গল্পকথায় মহুয়া দাশগুপ্ত

শিক্ষকতা করেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। একাধিক সংকলনে তাঁর গল্প ,কবিতা , প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এই বছর অরণ্যমন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একক গল্প সংকলন —‘ কথানদীর কূলে’। গল্প বলার ঐতিহ্য নিয়ে বর্তমানে কাজ করছেন তিনি।

অনাচার

‘আদিখ্যেতা দেখে বাঁচি না!’ বড় বঁটিতে মাছের মুড়ো দু টুকরো করতে করতে ঝনঝনিয়ে উঠলো বাড়ির দুই প্রজন্ম ধরে থাকা বুড়ি ঝি। এতবছর ধরে বুড়ো বটগাছের মতোন রয়েছে এই হালদার বাড়িতে। এখন তার কথারও গুরুত্ব আছে। বাড়ির ছেলেরা মান্যিগন্যি করে। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। ছেলের বৌরাও! মোক্ষদামাসি বলতে সকলে অজ্ঞান। অমন ভালো করে চা করতে,মুড়ো দিয়ে ডাল করতে কে পারে বলো তো? বাপ্পা , ছোটন আর বুড়ি , মানে এই বাড়ির তিন ছেলেমেয়েকে তো সেই কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। বাড়ির কর্তা গিন্নী তো এই মোক্ষদার হাতে সংসার ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ান। বুড়ির বিয়ে হয়েছে দক্ষিণ ভারতে। ওখানে যান মাঝেসাঝে । বাপ্পার বৌ ঘরে থাকে। কাজ কর্মে হাত লাগায়। মেয়ে ভালো। বোকাসোকা!ঢলঢলে মুখখানা! ছোটনের বৌটা বেশ ঢ্যাঁটা। চাকরি করে। মটমট করে বাইরে ঘোরে। পয়সার গরম আছে। কালেভদ্রে রান্না ভালোই করে। তা অমন কুটেবেটে দিলে সকলেই পারে করতে। মেয়েমানুষের অত চাল ভালো নয়। এইসব ভাবতে ভাবতে রাগে শরীর গরম হয়ে যায় মোক্ষদার । ছোটন যদি নিজের ছেলে হতো, তাহলে গলা ফেঁড়ে বলতো মোক্ষদা ,‘ তুই একটা ভেড়া। ’ বাপ মাও বলে আড়ালে! ভদ্দরলোক তো। মোক্ষদাকে বলে,‘ অজাত কুজাতের মেয়ে এলো সংসারে। জ্বলে পুড়ে গেলাম। ’ জ্বলারই তো কথা। মেয়ে সভা সমিতি করে বেড়ায়। সমাজসেবা! আরে বাড়ির কুটো না নেড়ে কীসের সেবা রে ? মেয়েছেলের বিয়ে হলে, বাচ্চা হলে আর কীসের কাজ? যত ধিঙ্গি এসে জুটেছে। মোক্ষদা কাজ সেরে হাত ধুয়ে বসে ভাবে, এই মেয়েছেলেগুলো এসেছে দুদিন। ওদের কত আর টান হবে? মোক্ষদা আজ কুড়ি বছর এ বাড়িতে। কর্তা গিন্নী তখন জোয়ান। সেসব দিন! ভাবলেই কেমন ঘোর লাগে মোক্ষদার। আজ বাড়ির মধ্যে এত অনাচার সহ্য হয় না।
হয়েছে কী, ছোটনের ছেলের সামনে অ্যানুয়াল পরীক্ষা । ওর মা সভা সমিতি করলেও ছেলেকে নিয়ম করে পড়ায়। কিন্তু এবছর হঠাৎ দেওঘরের টিকিট কেটে বলছে,‘ দুদিনের জন্য ঘুরতে যাবে। একা! বাড়ির সকলে তাজ্জব। ছেলে কাঁদছে। ছোটন কথা বন্ধ করে দিয়েছে। অসুস্থ শ্বশুর শাশুড়ির মুখ ভার। কিন্তু ওই দজ্জাল মেয়েছেলে যাবেই। করেটা কী? ওই ছেলে পড়ানো ছাড়া? এবার যখন কর্তা গিন্নীর অ্যাক্সিডেন্ট হলো, দুজনেই মরো মরো! সে তো তখন কোন অনাথ আশ্রমের কাজে মাদ্রাজে। ফিরলো যখন, ততদিনে ওরা সুস্থ। বড় বৌ, দুই ছেলে আর মোক্ষদা মিলেই তো সব করলো। বাড়িটাকে আপন ভাবলে , তবে তো ফিরবে। মোক্ষদা জানে , সব গা বাঁচিয়ে চলা। সাধে কি ছোটনের অন্য মেয়েদের প্রতি টান! অমন বৌ হলে পুরুষমানুষদের একটু ছুকছুকুনি হয়। এখন তো ছেলেকেও মানছে না। কোনো নাগর জুটিয়েছে কীনা কে জানে! মোক্ষদা আজ গিন্নীমাকে বলেছে,‘ আমার ছেলের অমন বৌ হলে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় করতাম। ’
ট্রেনের জানালা দিয়ে দখিনা বাতাস এসে চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে ছোটনের বৌয়ের। এমনিতে ওর নাম রঞ্জনা চ্যাটার্জী। অনাথ বাচ্চাদের জন্য গোটা ভারতবর্ষে ছুটে বেড়ায়। ওর এন জি ও ‘ আদিত্য’! সূর্যের নামে নাম রেখেছে। নিজে জ্বলে পুড়ে সকলকে আলো দেখায় সূর্য ! ঠিক ওর মতোন। অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল চার্ট অনুসারে রঞ্জনা রবির জাতক। বাইরে অনেক কর্মপ্রবাহের আলো আর ঘরে সম্পর্কগুলো কেউ ওকে বোঝে না। রোজ পুড়তে পুড়তে এখন জ্বালাপোড়াও হয় না। ওর বরেরও এখন ওকে দরকার নেই। দেওঘর পৌঁছেই লজে গিয়ে একটু শুয়ে নেবে। কাল ভোররাতে বেরোতে হবে সেই কাজে, যার জন্য ছেলেটাকে কাঁদিয়ে এলো। পরীক্ষা হয়তো এবার খারাপই দেবে ওর ছেলে। কিন্তু তবু! কাজটা জরুরি। কাজটা না করলে শান্তি পেতো না মনে!
পরেরদিন ভোরবেলা স্নান সেরে পুজোর ডালি নিয়ে বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গের কাছে রঞ্জনা যখন এগিয়ে চলেছে, তখন ওকে দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না, কোন পরিস্থিতি পেরিয়ে এখানে এসেছে সে। আসলে শ্বশুর শাশুড়ির দুজনের মস্ত বড় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিলো। ও তখন ভেলোরে। একটা অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের নিয়ে মেডিক্যাল চেক আপে এসেছিলো। ফিরতে পারে নি সঙ্গে সঙ্গে। শুধু একমনে ঠাকুরকে ডেকে গেছে বুড়োবুড়ির সুস্থতার জন্যে। রাতে ঘুমায় নি। বাড়ির দুটো বটগাছের অসুখ বলে , বড্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। ও জানে, বাড়িতে কেউ মন থেকে ওকে নিজের ভাবে না। কেউ তো ওকে পছন্দ করে ডেকে আনে নি এই বাড়িতে। ও তো একসময় শুধু ওর বরেরই পছন্দ ছিলো। এখন তো——! রঞ্জনা ছোটনের বিরক্ত , উদাসীন মুখটা ভেবে বুকের ভিতরের টনটনানিটা টের পায় আবার। এন জি ওর কাজ আর ওর ছেলে — এই দুটো জায়গাতে নিজেকে খুঁজে পায় রঞ্জনা। কিন্তু ও ভালোবাসে ওর পরিবারকে। বাড়ি ফিরে যখন দেখে সকলে রয়েছে, হাসছে , চা খাচ্ছে, কথা বলছে — ওর ভালো লাগে। যেমন ওদের বাড়ির গন্ধরাজ ফুলের গাছটা সবাই আছে বলে খুশিতে মাথা দোলায়, ওর তেমন ভালো লাগে। ও একটু অন্যরকম। জোর করে নিজেকে কারো মনে বসাতে পারে না। তাই দূরে দূরে থাকে। আসল জায়গায় ভালোবাসার শিকড়টা উপড়ে গেছে তো! তাই বুঝি ও এমন ছন্নছাড়া । আলগা!
বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ খুব জাগ্রত। সকলে বলে! তাই ওদের বিপদ শুনে মানত করেছিলো রঞ্জনা। বাড়ি ফিয়ে সাতদিনের মধ্যে পুজো দিতে আসবে শ্বশুর শাশুড়ির জন্য। কাউকে বলে নি। যখন মোক্ষদা মাসির সঙ্গে বসে সকলে ওর দায়িত্ববোধহীন ব্যবহারের কথা, স্বেচ্ছাচারের কথা বলছিলো , তখনো না। কারণ ও জানে কেউ বিশ্বাসই করবে না। রঞ্জনা এখন আর কাউকে কিছু বলে না। মনে মনে একটা প্রবল শক্তির কাছে নত হয় শুধু। ওর মনের সব শুভেচ্ছা দিয়ে শুধু বলে,‘ সবার ভালো হোক। ’আজ তাই পুজো দিতে এসেছে চুপি চুপি। ওর পরিবারের জন্য। প্রসাদী ফুলটা সঙ্গে রাখে। প্রসাদ বিলিয়ে দেয় কয়েকটা বাচ্চাকে। মনে মনে একটু জোর পেয়ে আবার ফিরতি ট্রেনে ওঠে। এই গোপন কথাটা মনের গোপনতম কুঠুরিতে তালা আটকে রেখে দেয়। ঝমঝমিয়ে ট্রেন ওকে নিয়ে যায় সেই বাড়িটার দিকে যেখানে মোক্ষদা হাত নেড়ে তখন বলছে,‘ অমন বৌয়ের মুখে আগুন!’রঞ্জনার শাশুড়ি শ্বশুরের দিকে চেয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলছেন,‘ সবই আমার কপাল। ’আর রঞ্জনার শ্বশুর বিরক্ত হয়ে ভাবছেন—‘ অনাচার, অনাচার !’
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।