যমুনার আজ বেশ দেরী হয়ে গেছে, প্রায় দৌড়তে দৌড়তে এতটা রাস্তা এসে হেঁসেলে ঢুকে পড়লো সে। বেলেগাছির এই প্রাথমিক ইস্কুলে তার প্রায় দুবছর হতে চললো। রান্নামাসি বলেই এখানে পরিচিত।
ইস্কুলের হেড দিদিমণি তাকে জোর করে এই কাজে ঢুকিয়েছিল। মেয়েটাকে পড়াতে দিতে এসে এই কাজ।বলতে লজ্জা নেই যমুনা কুসুমকে ভর্তি করেছিল, যতনা পড়ার জন্যে তার চেয়ে ঢের বেশী ওই মিডডে মিল।অন্তত একবেলা পেট ভরে ভাত আর ডাল,কখনো সয়াবিন, বা নিদেন পক্ষে ডিমের ঝোল তো জুটে যায়।আর তারই হাতে রান্না। আজ যে কুসুমের জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল গা, তাই তো দেরী হল।
হেড দিদিমণি দেরী দেখে বেশ ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ কিরে যমুনা আজ কি হল? আমি তো চিন্তায়.. ‘
‘ আমি তো জানি দিমুনি, আসলে কুসুমটার দুদিন ধরে ধুম জ্বর, একটু বাল্লি ছাড়া কিছুই, মেয়েটা কেমন ন্যাতা হয়ে, তাই আসলে.. আমি এখুনি চড়াই দিচ্ছি ভাত’ বলে তাড়াতাড়ি রান্নার জোগাড় করতে চললো।
ঝটপট হেঁসেলে ঢুকে চাল ধুয়ে ভাত বসিয়ে সবজি কেটে ফেললো সে, আজ তাহলে ডিম নেই, ভেবেছিল যদি মেয়েটার জন্যে একটু…
টিফিনের ঘন্টা বাজতেই হুড়মুড় করে ছেলেপিলের দল খাবার ঘরে থালা নিয়ে হাজির। প্রায় ২০০ টা খুদেরাক্ষস। আর বলবেই বা কি? গেরামে এই জন্যেই তো সব ছুটে ইস্কুলে আসে।একবেলা বাপ মায়ের ভাত দেবার চিন্তা তো নেই।
খাওয়া দাওয়া শেষ হলে আজ যেন তাড়াই করছিল সে, কোনরকমে রান্নার হিসেব বুঝিয়ে বেরিয়ে পড়লো ছুটে, সামনাসামনি কেউ ছিলনা, তাই কোঁচড়ে একটা পুরনো টিফিন কৌটোয় একটু ভাত আর তরকারি, এইটুক তো বেঁচেই গেছে, কুসুমটা..
হনহন করে বাড়ি ফিরছে সে, পথে কোনদিকে লক্ষ্য নেই, কুসুমকে একটু পেটে কিছু না দিলে, মেয়েটা মিশে গেছে বিছানায়।
ওমা! এ কি সব্বোনাশ হল গো। সাইকেল রিক্সাটা এমন ধাক্কা মারলে যমুনার হাত থেকে ছিটকে পড়লো কৌটোখানা আর সারা রাস্তায়, ভাতে, সবজিতে, ছিছি ছি। মা হয়ে সাবধানে চলতে পারলোনি। মেয়ের মুখের খাবারটুকু ! ওহ, মরণ হয়না তার। নিজেরই নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। চোখ ফেটে জল এলো। আবার খালি হাতে গিয়ে দাঁড়াবে, কচি মুখটার সামনে।
ঘরের কাছে আসতে যমুনার পা যেন সরছেনা। কান খাড়া করে শোনে, ভেতর থেকে মেয়ের গলা শুনছে যেন, কার সাথে কতা কয়?
দরজার কাছে এসে দেখে একখান সাইকেল রিক্সা, আরে এটাই তো তাকে ধাক্কা দিল,
ওমা গো, একি কাণ্ড! বাড়িতে হেড দিদিমণি যে… তক্তায় বসে মেয়েকে থালায় বেড়ে দেছেন, ভাত সয়াবিনের সব্জি, আর এমা এ যে একটা ডিম। কিন্তু আজতো ডিম…
‘ তোর অতো তাড়া, বললি কুসুমের জ্বর। তাই ভাবলাম,মেয়েটার মুখে কিছু দিতে হবে তো, তাই.. আমার আজ ডিম ছিল।মেয়েটা খাক, নাহলে উঠবে কি করে? তুই তো আর মিল থেকে আনতে পারবিনা’
দিমুনির কথায় ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো যমুনা, সে যে আজ মেয়ের জন্যে লুকিয়ে ভাত, হায় ঈশ্বর… চুরির ভাত, তাই তো ওপরওয়ালা এমন শিক্ষে দিল।
‘ আরে আরে কাঁদিস কেন? তোর কুসুম তো আমারও ছাত্রী, আমি কি তাকে? ‘
গলা তার কান্নায় আর লজ্জায় বুজে আসছে, ‘ দিমুনি আমি যে…’
‘ থাক তোকে আমি চিনি, মেয়েটাকে খাওয়া, আমি এলাম। কাল ঠিক টাইমে চলে যাবি, আমি কুসুমের মিড ডে মিলের ব্যবস্থা করে দেবো। ‘
হেড দিদিমণির রিক্সা দূরে চলে গেল, যমুনা ঘরের দোরে দাঁড়িয়ে শুধু একবার মেয়ের মুখে তৃপ্তির হাসি দেখে অজান্তেই মাথায় হাতটা ঠেকিয়ে কাকে যেন গড় করলে।