সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী – ২৫

অপ্রতিষ্ঠানিক শিক্ষক

|| ২৭ ||

সূর্যগুরু দানধর্ম শিক্ষা দেন | “গুণৈর্গুণানুপাদত্তে যথাকালং বিমুঞ্চতি |” সূর্য নিজের আলোক রশ্মির দ্বারা পৃথিবীর জল আকর্ষণ করে এবং যথাসময়ে তা বৃষ্টিরূপে ফিরিয়ে দেন | সেইরূপ ইন্দ্রিয়াদি দ্বারা গ্রহণীয় বিষয় সকল উপযুক্ত সময়ে ত্যাগ করা কর্ত্তব্য | দান করা আমাদের অবশ্য কর্ত্তব্য | কারণ কবির ভাষায় , “প্রত্যেকে আমরা পরের তরে |” প্রজাপতি ব্রহ্মা তাঁর তিন সন্তান – দেবতা , মানুষ , অসুর প্রত্যেকের জন্যই একটিমাত্র বর্ণ “দ” উপদেশ করেছিলেন | মানুষ সেই “দ” এর অর্থ করল “দত্ত” | অর্থাৎ দান করো | স্বামীজি স্বার্থপর মানুষদের প্রতি খুব কঠোরভাষী | “যতদিন ভারতের কোটি কোটি লোক দারিদ্র ও অজ্ঞানান্ধকারে ডুবে রয়েছে , ততদিন তাদের পয়সায় শিক্ষিত অথচ যারা তাদের দিকে চেয়েও দেখছে না , এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে আমি দেশদ্রোহী বলে মনে করি | ……… যতদিন ভারতের বিশকোটি লোক ক্ষুধার্ত পশুর মতো থাকবে , ততদিন যেসব বড়লোক তাদের পিষে টাকা রোজকার করে জাঁকজমক করে বেড়াচ্ছে অথচ তাদের জন্য কিছু করছে না , আমি তাদের হতভাগ্য পামর বলি |”
কপোত গুরুর শিক্ষা এই – কারো প্রতি আসক্তি থাকা উচিত নয় | কারণ তার ফলে বুদ্ধি স্বাতন্ত্রিকতা হারায় এবং ক্লেশের সম্মুখীন হয় |
কোনো এক জঙ্গলে এক কপোত কপোতী তাদের দুটি বাচ্চা নিয়ে এক বৃক্ষডালে বাসা বেঁধেছিল | একদিন বাচ্চাদের আহার সংগ্রহের জন্য তারা অন্যত্র গিয়েছিল | ফিরে এসে তারা বাচ্চাদুটিকে এক ব্যাধের জালে আবদ্ধ দেখল | কপোতী ভাবল তার হৃদয়ের অংশ জালে পড়ে আর্তনাদ করছে | সেও আর্তনাদ করতে করতে শাবকদের দিকে ছুটে গেলো এবং জালে বদ্ধ হলো | কপোত তার প্রাণাধিক প্রিয় শাবকগণ ও প্রিয় ভার্যাকে জালে আবদ্ধ দেখে শোকে বিহ্বল হয়ে বিলাপ করতে লাগল – “অতৃপ্তস্যাকৃতার্থস্য গৃহস্ত্রৈবর্গিকো হতঃ |” শেষে সেও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে জালে ঝাঁপিয়ে পড়ল | অথচ ব্রহ্মবাদিনী মদালসার শিক্ষা কী ? – “শুদ্ধোহসি বুদ্ধোহসি নিরঞ্জনোহসি / সংসার মায়া পরিবর্জ্জিতোহসি / সংসার স্বপ্নং ত্যজ মোহনিদ্রা |” “শ্রী শ্রী কথামৃতে” ঠাকুরের সেই চাষার গল্প – কোনো এক দেশে এক চাষা ছিল | অনেকদিন পর তার এক ছেলে হয়েছিল | পরে ছেলেটি আবার কলেরায় মারা যায় | বাড়ির সকলে শোকে কাতর | চাষার কিন্তু শোক নেই | নেই চোখে জল | পরিবারটি বললে, “তুমি নিষ্ঠুর – ছেলেটার জন্য একবারও কাঁদলে না |” চাষা উত্তর দিল , “কেনো কাঁদছি না বলব ? আমি কাল একটা ভারী স্বপ্ন দেখেছি | দেখলাম যে , রাজা হয়েছি আর আট ছেলের বাপ হয়েছি -খুব সুখে আছি | তারপর ঘুম ভেঙে গেল | এখন মহাভাবনায় পড়েছি – আমার সেই আট ছেলের জন্য শোক করব , না , তোমার সেই এক ছেলে হারুর জন্য শোক করব ?” এই যখন সংসারের স্বরূপ তখন কপোতের মতো সংসার জালে জড়িয়ে অধঃপতিত হওয়া মূঢ়তার পরিচয় | ঘটনাটির উপসংহারে ভাগবতে লেখা হচ্ছে , “যঃ প্রাপ্য মানুষং লোকং মুক্তিদ্বারমপাবৃতম্ | / গৃহেষু খগবৎ সক্তস্তমারূঢচ্যুতং বিদুঃ ||” মানব শরীর উন্মুক্ত দ্বার | এই মানব শরীর লাভ করেও যে কপোতবৎ নিজ ঘর গৃহস্থালিতেই আবদ্ধ থাকে , সে অনেক উচ্চে আরোহন করেও নিম্নগামী হয় |
নবম শিক্ষক অজগর | অজগর আহারের জন্য চেষ্টা করে না | আপনা আপনি যা জুটে যায় তার দ্বারাই দেহযাত্রা নির্বাহ করে | সুতরাং দেহযাত্রার জন্য প্রবল প্রচেষ্টা কর্তব্য নয় | চেষ্টা চরিত্র না করা ও প্রতিরোধ করা সত্ত্বেও দুঃখের ভোগ হয় | আবার সুখ সকলেই চায় , কিন্তু সুখ আসে না | সুতরাং সবই কর্মানুসারে | তাহলে ভাগবত রচয়িতা কি আমাদের চেষ্টা-চরিত্র করতে নিষেধ করেছেন ? তাহলে পৃথিবীর গতি রুদ্ধ হয়ে পড়বে মানুষ জাতটা জন্মানের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যাবে | ঋষি কখনোই তা বলতে পারেন না | তিনি শুধু আমাদের বাড়াবাড়িটা সামলে রাখতে বলেছেন | নচেৎ আমাদের তৃতীয় রিপুর প্রাবল্যে সুদীপ্ত সেনের দশা হবে | বাংলায় একটা প্রবাদ আছে ,”খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে কাল হলো তাঁতির এঁড়ে গোরু কিনে |” “যদৃচ্ছয়ৈবাপতিতং গ্রসেদাজগরোহক্রিয়ঃ |” – অজগর বৃত্তির ন্যায় বুদ্ধিমান পুরুষের উদাসীন থেকে তার দ্বারাই জীবন ধারণ করা উচিত |
সমুদ্র বর্ষাকালে বন্যার কারণে স্ফীত হয় না | আবার গ্রীষ্মকালে সংকুচিত হয় না | তেমনিভাবে বিবেকীপুরুষের জাগতিক পদার্থ বৃদ্ধিতে – “নির্ধনের ধন হলে দিনে দেখে তারা” এ অবস্থা হয় না | আবার জাগতিক পদার্থ হ্রাসে নিজেকে third person singular মনে করে না | অর্থাৎ “দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ | ( গীতা )
পতঙ্গ অবধূতের একাদশতম শিক্ষক | আগুনের রূপ দেখে পতঙ্গ আগুনকে আলিঙ্গন করতে ছুটে যায় এবং ঐ আলিঙ্গনই তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায় | সেইরূপ বিবেকের অসাবধানতায় “তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় ” – আবেগের ব্যাকুলতায় অপ্রিয় কার্যটি ঘটিয়ে থাকে এবং অধঃপতিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনে | অপ্সরা মেনকার রূপে মোহিত হয়ে বিশ্বামিত্র মুনি যোগভ্রস্ট হয়েছিলেন , সাধারণের আর কী কথা ! মহাত্মা তুলসীদাসজি বোধহয় তাই বলেছিলেন , “দিনকা মোহিনী রাতকা মোহিনী পলক পলক লই চুষে| দুনিয়া সব বাউরা হোকে ঘর ঘর বাঘিনী পোষে ||”
মৌমাছি অবধূতের আর এক শিক্ষক | সকালে পদ্মফুল ফুটলে তার গন্ধে আসক্ত হয়ে রস সংগ্রহে এমন মত্ত হয়ে পড়ে সন্ধ্যায় যখন পদ্মের পাপড়ি বন্ধ হয় মধুকরও সেখানে বদ্ধ হয়ে পড়ে | অধিক রসাসক্তির কী পরিণাম মধুকর গুরু হতে শিক্ষা পাওয়া যায় | আমরাও বিষয় রসে এতটাই আসক্ত যে , মরার সময় মুখ দিয়ে তেজপাতা -পাঁচফোড়নই বেরোয় ; ভগবানের নাম আর বেরোয় না |
হস্তীও অবধূতের একজন শিক্ষক | অতিরিক্ত স্পর্শাশক্তির বিষময় ফল সম্পর্কে হস্তীগুরু আমাদের শিক্ষা দেয় | স্পর্শমোহে অন্ধ হয়ে হস্তী দিগবিদিক্ জ্ঞানশূন্য হয়ে হস্তিনীর দিকে ছুটে যায় এবং তৃণাচ্ছাদিত গর্তে পড়ে মহাবিপদাপন্ন হয় | সেইরূপ বিবেকী পুরুষ বিচারের অসাবধানতায় নারী স্পর্শসুখ ভোগ করবার বাসনায় চরম বিপদের সম্মুখীন হয় | এর জন্য কত সম্মানীয় মানুষ কতভাবে হেনস্তার স্বীকার হচ্ছে গণমাধ্যমের সাহায্যে এ আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে | ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব আমাদেরকে এইজন্য বস্তুবিচার করতে বলেছেন | “বিচার করো সুন্দরীর দেহতেও কেবল হাড় , মাংস , চর্বি , মল , মূত্র এইসব আছে | এই সব বস্তুতে মানুষ ঈশ্বরকে ছেড়ে কেনো মন দেয় ? কেনো ঈশ্বরকে ভুলে যায় ?” (শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত)

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।