• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্ত্তী – ২৪

দরদী

“কথামৃতে” ঠাকুর তিন প্রকার বৈদ্যের কথা বলেছেন | যাঁরা রোগীকে ওষুধের কথা বলে দিয়ে আর খোঁজ নেন না তাঁরা অধম বৈদ্য | যাঁরা ওষুধ খাওয়ার জন্য রোগীকে বোঝান তাঁরা মধ্যম বৈদ্য | আর যাঁরা দরকার বুঝলে রোগীর বুকে হাঁটু দিয়ে ওষুধ গিলিয়ে নেয় তাঁরা উত্তম বৈদ্য |
অধ্যাপক তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিক্ষক পাবর্তী বাবু ছিলেন এইরকম একজন উত্তম বৈদ্য | চেহারায় ছোটোখাটো , কিন্তু দাপটে দুর্দান্ত | শেখানোর ব্যাপারে এতটাই নিষ্ঠাবান যে কনসোন্যান্ট ( consonant ) শব্দটির বানান শেখাতে একমাস সময় নিয়েছিলেন | তিনি ঠিক করেছিলেন সব ছাত্র বানানটি না শেখা পর্যন্ত অন্য পড়া শেখাবেন না |
টেস্ট পরীক্ষার ফল জানতে লেখক কয়েকজন বন্ধু সহ স্কুলে এসেছেন | ভুবন বেয়ারা এসে খবর দিয়ে গেল , ” হেড স্যার তোমাদের ডেকেছেন | ” হেড স্যার গণেশ চন্দ্র দত্ত – দত্তপুকুর সংলগ্ন নিবাধুই হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক | ছাত্রকয়টি যথারীতি উপস্থিত | স্যার বললেন , ” তোরা তো এই তিনমাস শুধু ফাঁকি দিবি | তার চেয়ে এক কাজ কর – আমার বাড়িতে কাল থেকে বিকেল সাড়ে তিনটার সময় চলে আসবি | জায়গা কম – নইলে আরও ক’জনকে বলতাম | তোদের একটু পড়া দেখিয়ে দেব |”
অম্বুজ বাবু উল্লেখ করেছেন দেখিয়ে দেওয়া মানে সাড়ে তিনটে থেকে রাত আটটা পর্যন্ত সব সাবজেক্ট পড়াতেন , প্রশ্নোত্তর লেখাতেন | সেইসঙ্গে সন্ধ্যায় মুড়ি , চিঁড়ে , হালুয়া , ফলমূল – এক একদিন এক একরকম টিফিন দিতেন গুরুমা |
লেখকের বন্ধু আফসার কচি লাউ নিয়ে যাওয়ায় স্যার বলেছিলেন , ” কাল থেকে তোকে আর পড়াব না | ” আফসার তো কেঁদেই অস্থির | গুরুমার মধ্যস্থতায় সমস্যা মিটে গেল | ” ঘুষ নয় | শ্রদ্ধার সঙ্গে ওর মা পাঠিয়েছেন , আর তুমি তাঁকে অসম্মান করো না | আফসার দাও লাউটা | আমি নিচ্ছি | “
ছাত্রের জন্যই শহীদ | হ্যাঁ এ’রূপ শহীদ মাস্টার মশায়ের কথা শুনিয়েছেন শিশু সাহিত্যিক ও গবেষক পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় | মাস্টারমশায় প্রমদাচরণ সেন | সিটি কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক | ব্রাহ্ম হওযায় বাড়ি থেকে বিতাড়িত | বিবাহবর্জিত | না রইল ঘর , না সংসার | তাই ভালোলাগা, ভালোবাসা সবকিছুতেই ঐ ছাত্রকুল – ছাত্রকল্যাণ | প্রমদাচরণের মাথায় আসে ছোটোদের মনের মতো করে পত্রিকা প্রকাশের ভাবনা | সত্যি বলতে কী ছোটোদের মনের মতো পত্রিকা তখনো বের হয়নি | ক’দিনের মধ্যে পত্রিকার নাম কিভাবে লেখা হবে , টাইটেল পেজের লে আউট কেমন হবে – সব ঠিক | কিন্তু সমস্যা হল পত্রিকা প্রকাশের প্রয়োজনীয় টাকা আসবে কোথা থেকে ? বন্ধুরা টাকা দিতে রাজী নয় | প্রমদাচরণ দমলেন না | খাদ্যরুটিনে রাশ টানলেন | দুধ – মাছ খাওয়া বন্ধ হল | দু’বেলা জলখাবার খেয়ে খরচ বাড়ানো | তাই জলখাবারও বিদায় নিল | সেই টাকায় ১৮৮৩ র জানুয়ারিতে স্বপ্নের ‘ সখা ‘ বের হল | স্মরণ রাখতে হবে উপেন্দ্রনাথের প্রথম লেখা ‘ সখা ‘ তেই ছাপা হয় | ছাত্র অন্ত প্রাণ প্রমদাচরণকে খাদ্যরুটিন কাটছাট করে পত্রিকা প্রকাশের খেসারত দিতে হল | ক্ষয়রোগের কীট ততদিনে শরীরে বাসা বেঁধে ফেলেছে | মুখ দিয়ে রক্ত উঠছে | উপেন্দ্র কিশোর ও তাঁর সঙ্গীরা রাতের পর রাত জেগেও তাঁদের সাহিত্য গুরুকে বাঁচাতে পারেনি | পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায় , ” আত্মোৎসর্গ না বলে শহীদ হয়েছিলেন বললেই বোধহয় বেশি মানানসই হয় | “
“দুঃখেষ্বনুদ্বি-গ্নমনাঃ সুখেচ বিগতস্পৃহঃ ” – গীতার এই বাণীকে আমরা প্রত্যক্ষ করব বোধিসত্ব মৈত্রেয়ের স্মৃতিচারণায় |
হরিনাভি অ্যাংলো স্যাংস্ট্রিট স্কুল | হেডমাস্টার কিশোরীলাল ভাদুড়ি রোজকার মতো ক্লাসে এসেছেন | যথারীতি পড়াচ্ছেন | কিন্তু ছাত্রদের আজ মনে হল একটু বেশি গম্ভীর | তার প্রমাণ পড়ার মাঝে যে স্বপ্ন হাসির ছিটে – তার অভাব | ক্লাস শেষে তিনি চলে গেলেন | ব্যাপারটা ছাত্রদের বোধগম্য হল না |
সেকেন্ড পিরিয়ড় | সংস্কৃতের ক্লাস | এলেন আশুতোষ কাব্যতীর্থ | তিনিই দিলেন সেই বাজ পড়া খবরটি – “হেডমাস্টারের একমাত্র সন্তানটি গত রাত্রে মারা গেছে | কাল রাতেই তাকে দাহ করা হয়েছে | আমরা সঙ্গে ছিলাম | ”
ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেণ্ট | কলকাতার কোনো কলেজের সদ্য নিযুক্ত অধ্যাপক | বিয়ের সব ঠিকঠাক | বরযাত্রী হওয়ার কথা ছিল ফাস্টক্লাসের ছাত্রদের |
পণ্ডিত মশায় আরো জানালেন , ” আজ সকালে ট্রেনে ওঁকে দেখে আমরা অবাক | জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ আপনি এই অবস্থায় _’ তা উনি একটু হেসে বললেন – ‘ আমার তো একটি ছেলে নয় | অনেকগুলি | তাদের কাছেই আমার সান্ত্বনা | ‘ “
ছাত্রদের অপার বিস্ময় , “অসাধারণ মানুষ – হেডমাস্টারমশাই এর মুখে চোখে পুত্রশোকের ছায়া সেদিন কেউ দেখিনি | পড়ানোতে তাঁর এতটুকু শৈথিল্য নজরে পড়েনি | শোক তাপ জয় করা – কর্তব্যনিষ্ঠ এক অতুলনীয় চরিত্র |”
—————————————————————-
তথ্যপ্রাপ্তি :
১| আমার শিক্ষক , সম্পাদনা-বন্দনা দে , দে’জ পাবলিশিং , জানুয়ারি ২০১০
২| আমার শিক্ষক , সম্পাদনা-গৌতম বাগচি , পারুল প্রকাশনী, ২০১২
৩| শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত
৪| বর্তমান পত্রিকা

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।