।। বন্দে মাতরম ।। গল্পে মৌসুমী ঘোষ

মেয়েলি গন্ধ

আমাদের পাড়ার মোড়ে যে মুদিখানা গুমটিটা ছিল সেটা একদিন রাতে কে যেন পুড়িয়ে দিল। ভোরে পার্টির লোক, ক্লাবের ছেলেরা ও পুলিশ এসে জড়ো হল। কিছুদিন বাদে সেই পোড়া গুমটি সরিয়ে সেখানে একটা পানের গুমটি বসল। তাতে পান ছাড়াও লেবু লজেন্স, ঘুড়ি হজমিগুলি, চকলেট বোমা, সিগারেট বিক্রি হতো।
গুমটিটা পুড়ে গেলে যারা প্রকাশ্যে নিন্দা শুরু করেছিল তাদের মধ্যে তাপসদাও ছিল। এর কিছুদিন বাদে তাপসদা নিজেদের বাড়ির বারান্দায় মুদির দোকান খুলল। সেই মুদির দোকান থেকে আমি ডিম, পাউরুটি, মুড়ি, দেশলাই, নুন আনতে যেতাম। প্রতিবার জিনিস কেনার পর যা ফেরত পেতাম সেই খুচরো পয়সা দিয়ে কচুভাজা, চুইংগাম, আচার, বা কারেন্ট নুন কিনতাম।
দোকানে ভিড় থাকলে আমি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম। একদিন খেয়াল করলাম তাপসদার একটা ভীষণ বিচ্ছিরি এবড়ো খেবড়ো গোঁফ আছে। আমি যখন স্কুল পেরিয়ে কলেজে যাব তখন জেনেছিলাম তাপসদা মুদিগিরি ছাড়াও ঘটকগিরি করে।
তাপসদা বিয়ের ঘটকালি করে জানার পর থেকে আমি আর তাপসদার দোকানে যেতে চাইতাম না। কিন্তু আমাকে দোকানে যেতে হতো দাদুর গুড়াকু আনার জন্য। আমার দাদুর নেশা ছিল গুড়াকু দিয়ে দাঁত মাজা। একদিন তাপসদার দোকানে গিয়ে গুড়াকু না পেয়ে পানের গুমটিতে খোঁজ করতেই পেয়ে গেলাম।
সেদিন থেকে গুড়াকু আনতে আমি পানের গুমটিতে যেতে লাগলাম। তাপসদার দোকানে না গিয়ে আমি পানের গুমটি থেকে গুড়াকু আনতে যাই জানতে পেরে মা একদিন রেগে গালে এক চড় কষালো। আমি নিজের গাল ধরে কাঁদতে কাঁদতে বিড় বিড় করে নাকে বললাম, ‘তাপসদা তার বিচ্ছিড়ি এবড়ো খেবড়ো গোঁফের আড়ালে থাকা নাক দিয়ে মেয়েদের শরীরের গন্ধ সোঁকে।’
হ্যাঁ, আমাদের সময় মেয়েরা বিয়ের বয়সে পৌঁছালে তাদের শরীর থেকে একটা গন্ধ বের হতো। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, ঘটক, বন্ধু-বান্ধবরা সেই গন্ধ পাওয়া মাত্র মেয়ের বাবা-মাকে মেয়ের বিয়ে দেবার কথা মনে করিয়ে দিত।
মেয়েদের শরীর থেকে বেড়ানো এই গন্ধের উৎস নিয়ে বিজ্ঞানে অনেক গবেষণা হয়েছে। কোনও বিশেষ ধরনের হরমোন ক্ষরণের জন্য, নাকি শারীরিক কামনা-বাসনা চরিতার্থতা করতে পুরুষ-জাতিকে আকর্ষণ করার জন্য, এই গন্ধটা বের হয়, তা নিয়েও অনেক তর্ক-বিতর্ক আছে। তবে আমার ক্ষেত্রে গন্ধটা চুম্বকের মতো টেনে নিল গুমটির পান বিক্রেতাকে। না জানি কবে থেকে দাদুর নেশার জন্য গুড়াকু আনতে পানের গুমটিতে যাওয়ার নেশা ধরে গেল আমার।
শেষমেশ সেই দিনটা এল যেদিন, আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে পান-ওয়ালাকে বিয়ে করেছি শুনে আমার মা অচৈতন্য হয়ে গেছিল। তাপসদা সেদিন গন্ধ শুঁকে শুঁকে আমাদের হদিস বার করে আমার মা-বাবাকে জানিয়েছিল আর গোটা পাড়াকে জানিয়েছিল আমাদের প্রেমের দিনগুলোর কথা। কিছুদিন বাদে আমরা নতুন বিয়ের, নতুন সংসারের গন্ধ নিয়ে বাইক চেপে পাড়ায় ঢুকলাম। ততদিনে পানের গুমটি সরিয়ে সাইকেলের গ্যারেজ খুলছে পাড়ার আর একটি ছেলে।
আমার বোন এখন বড়ো হয়েছে। সাইকেল চেপে কলেজ যায়। আমার বোন পাড়ার মোড়ের সেই সাইকেল গ্যারেজে সাইকেলের চাকায় হাওয়া ভরতে যায়।
আমি এখন আমার বোনের কাছে গেলে সেই গন্ধটা পাই যেটার জন্য আমি রাতারাতি ঘর ছেড়ে চলে গেছিলাম, সেটার নাম প্রেম। প্রেমে পড়লে মেয়েদের হৃদয় থেকে একটা গন্ধ বের হয়। প্রত্যেক মেয়ের ক্ষেত্রে এই গন্ধটা একই।
সময় নষ্ট না করে আমি বোনকে সেদিনের কথা বললাম, যেদিন মেয়েদের শরীরের ও হৃদয়ের এই গন্ধগুলোকে চাপা দিতে চেষ্টা করে সংসারের পাঁচমিশালি গন্ধ। বোন কথাটা শোনার পর থেকে মন খারাপ করে রইল কিছুদিন। পাড়ার মুদির দোকানগুলোয় ততদিনে বডিস্প্রে, ডিওডোরেন্ট, ট্যালকম পাওডার এসে গেছে।
এখন আমার বোন শিক্ষিকা হয়েছে, সে একটা ফুটফুটে মেয়ের মা, সে প্রেমের কবিতা লেখে। তার একটা কবিতার বইও আছে। সে ফেসবুকে বিভিন্ন কবিতার গ্রুপে কবিতা পোস্ট করে ও কত শত লাইক পায়। আমি আজো আমার বোনের কাছে গেলেই ওর হৃদয় থেকে প্রেমের গন্ধটা পাই। শুধু আমার বোনই নয় আমার বোনের মতো আরো যারা সংসারে প্রবেশের আগেই সাংসারিক গন্ধটার কথা জেনে যায় তাদের হৃদয় থেকে প্রেমের গন্ধ পাওয়া যায় আজীবন।
আমি ছোটো থেকেই আলমারির পাট করা জামা কাপড়ে, পাউডার পাফে, চিরুণিতে, বালিশে, সাবান কেসে, গামছায় আমি আমি গন্ধটা পেতাম। তাই আমার বোন আমাকে গন্ধ বাতিক, গন্ধবুড়ি আবার রেগে গেলে সেলফিসও বলতো। কিন্তু আমি জানি প্রত্যেকের মতো আমারও আলাদা একটা গন্ধ আছে যা আমাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে রেখেছে। আমার ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে এই আমি আমি গন্ধটার মধ্যে মিশে গেছে মেয়েলি গন্ধ, সাংসারিক গন্ধ, প্রেমের গন্ধ আর মা মা গন্ধটা। এই পাঁচমেশালি গন্ধটাই এখন আমার নিজের গন্ধ বলে চারিদিকে ছড়িয়ে পরে। সেটা যখন আমি আমার বোনকে বুঝিয়ে বলেছিলাম, বোন ওর আমি আমি গন্ধটা সন্তর্পণে ঢেকে রেখেছিল, যাতে প্রয়োজনে সেটা ছড়িয়ে দিতে পারে। মাঝে মাঝে মনে হয় যদি ছোটবেলার শুধুমাত্র আমি আমি গন্ধটা আমাকেও কেউ সঞ্চয় করে রাখার কথা বলতো! 🍂
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।