সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী – ১৮

শিক্ষক ও শিক্ষকতার গল্প 

তিনি কখনো নিজের ইচ্ছাকে পুত্রের স্বাতন্ত্রিকতা রোধ করার উপায় হিসাবে ব্যবহার করেননি | স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ একথা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন | “তাঁহার জীবনের শেষ পর্যন্ত ইহা দেখিয়াছি , তিনি কোনোমতেই আমাদের স্বাতন্ত্র্যে বাধা দিতে চাইতেন না | তাঁহার রুচি ও মতের বিরুদ্ধে কাজ অনেক করিয়াছি – তিনি ইচ্ছা করিলেই শাসন করিয়া তাহা নিবারণ করিতে পারিতেন কিন্তু কখনো তাহা করেন নাই | যাহা কর্তব্য তাহা আমরা অন্তরের সঙ্গে করিব  এজন্য তিনি অপেক্ষা করিতেন | সত্য এবং শোভনকে আমরা বাহিরের দিক হইতে লইব , ইহাতে তাঁহার মন তৃপ্তি পাইত না – তিনি জানিতেন , সত্যকে ভালোবাসিতে না পারিলে সত্যকে গ্রহণ করাই হয় না | তিনি ইহাও জানিতেন যে , সত্য হইতে দূরে গেলেও একদিন সত্যে ফেরা যায় কিন্তু কৃত্রিম শাসনে সত্যকে অগত্যা অথবা অন্ধভাবে মানিয়া লইলে সত্যের মধ্যে ফিরিবার পথ রুদ্ধ করা হয় |”
পিতা দেবেন্দ্রনাথের উদারতার আরো কথায় আসব | তার আগে প্রাত্যহিক রুটিনটা শেষ করি | রবীন্দ্রনাথ লিখছেন , “ডাক বাংলায় পৌঁছিলে পিতৃদেব বাংলার বাহিরে চৌকি লইয়া বসিতেন | সন্ধ্যা হইয়া আসিলে পর্বতের স্বচ্ছ আকাশে তারাগুলি আশ্চর্য সুস্পষ্ট হইয়া উঠিত এবং পিতা আমাকে গ্রহ তারকা চিনাইয়া দিয়া জ্যোতিষ্ক সমন্ধে আলোচনা করিতেন |”
পাহাড়বাস কালে ছোট্ট রবির এই ছিল প্রাত্যহিক রুটিন | এবার প্রতিশ্রুত কর্মে মনোনিবেশ করি |
হিমালয় ভ্রমণকালে বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ বা মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের কোনো চিঠি এলে তা রবীন্দ্রনাথকেই পড়ে শোনাতে হতো | এর দুইটি কারণ রবীন্দ্রনাথ নির্দেশ করেছেন | এক – কিভাবে চিঠি লিখতে হয় সেই শিক্ষা লাভ | দুই – বাইরের এই সমস্ত কায়দা কানুন সমন্ধে শিক্ষা পিতা দেবেন্দ্রনাথ আবশ্যক বলে মনে করতেন |
চিঠির বিষয় নিয়ে কখনো কখনো পিতাপুত্রে তর্ক হতো | দেবেন্দ্রনাথ কখনো ধমক দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে থামাতেন না | ‘জীবনস্মৃতিতে’ এর উল্লেখ আছে | “আমার বেশ মনে আছে , মেজদাদার কোনো চিঠিতে ছিল তিনি ‘কর্মক্ষেত্রে গলদরজ্জু’ হইয়া খাটিয়া মরিতেছেন – সেই স্থানের কয়েকটি বাক্য লইয়া পিতা আমাকে তাহার অর্থ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন | আমি যেরূপ অর্থ করিয়াছিলাম তাহা তাঁহার মনোনীত হয় নাই | তিনি অন্য অর্থ করিলেন | কিন্তু আমার এমন ধৃষ্টতা ছিল যে সে অর্থ আমি স্বীকার করিতে চাহিলাম না | তাহা লইয়া অনেকক্ষণ তাঁহার সঙ্গে তর্ক করিয়াছিলাম |”
দেবেন্দ্রনাথ পুত্রের প্রতি কতখানি উদার ছিলেন রবীন্দ্রনাথের কলম বারে বারে তার প্রতি অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে | “যেমন করিয়া তিনি পাহাড়ে পর্বতে আমাকে একলা বেড়াইতে দিয়াছেন , সত্যের পথেও তেমনি করিয়া চিরদিন তিনি আপন গম্যস্থান নির্ণয় করিবার স্বাধীনতা দিয়াছেন | ভুল করিব বলিয়া তিনি ভয় পান নাই , কষ্ট পাইব বলিয়া তিনি উদ্ বিগ্ন হন নাই | তিনি আমাদের সম্মুখে জীবনের আদর্শ ধরিয়াছিলেন কিন্তু শাসনের দণ্ড উদ্যত করেন নাই | ” যে ঘটনার পেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথের এই কৃতজ্ঞতা স্বীকার সংক্ষেপে তার পরিচয় নেবার প্রয়োজন আছে | রবীন্দ্রনাথ পিতার প্রতি এক গুরুতর অভিযোগ জানাইলেন যে আদি ব্রাহ্ম সমাজের বেদিতে ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য বর্ণের আচার্য বসেন না , ইহা তাঁর কাছে অভিপ্রেত নয় | পিতা তখন তাঁকে প্রতিকার করবার আদেশ দিলেন | “বেশ তো যদি তুমি পারো তো ইহার প্রতিকার করিয়ো |” কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আদেশ পেয়েও প্রতিকারে সমর্থ হয়নি | কেন হয়নি সে অন্য কথা | এখানে শুধু দেবেন্দ্রনাথের উদার হৃদয়বৃত্তির কথাই উল্লিখিত হলো |
পুত্রের চরিত্র গঠনে পিতার মানসিক স্থিতির পরিচয় দিয়ে আর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করব | রবীন্দ্রনাথ একবার গোরুর গাড়িতে করে গ্র্যাণ্ডট্রাঙ্ক  রোড ধরে পেশোয়া পর্যন্ত যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করে | কিন্তু এ প্রস্তাব কেহ অনুমোদন করেননি | শেষে রবীন্দ্রনাথ পিতাকে তাঁর ইচ্ছার কথা জানালেন | পিতা নির্দ্ধিধায় বললেন , “এ তো খুব ভালো কথা ; রেলগাড়িতে ভ্রমণকে কি ভ্রমণ বলে | ” শুধু তাই নয় নিজের কথার সমর্থনে তিনি কিরূপে পদব্রজে , ঘোড়ার গাড়িতে ভ্রমণ করিয়াছিলেন সেই গল্প শোনাতেন এবং আশ্চর্যজনক ভাবে এইরূপ ভ্রমণে যে কষ্ট বা বিপদ ঘটতে পারে তার বিন্দুমাত্র উল্লেখ করলেন না |
দেবেন্দ্রনাথের চরিত্রের আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক্ হলো আত্মমর্যাদা বোধ | পিতাপুত্র যখন রেলযোগে বোলপুর হতে যাত্রা করে অমৃতসরে পৌঁছানোর কালে পথের কোনো একটি স্টেশনে একটি অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটল যাতে দেবেন্দ্রনাথের দেব মাহাত্ম্য সূচিত হলো | রবীন্দ্রনাথের হাফটিকিট দেখে স্টেশন মাস্টারের সন্দেহ হয় | কারণ রবীন্দ্রনাথের বৃদ্ধি বয়সের চেয়ে সামান্য বেশি ছিল | স্টেশনমাস্টার দেবেন্দ্রনাথকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন , “এই ছেলেটির বয়স কি বারো বছরের অধিক নহে | ” তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স এগারো | দেবেন্দ্রনাথও উত্তরে সোজাসুজি ‘না’ জানিয়ে দিলেন | তবুও স্টেশন মাস্টারের সন্দেহ গেল না | তিনি বললেন , “ইহার জন্য পুরো ভাড়া দিতে হইবে |” দেবেন্দ্রনাথ তক্ষণি নোট বের করে স্টেশন মাষ্টারকে দিলেন এবং ফেরত পাওয়া অবশিষ্ট টাকাগুলি প্ল্যাটফর্মের পাথরের মেঝের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিলেন | ঘটনাটির উপসংহারে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন , “টাকা বাঁচাইবার জন্য পিতা যে মিথ্যা কথা বলিলেন , এ সন্দেহের ক্ষুদ্রতা তাঁহার মাথা হেঁট করিয়া দিল |”
রবীন্দ্রনাথ একবার পিতার কাছ থেকে পুরস্কৃত হয়েছিলেন তা তাঁর জীবনে সুদূরপ্রসারী এক প্রভাব ফেলেছিল | ঘটনাটি অবশ্য হিমালয় যাত্রাকালে নয় | অনেক পরে | দেবেন্দ্রনাথ তখন চুঁচুড়ায় | রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ডাক পড়ল গান বাজনা করার জন্য | জ্যোতিদাদা বসলেন হারমোনিয়ামে | রবীন্দ্রনাথকে নূতন বাঁধা সবকটি গান গাইতে হলো | কোনো গানটি আবার দুবার | গান গাওয়া শেষ হলে দেবেন্দ্রনাথ বললেন , “দেশের রাজা যদি দেশের ভাষা জানিত ও সাহিত্যের আদর বুঝিত , তবে কবিকে তো তাহার পুরস্কার দিত | রাজার দিক হইতে যখন তাহার কোনো সম্ভাবনা নাই তখন আমাকেই সে কাজ করিতে হইবে |” পিতার কাছ থেকে এতবড়ো শংসা পাওয়া পুত্রের কাছে শুধু গৌরবের নয় , অতিবড়ো আনন্দের ব্যাপার | শুধু তাই নয় শংসাপত্রের সঙ্গে জুটল তৎকালীন সময়ে পাঁচশো টাকার চেক | সৃজনশীলতার বিকাশে এইরূপ প্রশংসা ও পুরস্কারের মূল্য অমূল্য | রবীন্দ্রনাথের পাওয়া সমস্ত পুরস্কারের মধ্যে পিতার কাছ থেকে পাওয়া পুরস্কারের উজ্জ্বল উপস্থিতি পরবর্তী রবীন্দ্রজীবনে থেকে গিয়েছিল |
( চলবে ) 
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।