একটা পেন্ডামিক সময়ে দাঁড়িয়ে আছি।যেখানে সবকিছু থেমে গেছে। চলন্ত বাসে হঠাৎ করে যদি কেউ ব্রেক করে যেভাবে একটা ঝটকা লাগে আমাদের অবস্থাটা কতকটা এরকম।যদিও সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুর সাথে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। এমন কী শিশুরাও। শরীরচর্চার জন্যে সন্ধ্যাকালীন হাঁটতে বেরিয়ে মিমির চোখে পড়ল একটি ৮/৯ মাসের একটি শিশুর হাতে তার বাবা স্যানিটাইজার দিতেই সেশ দু’টি হাত বেশ ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গিতে ঘষছে,আর একদিন আর একটি শিশুকে দেখল তার বয়স এই দুই কিংবা আড়াই বছর হবে সে মাস্ক পরে বসে আছে একটি ওষুধের দোকানে। পাশের ভদ্রলোকটি বাচ্চাটির বাবাকে বললেন ‘কী সুন্দর মাস্ক পরে বসে আছে!’ শুনে শিশুটির বাবা উত্তর দিলেন ‘হুম! ও মাস্ক পরে থাকে বাইরে একবারও খুলবে না, হাতও দেবেনা।’
এটাই আসলে অভ্যাস, যেভাবে প্রতিটা বাচ্চা ভার্চুয়াল ক্লাসে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। ভার্চুয়ালি যেকোন অনুষ্ঠান করছে।এই তো ৫ সেপ্টেম্বর ‘শিক্ষক দিবসে’র আয়োজন নিয়ে বিতানের স্কুল ৩০শে আগষ্ট Whatsapp notice দিয়েই সাজোসাজো ব্যাপার।বক্তৃতা,আবৃত্তি,গান কে কী করবে, ২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সমস্ত রেডি- ভিডিও কোলাজ, প্রত্যেক ক্লাসের প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর ছবি তার সাথে আগের বারের শিক্ষক দিবস পালনের ছবির কোলাজ, ক্রাফটের মধ্যে দিয়ে শিক্ষক দিবসের কার্ডেরছবি,দশম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রী মিলে প্রশ্ন তৈরি করে শিক্ষকদের গুগলি প্রশ্ন, সব শেষে বিতানদের অভীক স্যার শিক্ষক দিবস নিয়ে বক্তৃতা – “এক জন সফল মানুষের পেছনে শিক্ষকের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, তা অনস্বীকার্য। শিক্ষক মানে শুধু যিনি পড়ান তা নয়,জীবনের যেকোন ক্ষেত্রেই হতে পারে ।তিনি যে পড়ুয়াকে শেখাবেন , তাই নয়। তিনি তাকে জীবনে চলার পথে পরামর্শ দেবেন, ব্যর্থতায় পাশা দাঁড়িয়ে উৎসাহ দেবেন, সাফল্যের দিনে নতুন লক্ষ্য স্থির করে দেবেন। তিনি তাকে শুধু সফল নয়, একজন ভাল মানুষ হতে শেখাবেন। তবে আজ কেন এই দিন কে উউদযাপিত হয় তোমাদের মনে হতেই পারে- আসলে আজ এক জন আদর্শ শিক্ষক ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ (৫ই সেপ্টেম্বর, ১৮৮৮ – ১৭ই এপ্রিল, ১৯৭৫) তামিলনাডুর তিরুট্টানিতে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি (১৯৫২-১৯৬২) এবং দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি(১৯৬২-৬৭) ছিলেন।
একাধারে রাজনীতিবিদ, দার্শনিক ও অধ্যাপক এই শান্ত মানুষটি ছাত্রজীবনে অতি মেধাবী ছিলেন। জীবনে কোনও পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি। বিভিন্ন বৃত্তির মাধ্যমে তাঁর ছাত্রজীবন এগিয়ে চলে। ১৯০৫ সালে তিনি মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তার বিষয় ছিল ‘বেদান্ত দর্শনের বিমূর্ত পূর্বকল্পনা’। বিশ্বের দরবারে তিনি অতি জনপ্রিয় দার্শনিক অধ্যাপক হিসাবেও পরিচিত ছিলেন। ১৯৩১ সালে তাঁকে ব্রিটিশ নাইটহুডে সম্মানিত করা হয়। ১৯৫৪-তে ভারতরত্ন সম্মান পান। প্রথম জীবনে তিনি মহীশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা করেন (১৯১৮)। এ সময় তিনি বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য পত্রিকায় লিখতেন। সে সময়েই তিনি লেখেন তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘ দ্য ফিলোজফি অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর’। দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘দ্য রেন অফ রিলিজিয়ন ইন কনটেমপোরারি ফিলোজফি’ প্রকাশিত হয় ১৯২০সালে। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেন। দেশ–বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বারবার অধ্যাপনার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তাঁর গুণমুগ্ধ ছাত্র ও বন্ধুরা তাঁর জন্মদিন পালন করতে চাইলে তিনি বলেন জন্মদিনের পরিবর্তে ৫ই সেপ্টেম্বর যদি শিক্ষক দিবস উদ্যাপিত হয় তবে আমি বিশেষরূপে অনুগ্রহ লাভ করবো।
সেই থেকে এই দিনটি ভারতের শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে চলেছে।যদিও আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস ৫ই অক্টোবর… ” –
সারাঘর ল্যাপটপের বক্তৃতায় গমগম করছে তার মধ্যে দিয়ে মিমিও কখন যে নিজের স্কুল জীবনের শিক্ষক দিবসে হারিয়ে গেছে- তখনকার গ্রিটিংস কার্ড,হাতে বানানোর থেকে আর্চিস -গ্রিটিংস কার্ড কেনার মধ্যে আলাদা ব্যাপার ছিল। আসলে কানে তখন অঞ্জন দত্তের ‘প্রিয় বন্ধু’ ক্যাসেটের গান থেকেই কার্ড কেনার হিরিকটা একটু বেড়ে গিয়েছিল ।সে ফাদার’স ডে আর নিউ ইয়ার হোক না কেন, তাতে আবার নিজে একটু কায়দা করে লেখা। ক্লাসরুম হোক বা প্রমিজিং কেরিয়ারের কোচিং ক্লাসের সেইদিনগুলো বেলুন,নানা রঙের কাগজ কেটে ব্ল্যাক বোর্ডে ক্যালিগ্রাফি করে ‘ Happy Teachers’Day’ লেখা,সিনিয়র দিদি-রা এসে শিক্ষক হয়ে ক্লাস, চকলেট, পেন উপহার কত মধুর স্মৃতি ।আজও মিমি বাপের বাড়ি গেলে সেই পেনের ঝাঁপি নামিয়ে লিখতে ভালোবাসে। সত্যিই তো শিক্ষক কখনও বন্ধু কখনও অভিভাবক। ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে যায় দুলাল স্যারের কথা।যে গল্প বহুবার শুনেছে তার মায়ের মুখে। এমন কিছু শিক্ষক থাকেন যাঁদের স্নেহ অপার। মিমি যখন আনন্দমার্গ স্কুলের নার্সারিতে । সেখানকার প্রিন্সিপাল ছিলেন দুলাল কর্মকার (দুলাল স্যার) গুরু গম্ভীর স্বভাবের।নার্সারিতে সমস্ত বাচ্চারা হৈহল্লা করছিল, কিছুতেই সামলানো যাচ্ছিল না, তো স্যার ছোট্ট একটা বেত দিয়ে সবার হাতের তালুতে এক-ঘা এক-ঘা বসিয়ে দিলেন।যথারীতি মিমিও বাদ পড়েনি। মিমি সেদিন শান্ত ছিল।কিন্তু যেই না মারা ওমনি মিমি- ‘ আমি কিছু করিনি, তবু আমাকে মারল কেন!’ সেই রাগে স্যারের পাঞ্জাবি ছিঁড়ে কেঁদে-কেটে জেদের চোটে বেঁকে গেছে। কিছুতেই থামে না সমস্ত স্যার ম্যাডাম ব্যর্থ। অবশেষে দুলাল স্যার মিমিকে কোলে নিয়ে এক হাতে সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসেন, তখনও ফুঁপিয়ে যাচ্ছে, আর এককথা ‘ আমাকে মারল কেন! আমি কিছু করিনি!’এই জেদে রাতে জ্বর। স্যার তখন অসহায়ের মতো বলেছিলেন মিমির মায়ের কাছে ‘আমি জানি ও কিছু করেনি, আসলে সবাইকে মেরেছি তাই আস্তে করেই…বিশ্বাস করুন… আমি বুঝিনি ওর এতো জেদ উঠে যাবে’ – এরপর থেকে এই স্যারের প্রিয় হয়ে উঠলো।
তখনকার দিনে আনন্দমার্গ স্কুলের একটা বদনাম হয় স্বামীজিরা এসে বাচ্চা নিয়ে চলে যায়, আর বাড়ির সাথে যোগাযোগ করতে দেয় না ইত্যাদি…বর্ধমান জেলার ছোট্ট গ্রাম শ্রীখণ্ড সেখানকার মানুষেরা তাই এই স্কুল বন্ধ করে দিলেন।যথারীতি অন্যস্কুল।কিন্তু ক্লাস সিক্স পর্যন্ত এই স্যার মাঝেমধ্যেই মিমির বাড়িতে আসতেন ,পড়াতেন যদিও সেটা ছিল ছাত্রীটির মুডের উপর ।বিকেল বেলা এসে যদি দেখতেন খেলতে গেছে, বসে অপেক্ষা করতেন, ডেকেও আনতেন না খেলার থেকে …। আবার অন্যদিন আসতেন, এবং এর জন্যে কোন গুরুদক্ষিণা তিনি নেননি । ক্লাস সেভেনে শ্রীখণ্ড ছেড়ে পূর্ব্বস্থলীতে পরে উত্তরবঙ্গে সময়ের সাথে সাথে স্থান পরিবর্তনে স্যারের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় ঠিকই তবে আজো মিমির মায়ের সাথে দেখা হলে মিমির খোঁজ নেন।আজ কোথায় যেন সেদিনের না পড়তে চাওয়ার দিনগুলোর অনুশোচনায়, ছেলেমানুষীর ঘোরে বিভোর মিমি…
‘তোমার ফোন’ ফোনটা হাতে দিয়েই দৌড়ে গেল বিতান। ‘হ্যালো তনু বল’। ‘ফোন করেছিলি?’ ‘ ‘হুঁ!পরশু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ..অনলাইন ভিডিও প্রোগ্রামের মাধ্যমে আলোচনা সভা আলোচনা রেখেছি আমাদের ‘দৃষ্টি অনলাইন ম্যাগাজিন’- এর পক্ষ থেকে, তোকে আমন্ত্রণ করছি, তুই তো ওঁনাকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলি, অনেক স্মৃতি আছে, সেগুলো যদি শেয়ার করিস আর’প্রথম আলো’ উপন্যাসটা নিয়ে যদি আলোচনা করিস? আর তোর একটা ছবি পাঠিয়ে দিস পোস্ট করব কোলাজ করে ‘। “ঠিক আছে’,তবে’প্রথম আলো’এতো বড় উপন্যাস নিয়ে!আমি বরং নরেন্দ্রনাথ ও রামকৃষ্ণ পরমহংসের অংশটুকু নিয়ে বলব- এর থেকে ভালো তো আর গুরু শিক্ষক হয় না,শিক্ষক দিবসের পরের অনুষ্ঠান যখন” তনুর কথায় সম্মতি জানিয়ে মিমি অনলাইন ম্যাগাজিনের কাজে ব্যস্ত করল নিজেকে