে ।
একবার খুব সাধ করে পঞ্চাশ টাকা খরচ করে একটা সালোয়ার কামিজ কিনে ছিল; নিজে টাকা জমিয়ে । সে টা পরে রোজ বিকেলে বান্ধবীর ঘরে যেত গল্প করতে । মাধ্যমিক দেওয়া দুই বন্ধু কত গল্প করত। মনে আছে বন্ধুর মা রোজ খেয়াল করার পর একদিন বলল
— চামেলী, তুই রোজ এই একটা জামাই পরে আসিস কেন রে। তোর কি আর জামা নেই!
সেই সময় চামেলী কোনো উত্তর দিতে পারে নি। আসলে কিছু কথার কোনো উত্তর ই হয় না! মানুষ কোনো কথা চিন্তা না করেই কত গুলো শব্দ উচ্চারণ করে ফেলে । যে শব্দ তীরের ফলার মতো মানুষের হৃদয়ে ফুটে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে পারে। শব্দ দিয়েই তো আসলে মানুষ চেনা যায়!
চামেলী দু’ টো ভাইপো ভাইঝির জন্য দু’ সেট করে জামা প্যান্ট কিনল। ভাইয়ের বৌ রেশমির জন্য কিনল একটা পিওর সিল্কের শাড়ি। ভাইয়ের জন্য কিনল জামা প্যান্টের পিস্। পিস্ কেনাই ভালো; রেডিমেড জামা যদি কেনার পর দেখে ছোট হয়েছে! আবার পাল্টানোর ঝামেলা। এতদূর বারবার আসা যাবে না।
ভাইয়ের জন্য নতুন কাপর দেখে ভাই খুব অবাক হয়ে যাবে। ভাইয়ের সেই অবাক করা মুখ মনে করে চামেলীর খুব হাসি পেল। ভাই অবাক হলেও আসলে ভেতরে ভেতরে খুব খুশি হবে; সে টা জানে চামেলী ।
দোকানের বাইরে বেরিয়ে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিল । খানিক হেঁটে রিক্সা নেবে। সামনে দেখল একটা ছেলে আর একটা মেয়ে পরস্পরের হাত ধরে গল্প করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে । চামেলী ওদের দিকে তাকিয়ে রইল ।
বান্ধবীর বাড়ি যাওয়ার পথে বিশ্ব দের বাড়ি পড়ত।
চামেলী দেখত রোজ বিশ্ব ওদের বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দু’ জনের চোখাচোখি হত; মুখে কোনো কথা হত না।
একদিন পরন্ত বিকেলে চামেলী নিজের ঘরে ফিরছিল । এখুনি সন্ধ্যা নেমে আসবে । বড্ড দেরি হয়ে গেল। গল্প করতে করতে এত টা যে দেরি হয়ে যাবে; দুই বন্ধুর কেউ বুঝতে পারে নি । সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে থাকা বাবা একদম পছন্দ করেন না । তাই তাড়াতাড়ি পা চালাল চামেলী । রোডের লাইট জ্বলে উঠল। চামেলী দেখল মোড়ের মাথায় শিমুল গাছটার তলায় বিশ্ব ওর বাহন সাইকেল টা তে ভড় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । কাছাকাছি আসতে হঠাৎ বিশ্ব বলে উঠল
— চামেলী, একটা কথা ছিল!
গলাটা কেমন কাঁপা কাঁপা লাগল না!
ভালো ছেলে বলতে যা বোঝায় বিশ্ব তাই। একমাথা ঘন কালো মেঘের মতো চুল, শ্যামবর্ণ গায়ের রঙ, মোটামুটি স্বাস্থ্যবান কলেজ পড়ুয়া গুড বয়। পড়াশোনা ছাড়া কিছু জানে না । ওর বাবা চিত্তরঞ্জন কারখানায় বেশ উচ্চ পদে কর্মরত । বিশ্ব কে মুখচোরা বলেই জানত । কিন্তু আজ বেশ ঘাবরে গেল চামেলী । ও ততোধিক কাঁপা গলায় বলল
— এখন আমি দাঁড়াতে পারব না । সন্ধ্যা হয়ে গেছে । ঘরে ফিরতে হবে । বাবা নয়তো খুব বকবে। পরে বলিশ।
সেই সময় যুবতী মনে বাবা মা অনেক টা প্রভাব বিস্তার করে থাকত। চামেলী দি র মনেও তাই ছিল।
কিন্তু আর কোনো দিন শোনাই হল না বিশ্বর কথা ।
কিছুদিন পর বিশ্ব ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে দিল্লি চলে গেল। চাকরি পেল। তারপর যখন ফিরে এল ; তখন চামেলী কে দেখেও দেখল না । না, চামেলীর তারজন্য কোনো কষ্ট হয় নি । ওই তো সেদিন বিশ্বর কথা শোনে নি!
ধীরে ধীরে চামেলীরো জীবনে পরিবর্তন এল। ট্রেনিং নেওয়া; প্রাইমারি স্কুলে জয়েন করেও চামেলী বদলালো না। ওর জীবনে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য এল ; কিন্তু এল না কোনো পুরুষ !
তখন বাবা রিটায়ার করেছেন । ভাই টাও চাকরি পায় নি । বাবার একার সামান্য পেনশনের টাকা তে সংসার চলে না । চামেলীর টাকাতে সংসার চলছে। মাথা গোঁজার ছোটখাটো একটা ঘর করার পর ; বাবার হাতে আর টাকাপয়সা নেই ।
সেই সময় কত জায়গা থেকে ওর বিয়ের জন্য সম্বন্ধ আসত। বাবা তো কোনো তদারকিই করেন নি! বাবা মা কি স্বার্থপরের মতো সেই সময় চামেলীর বিয়ে দিতে চান নি!
অর্থ ছাড়া মানুষের জীবন চলে না । তাই জীবন চালাতে গিয়ে বাবা মা কেও স্বার্থপর হতে হয়।
আজ চামেলীর কোনো সংসার নেই । কোনো বন্ধুও নেই । যার সাথে নিজের সুখ দুঃখ ভাগ করে নিতে পারবে। এটা তো সত্যি– আনন্দ বিলিয়ে দিলে আনন্দ বেড়ে যায়; দুঃখ বিলিয়ে দিলে দুঃখ কমে যায় । জীবনের আনন্দ
দুঃখ কাকে বিলিয়ে দেবে সে; সে জন ই যে এল না ওর জীবনে।
জীবনের দুঃখ ভোলার চেষ্টা করে ভাইয়ের পরিবারের মধ্যে ডুবে গিয়ে । যদি এখানেও আঘাত পায়! পারবে তো সে টা ভুলতে! তিপ্পান্ন বছর বয়সী চামেলী এ নিয়ে আর বেশি ভাবতে চায় না । যদি আঘাত আসে বুঝে নেবে। ততদিন ভাইয়ের সংসার নিয়ে আঁকরে থাক না!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।