||  ১১ || 

সতীশচন্দ্রের চরিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো তিনি এক বিরল শিক্ষক | একথার উল্লেখ প্রবন্ধের প্রথমেই করেছি | কিন্তু এখানে উল্লেখ করব শিক্ষক হিসাবে কেন তিনি  বিরল | শিক্ষকতাকে তিনি কোন্ পর্যায়ে উর্ত্তীণ করতে পেরেছিলেন তা জানতে আমাদেরকে রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় নিতে হবে | ” …..সতীশ প্রতিদিনের ধূলিভস্মের অন্তরালে , কর্মচেষ্টার সহস্র দীনতার মধ্যে শিবের শিব মূর্তি দেখিতে পাইতেন , তাঁহার সেই তৃতীয় নেত্র ছিল | সেইজন্য এত অল্পবয়সে , এই শিশু অনুষ্ঠানের সমস্ত দুর্বলতা অপূর্ণতা সমস্ত দীনতার মধ্যে তাঁহার উৎসাহ -উদ্যম অক্ষুণ্ণ ছিল , তাঁহার অন্তঃকরণ লক্ষ্যভ্রস্ট হয় নাই | বোলপুরের এই প্রান্তরের মধ্যে গুটিকতক বালককে প্রত্যহ পড়াইয়া যাওয়ার মধ্যে কোনো উত্তেজনার বিষয় ছিল না | লোকচক্ষুর বাহিরে , সমস্ত খ্যাতি -প্রতিপত্তি ও আত্মনামঘোষণার মদমত্ততা হইতে বহুদূরে একটি নির্দিষ্ট কর্মপ্রণালীর সংকীর্ণতার মধ্য দিয়া আপণ তরুণ জীবনতরী যে শক্তিতে সতীশ প্রতিদিন বাহিয়া চলিয়াছিল , তাহা খেয়ালের জোর নয় , প্রবৃত্তির বেগ নয় , ক্ষণিক উৎসাহের উদ্দীপনা নয় – তাহা তাঁহার মহান আত্মার স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপরিতৃপ্ত শক্তি | ” ১৮   
এযেন গীতাবাক্যের পূর্ণ প্রতিফলন : ” কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেসু কদাচন | / মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মাতে সঙ্গোহস্ত্ব কর্মণি | “
শিক্ষক হিসাবে তিনি রবীন্দ্রনাথের পূর্ণ আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন | পুত্র রথীন্দ্রনাথের শিক্ষার ভার সতীশচন্দ্রের উপর দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পেরেছিলেন কবি | সতীশচন্দ্র ছিলেন জাত শিক্ষক | ভগবান তাঁকে শিক্ষক করেই ধরাধামে পাঠিয়েছিলেন | রবীন্দ্র ভাবনার সার্থক রূপায়ণ সতীশচন্দ্র | রথীন্দ্রনাথের সুখস্মৃতিতে ধরা আছে সেসব খণ্ডচিত্র | ” সতীশ রায় ছিলেন উদারচেতা , ভেদাভেদজ্ঞান তাঁর ছিল না | তাঁর কাছে আমি কেবল বয়সে নয় , বিদ্যাবুদ্ধিতে নিতান্ত অর্বাচীন হলেও তিনি আমার সঙ্গে সমবয়সী বন্ধুর মতো ব্যবহার করতেন , তাঁর জ্ঞানভাণ্ডার আমার কাছে উদঘাটিত করে দিতেন | দিনের বেলায় লাইব্রেরির এক কোণের ঘরে দরজা-জানলা বন্ধ করে তিনি আমাকে ও সন্তোষকে পড়াতেন কালিদাস ও শেকসপিয়র | তাঁর পড়াবার এমন ধরণ ছিল , কঠিন সাহিত্য পড়ছি  বলেই মনে হতো না | সতীশচন্দ্রের মতো শিক্ষক বিরল | গ্রীষ্মের ছুটির মধ্যে রাত্রে শান্তিনিকেতনের উন্মুক্ত মাঠে বেড়াতে গিয়ে কত রাত কেটে যেত শুয়ে শুয়ে সতীশবাবুর কণ্ঠে বাংলা কাব্য শুনতে শুনতে | একে একে গ্রহমণ্ডলী ম্লান হয়ে পশ্চিমের মাঠের শেষ সীমান্তে অন্তর্হিত হচ্ছে , সতীশ রায়ের উৎসাহের তবু বিরাম নেই , শ্রান্তি নেই , কবিতার পর কবিতা অবলীলাক্রমে আবৃত্তি করে যাচ্ছেন | তাঁর উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে আমারও চোখে ঘুম নেই , মুগ্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছি | তিনি এমনি আত্মহারা হয়ে , ভাবে মাতোয়ারা হয়ে আবৃত্তি করতেন যে , কবিতার অন্তরের রহস্য আমার কাছে উজ্জ্বল হয়ে প্রকাশ পেত , রচনা যতই কঠিন হোক না কেন তার মমার্থ বুঝতে কষ্ট হত না | ” ১৯ এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন কবিপুত্র – যাতে তাঁর জাত শিক্ষকতাকেই প্রমাণ করে | ” স্রস্টা কবি যেভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে কবিতা লিখেছিলেন সতীশবাবু যেন সেই ভাবকেই আমার কাছে মূর্তিমান করে তুলতেন | ” ২০
সতীশচন্দ্রের কবিত্বশক্তি , সাহিত্যরচনা , শিক্ষকতা , প্রকৃতিপ্রেম প্রভৃতির সঙ্গে মনুষ্যত্বের মূর্তিমান বিগ্রহ ছিলেন | তাঁর মানসিক স্থিতি কোন্ জায়গায় বাঁধা ছিল তা ভাবলে অবাক না হয়ে পারা যায় না | বন্ধু অজিতকুমার ভৃত্যের নির্বুদ্বিতায় অসহ্য হয়ে তিরষ্কার করেছিলেন | সতীশচন্দ্রের বুকে তা বড়ো বেজেছিল | এই প্রসঙ্গে সতীশচন্দ্রের  উক্তি প্রণিধানযোগ্য | অজিতকুমার জানালেন, ” ওর নির্বুদ্ধিতা অসহ্য | ” সতীশচন্দ্র বললেন , ” তা হোক | বহু পুরুষ ধরিয়া উহাদের দাস করিয়া রাখিয়া আমরা উহাদের সেবা আদায় করিতেছি , আমাদের চাপেই উহাদের মানসিক শক্তি দুর্বল হইয়া গিয়াছে | আমরা যে মানুষ ওরাও তাই – আমরা কিছু উহাদের প্রভু নই ; ওরা যে সব কাজ করিয়া দেয় আমরা বিনিময়ে বেতন দিই , এই পর্যন্ত | ” ২১
আমাদের এমনই দুর্ভাগ্য যে সতীশচন্দ্রকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি – বিধাতা তাকে আপন অঙ্কে স্থান দিয়েছেন | কবিগুরুর বাণী দিয়েই লেখাটি শেষ করব – যা সতীশ চরিত্রটিকে আরো উজ্জ্বল করে |
” সতীশের জীবনটুকু আমাদের বিদ্যালয় এবং আমাদের সাধনার সঙ্গে জড়িত হয়ে গেছে | ” ২২
তথ্যপ্রাপ্তি :
১| রবীন্দ্র অনুব্রতী সতীশচন্দ্র রায় , সম্পাদনা পুলিন বিহারী সেন ও অনাথনাথ দাস , পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, মাঘ ১৪১১, পৃ: ১৩ |    ২| ঐ , পৃ: ৯৯.  ৩| ঐ, পৃ: ৬  ৪| ঐ , পৃ: ৭   ৫| ঐ , পৃ: ১৫৩  ৬| ঐ, পৃ: ১৫৪. ৭| ঐ, পৃ: ৭  ৮| ঐ, পৃ: ১৭৪-৭৫  ৯| ঐ, পৃ: ১৭৬  ১০| ঐ, পৃ: ১৭০-৭১  ১১| ঐ, পৃ: ১৭৪  ১২| ঐ, পৃ: ৬  ১৩| ঐ, পৃ: ১০১  ১৪| ঐ, পৃ: ৯৭  ১৫| ঐ, পৃ: ১৭ ১৬| ঐ, পৃ: ৯৯   ১৭| ঐ, পৃ: ১০৭-১০০৮  ১৮| ঐ পৃ: ৭-৮  ১৯| ঐ, পৃ: ১৭৮-১৭৯  ২০| ঐ, পৃ: ১৭৯  ২১| ঐ, পৃ: ১৭১  ২২| ঐ,পৃ: ১৫৬