T3 শেষের কবিতায় মৌমিতা দত্ত

মাদল

আজ সেই দিন, পৌষ সংক্রান্তি।
অফিসে ছুটি নিয়ে বোলপুর গেছিলাম সেবার ,এই দিনে।
২০১৭ সাল এর কথা।
হোটেলে পৌঁছালাম –
তখন প্রায় রাত দশটা।
সর্বসাকুল্যে ছুটি জুটেছিল কপালে সাড়ে পাঁচ দিন।
কর্পোরেট লাইফে এটাই অনেক ।
ফিরে খুব ক্লান্ত লাগছিল ,
ঘুমিয়ে গেছিলাম।
পরের দিন ঘুম কাটলো মাদলের শব্দে।
হালকা রোদ্দুর আবছা কুয়াশা মেখে
জানালার কাঁচ ভেদ করে
চোখে এসে পরছিল।
আলসেমি গায়ে জড়িয়ে
খুললাম দরজার শিকলটা।
একটা গরম নীল রঙের শাল নিয়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে ।
দেখলাম দুটি মেয়ে নাচছে সেই তালে।
অদ্ভুত ভালো লাগার একটা টান আছে এই ছন্দে ।
মনে হয়, জানি শিকড়ের সুর।
অনেকক্ষন কাটলো এই ভাবেই।
কখন ওদের সঙ্গে আমিও পা মিলিয়েছিলাম কে জানে!
একসঙ্গে চা খেলাম চারজনে তারপর।
একটা প্ল্যান করলাম
ঐ বাদক পুরুষটির সাথে
কথা হল যে –
সে এই আশেপাশের সব গ্রাম
আমায় ঘুরিয়ে দেখাবে এই ক’দিন।
আমি তেমন ভাবে গ্রাম দেখি নি।
হ্যাঁ দেখেছি ,ছুটন্ত বাস- ট্রেনের জানালার এপার থেকে আর
বাকিটা ছবিতে।
দুদিন ওর সাথে কত যে ঘুরেছি বলতে পারি না।
গ্রাম এত সহজ??
এর আগে বুঝতামই না।
এত সুন্দর ধান ক্ষেত , বিস্তৃত কোপাই নদী।
কালো মেয়ের মধুর চাউনি , এত কঠিন আয়ের পথ!
তবুও এত জৌলুস কালো চামড়াতে?
এত গন্ধ রাঙা ধূলোয় !!!
মোহন না থাকলে বুঝতাম না ।
মোহন ঐ আদিবাসী লোকটি
যে ছিল আমার ট্যুর গাইড।
তৃতীয় দিনে আমার শরীর টা খারাপ করছিল ।
শহুরে শরীর আফটার অল।
একটু ধকলেই রেস্ট চায়।
সেদিন মোহন কে বললাম আজ বেরোব না ।
তাকে চলে যেতে বললেও সে গররাজি হল।
বললাম বেশ বসো;
তাহলে গল্প বলো শুনি।
কত্ত গল্প , একনাগাড়ে বলে চলেছে…
সুন্দর বীরভূমের টান কথনে , গ্রাম্য নিকটতা, সারল্য অথচ শক্ত পুরুষ শরীর।
ক্রমে কেমন আস্তে আস্তে
ভালো লাগায় বিভোর হয়ে যেতে লাগলাম আমি।
বুঝতে পেরেও নিজের লাগাম রাখতে পারলাম না ।
কালো মখমলের পেটানো শরীরে ডুব দিলাম নিজের জ্ঞানেই।
কি তুমুল আকর্ষণ ঐ দেহে আর কথার যত্নে।
আমার কর্পোরেট জীবনের অহঙ্কার লুটিয়ে যাচ্ছিল প্রান্তিক ঠোঁটের কিনারে ।
পেন্সিল হিলের সূঁচালো আধুনিকতাকে পুঁতে ফেলছে
কাদা জলের মেঠো শরীর।
বিদেশী পারফিউম উবে যাচ্ছে
বুনো গন্ধে।
আটকাতে পারলাম না ।
হেরে গেলাম।
আমার ইচ্ছার কাছে সেও নতজানু হলো।
ভোগও ভাগ করে নিলাম ।
পরের দিনই খুব ভোরে
পালিয়ে এলাম আমার শহরে ,
নিজেকে কোনমতে গুটিয়ে।
আর দেখা হোক ওর সাথে আমি চাই নি।
ততক্ষণে এলোমেলো হয়ে গেছে
সবটা আমার।
এক মাস পর…
পেন্ডিং ক্যালিফোর্নিয়ার ;
জব লেটারটা অ্যাকসেপ্ট করে পাড়ি দিলাম বহু দূরে।
সাথে নিয়ে এসেছিলাম তৃপ্তি । সুখ। নেশা।
মূহুর্তের চাহিদার চরম আকুতি।
ভালোবাসা।
এই সময়টা এলেই মনে পরে ভীষণ।
কেমন আছো , মোহন?
জানো মোহন, আমাদের ছেলের নাম রাখেছি ‘মাদল’।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।