সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী – ১৩

|| ১৩ ||

তিনি কখনো ছাত্রদের suggestion , v.v.Imp. দিতেন না | অথচ আজকে মাস্টারমশাইদের একাংশ ‘Last minute suggestion’ বা ‘Sure success’ দিতে ব্যস্ত | তিনি বলতেন , ” বই এর প্রথম পাতা এমনকি উপরের মলাট থেকে আরম্ভ করে বই এর শেষ পাতা এমনকি শেষ মলাট পর্যন্ত যা লেখা আছে সবই Imp., V.Imp., এবং V.V.Imp. | তা না হলে কি লেখক আজেবাজে কথা লিখে বই বার করেছেন ? জানবে – ফাঁকি দিয়ে ভাল Result করা যায় না | ” ছেলেরা খুব পীড়াপীড়ি করলে Subject অনুযায়ী বই এর কিছু কিছু Chapter বলতেন , ” এগুলির উপর কম জোর দিলেও চলবে |”
প্রত্যেককে  Academic Qualification বাড়াতে উৎসাহ দিতেন | নিজে যতদূর পারতেন সাহায্য করতেন | কেউ ভালোভাবে পাশ করলে তার সাফল্য Notice বুকে লিখে সমস্ত ক্লাসে ঘুরাতেন |
কিন্তু স্বজনপোষণকে কোনোদিনও প্রশয় দেয়নি | তাঁর ভ্রাতুস্পুত্রের স্মৃতিচারণা তারই স্বপক্ষে প্রমাণ দেয় | ” ন- জ্যাঠামণি আমি Apply করবো নাকি ? ” ন-জ্যাঠামণি বললেন, ” অবশ্যই করতে পারো , কিন্তু মনে রেখো তোমাকে নিজের যোগ্যতায় মনোনীত হতে হবে , আমি এতটুকুও সাহায্য করবো না , পরিচয়ও দেবো না | ” তাই হল | যখন কলেজে অধ্যাপক হিসাবে মনোনীত হলুম , ন-জ্যাঠামণি বললেন , ” শেষে তুমিই হলে “! ইণ্টারভিউ বোর্ডে তিনি উপস্থিত ছিলেন এবং শুনেছি তাঁর নিজের ভোটটি দেওয়া থেকেও তিনি বিরত ছিলেন | “
তাঁর  Personality এমনই ছিল ছাত্র , শিক্ষক সকলে তাকে ভয় করে চলত | ভয় মানে Polite Personality র কাছে শ্রদ্ধা প্রদর্শন | অথচ স্কুলের বাইরে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ | শনিবার দিন ছেলেদেরকে তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে বারণ করতেন | ছুটির পর volley বল খেলা হতো | দোকান থেকে সিঙ্গাড়াও আসত | তিনিও মাঝে মাঝে শিক্ষকদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন | ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকদের খেলাতে তিনি রেফারি হতেন |
তিনি শুধুমাত্র পুঁথিগত পড়াশোনাতে বিশ্বাস করতেন না | চাইতেন সর্বাঙ্গীন বিকাশ | N.C.C. , সঙ্গীত- নাটক- আবৃত্তি , দেওয়াল পত্রিকা সবতেই ছিল তাঁর বাড়তি উৎসাহ | সেই উৎসাহের স্মৃতিচারণা করেছেন চাঁপাডাঙ্গার রবীন্দ্রমহাবিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের  অধ্যাপক ড: ফাল্গুনী গুপ্ত মজুমদার |  ” নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত আছি জেনে তিনি প্রতি শনিবার দুটোর পর ছাত্রছাত্রীদের  নিয়ে আমার জন্য একটি সাংস্কৃতিক ক্লাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন | সেখানে কবিতা , আবৃত্তি , স্বরচিত কবিতা পাঠ , নাটক পাঠ , নাট্যালোচনা , সংগীত চর্চা প্রভৃতি হত | আমাকে নিয়মিত সেই ক্লাস নিতে হত | প্রায় দিনই তিনি নিজে উপস্থিত থাকতেন | সিলেবাসের বাইরে , কলেজে এইরকম সাংস্কৃতিক ক্লাসের ব্যবস্থা কতজন অধ্যক্ষ করেছেন তা গোনা যায় | “
সামাজিক উৎসবগুলোকেও তিনি এড়িয়ে যেতেন না | বরং সবাইকে নিয়ে জড়িয়ে পড়তেন | গোরাচাঁদ দে মহাশয়  তাঁর প্রিয় শিক্ষক মহাশয়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এই প্রসঙ্গে বলেছেন , ” হোলির দিনে আমাদের সঙ্গে তাঁর হোলি খেলা আর বিকালে দোলের মেলায় যাওয়া দ্বীপাগ্রামে – রথযাত্রায়ও দ্বীপা গ্রামে যেতাম রথের মেলায় আর রথের উপর থেকে যখন জগন্নাথের প্রসাদ ফল -মূল জনসাধারণের উদ্দেশ্যে পঞ্চু গোঁসাই বা রাধু গোঁসাই ছুড়তেন   তখন আমাদের হেডমাস্টার মশাই ছাতাকে উল্টোভাবে খুলে ধরতেন – যাতে ‘প্রসাদ’ ছাতার মধ্যে পড়ে – তাই তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ‘ ছত্র ভোগ ‘ | “
হোলির দিনের আরো বর্ণনা পাই প্রাক্তন ছাত্র অদ্বৈত নাথ দে’র কলমে : ” সব থেকে মজার হত আমাদের হোলি উৎসবকে কেন্দ্র করে | ওইদিন আমাদের প্রিয় জ্যোতিদাকে মাঝে রেখে আমরা গোটা গ্রামে পরিক্রমা করতাম | ….ওনাকে কেউ পায়ে আবীর আবার কেউ গায়ে মাথায় আবীর দিয়ে রাঙিয়ে দিত | আবার মজা করে কেউ কেউ ওনার ভুঁড়িতে লাল আবীর দিয়ে রাঙিয়ে দিত | এমনকি বাড়ীর মায়েরা পর্যন্ত জ্যোতিদার পায়ে আবীর দিয়ে প্রণাম করত | তার সাথে নানারকম খাওয়া দাওয়া চলত | “
” দীর্ঘকায় জ্যোতির্ময় সন্ন্যাসী প্রধান শিক্ষক class ix খুলছেন , পর বছর class xও খোলা হয়ে গেল | স্কুলের শেষে প্রতিদিন এই সন্ন্যাসী গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে স্কুলের জন্য ভিক্ষা করে ঘুরছেন | পথেই জুটছে সঙ্গীদল | তারা বয়ে আনছে চাল , আলু , ধান , নারকেল এবং কী নয় ? ভিক্ষার জিনিস হাটে বিক্রি করে টাকায় পরিণত হচ্ছে | বিনিময়ে আসছে ইঁট , চুন , বালি , সিমেণ্ট | “
প্রধান করণিকের এই বর্ণনা যখন পড়ি তখন এই ত্যাগকে কুর্ণিশ না করে পারি না | ত্যাগ এই কারণেই বহুপূর্বে বেলুড় রামকৃষ্ণ মন্দিরের অধ্যক্ষের পদ ছেড়ে নামগোত্রহীন হুগলী জেলার দ্বারহাট্টায় এসে কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন |
তিনি কখনো যশের জন্য লালায়িত ছিলেন না | রামকৃষ্ণ বিদ্যামন্দিরের সাজানো বাগান ছেড়ে দ্বারহাট্টায় মানুষ তৈরির যে কর্মযজ্ঞ তিনি শুরু করলেন তাতে মনে হয় ব্রহ্মচারী মহারাজ গীতার নিঃষ্কাম কর্মযোগের সার্থক প্রতিনিধি | কোনো দিন তিনি প্রচারের আলোয় আসতে চাননি | তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনোওদিন তিনি বুকলিস্টে উল্লেখ করেননি | কারুর যোগ্যতা নিয়ে তিনি কখনো তির্যক মন্তব্য করেননি |
প্লেন লিভিং হাই থিকিং ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র | খাওয়া-পরার ব্যাপারে মানুষটির মধ্যে কোনো বিলাসিতা কোনোদিনও দেখা যায়নি | ডাল-ভাত আর দু’একটা শাকের তরকারীতে তিনি সদা সন্তুষ্ট | তাঁর পোশাক ছিল একটা ফতুয়া ও ভাঁজ করা ধুতি | কার্যপলক্ষ্যে কোথাও যেতে হলেও এই পোশাকের পরিবর্তন ঘটত না | তিনি তখন ‘দ্বারহাট্টা রাজেশ্বরী ইনস্টিটিউশন’ এর প্রধান শিক্ষক , অথচ বাস করছেন স্কুলের লাগোয়া মাটির ঘরটিতে | ছুটির দিনগুলোতে দেখা গেছে ঝাটা হাতে গামছা পরে ড্রেন পরিষ্কারের কাজে | সম্মান হানির ভয়ে তিনি কখনো কোনো কাজে বিরত হননি |
তিনি শুধুমাত্র সাধারণ নয় সাধারণের মতো জীবন যাপন করতেন এই সব কথা ধরা আছে দ্বারহাট্টা রাজেশ্বরী ইনস্টিটিউশন স্কুলের প্রা: শিক্ষক ননীগোপাল নন্দ মহাশয়ের স্মৃতিচারণায় | ” প্রায় প্রতিদিনই সকালে স্কুলের হোস্টেলে চলে আসতেন | সে এক অদ্ভুদ দৃশ্য | ছেলেরা লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে হাতে গ্লাস নিয়ে চা নেবার জন্য | উনিও তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে পড়লেন লাইন দিয়ে | কোনো একটি ছোট্ট ছেলে ছুটে গিয়ে কারও কাছ থেকে একটি এ্যালুমিনিয়ামের বা কাঁচের গ্লাস এনে তাঁর হাতে ধরিয়ে দিল | উনি লাইনে এগিয়ে চলেছেন | উনার পালা এলে তবেই চা ও বিস্কুট নিয়ে ছেলেদের সাথে গল্প করতে করতে পরম তৃপ্তি সহকারে সেই অতি সাধারণ চা খাচ্ছেন | “

( চলবে )

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।