।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় মৌসুমী মৌ

গর্ভ গৃহ 

আজ রাস্তায় যেন বড় বেশি ভীড় । বড় বেশি যানজট । চাকা যেন এগোচ্ছেই না । ধৈর্য্য
ধরা পারভীনের অভ্যেস আছে । কিন্তু আজকের দিনটা তার কাছে সম্পূর্ণ অন্যরকম । এতো দিনের লড়াইয়ের একটা পর্যায়ের সমাপ্তি বলে যায় । অন্তত দুমুঠো ভাতের জন্য তাকে আর তার ভাইকে লোকের দরজায় দরজায় ঘুরতে হবে না ।
পারভীন মনে মনে ভাবে নানী আর কদিন! এখন তার প্রায়ই শরীর খারাপ হয় l অবশ্য শরীরের আর দোষ কি? কষ্টতো কিছু কম করেনি l সারাটা জীবন তাদেরকে টেনে গেল l পেট ভরে ঠিক করে কটাদিন খেয়েছে, তা হাতে গুণে বলা যাবে l কিন্তু তাদেরকে না খাইয়ে রাখেছে এ কথা কোনো দিন পারভীন বলতে পারবে না l পারভীন ভাবছে কতক্ষণে গিয়ে খবরটা আগে তার নানীমা কে জানাবে! সত্যি সত্যি নানীই তার মা l
ধীরে ধীরে ভীড় কাটিয়ে অটোটা একটু একটু এগোচ্ছে l পাঁচটা পাঁচের ট্রেনটা পেলে তবেই সাড়ে ছটার মধ্যে বাড়ি ঢুকতে পারবে সে l চৈতি, পিয়ালী, মুশকান ওকে কিছুতেই আজ ছাড়ছিল না l আজ নাকি ওরা সারারাত পার্টি করবে! খুব মজা হবে l সত্যি এই কটা বছর ওরা চূড়ান্ত পরিশ্রম করেছে l ওর ও আজ খুব ইচ্ছে করছিলো এক ছুটটে ওদের সাথে চলে যেতে ল কিন্তু উপায় নেইl আসার সময় নানীমার জ্বর দেখে এসেছে l মামা-মামী কেউ খোঁজ নেবে না ও জানে l ওদের দুই ভাইবোনকে আশ্রয় দেবার অপরাধে আজ ছেলে বউরা নানীকে কেউ দেখতে পারেনা l
নানী আম্মু কোথায় তুমি? তাড়াতাড়ি এদিকে এসো l গলার আওয়াজ পেয়ে পারভীনের ভাই দাওয়ার এক কোণে জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে খাঁচায় বন্ধ পাখির ডানা ঝাপটানোর মতো ছটফট করতে শুরু করে l পঙ্গু অশক্ত পা দুটো মাটিতে ক্রমাগত ঘষতে থাকে| একনাগাড়ে ঘষার ফলে একটা বিরক্তিকর খসখস আওয়াজ হয় l কষের লালা চিবুক বেয়ে মাটিতে পড়ে তার বসার চারপাশের বেশ খানিকটা জায়গা ভিজে যায় l বোঝাই যাচ্ছে আজ সারাদিন ওকে কেউ ছুঁয়েও দেখেনি l চোখে মুখে এক অদ্ভুত আতঙ্ক ঘিরে ধরেছে l কোনোদিন আরমান এতো ছটফট করে নাতো? আজ এমন করছে কেন?
পারভীন তাড়াতাড়ি ঘরে ঢোকে l দেখে
অন্ধকার জমাট হয়ে আটকে আছে ঘরের চার দেওয়ালের গায়ে l নানা থাকাকালীন পঞ্চায়েত প্রধানকে ধরাকরা করে এই প্লাস্টারহীন, সিমেন্টের মেজেহীন ঘরটা আদায় করে নিয়েছিল l ভাগ্গিস! তা নইলে আগের ওই খড়ের ছাউনি দেওয়া, মাটির ঘর
কবেই টাকার অভাবে মাথায় ভেঙে পড়তো!
ঘরে ঢুকেই আগে আলো জ্বালায় পারভীন l দেখে নানী অসাড় হয়ে বিছানায় লেপ্টে আছে l সকালের করে দেওয়া গ্লুকোন-ডির জল কয়েক চুমুক হয়তো খেয়েছে l কৌটোর খান চারেক মারি বিস্কুট তেমনি পড়ে রয়েছে lপারভীন আস্তে আস্তে কপালে হাত ছোঁয়ায় l এতো জ্বর বেড়ে যাবে ভাবতেও পারেনি l জলে বিস্কুট গুলে জোর করে খাইয়ে তারপর ব্যাগ থেকে প্যারাসিটামল বের করে এনে নানীর মুখে ধরে l
ও জানে অন্য সবার থেকে অনেক বেশি পরিশ্রম করার ক্ষমতা আল্লা তাকে দিয়েছে l সারা দিনের এতো ধকল তাও তাকে ক্লান্ত করতে পারে না l কোনো আফসোস নয় দুরন্ত অভিমানে ও লড়াই চালিয়ে যায়, নিজের স্থির করা কর্তব্য নিজেই পালন করতে বদ্ধপরিকর হয় l
মুখ হাত যাহোক করে ধুয়ে ভাইকে খাবার দিয়ে আগে শান্ত করে l আজ আরমানেরও বোধহয় খাওয়া হয়নি l সেই সকালে ও যা অল্প কিছু খাইয়ে গেছিলো l কথা বলতে পারেনা কিন্তু বোঝাতে পারে সব l অন্তত পারভীন সব বুঝতে পারে — ওর কষ্ট,ওর আনন্দ এমনকি ওর যন্ত্রনা সব সব…
কেউ ওর ভাইকে অবজ্ঞা করলে ও ভীষণ ব্যথা পায় l তাই ভাইয়ের দেখাশোনা ও আর ওর নানী মিলেই করে| মামাদের কাছে কোনো দয়া চায়না l
— পারভীন আইছিস?
— হ্যাঁ নানী এসেছি l আরমান এবার একটু নিজে খেয়ে নে l নানী আম্মুর জ্বর হয়েছে দেখতে হবে তো l আরমান ঘাড় নেড়ে না বলে l উঠতে গেলেই নাইটির খুঁট ধরে টান দেয় l ও আস্তে আস্তে গামছা দিয়ে ভাইয়ের মুখের লালা মুছিয়ে দিয়ে বলে ঠিক আছে, নানীকে দেখে আসি তারপর বাকিটা খাওয়াচ্ছি l আরমানের হাত শিথিল হয় l
পারভীন নানীর মাথায় হাত ছুঁইয়ে দেখে জ্বর অনেক কম l
— কিরে খবর ভালো তো ?
হঠাৎ পারভীনের মনে পড়ে যায় | নানী আমি আমাদের ব্লকের হাসপাতালেই পোস্টিং পেয়েছি l আমার রেজাল্ট ভালোছিলো বলে ওরা বললো কোথায় যেতে চাও আমি বললাম চাঁপা-ডাঙ্গা l ওরা একটু অবাক হয় বলে কলকাতায় পোস্টিং চাওনা ! ওরাতো আর জানেনা ভাইয়ের কথা | তারপর পারভীন নানীর গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
–নানী আম্মু সব তোমার জন্যে সম্ভব হয়েছে,সব সব তোমার জন্যে …
চিলতে হেসে রোকেয়া বিবি বলে,
— “আর অভিমান করিস নি, মাকে ফোন কর| পরশু ফোন করে খবর নিচ্ছিলো |”
–“কে মা ? যে তার বারো বছরের মেয়ে আর আট বছরের বিকলাঙ্গ ছেলেকে ত্যাগ করে পালিয়ে বিয়ে করে !!”
রোকেয়া শীর্ণ হাতটা নাতনির পিঠে বোলায়|
পারভীনের চোখ দিয়ে অভিমানের জল গড়িয়ে পড়ে l
পারভীন তখন ক্লাস সেভেন শোভা দিদিমণি বললো কাল মাকে নিয়ে আসবে কথা আছে l
যথারীতি পরের দিন মাকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে যায় l সে দিনের সব কথা ওর মনে আছে!
–দিদি আসবো l
— ও পারভীন ! পেরেন্টকে নিয়ে এসেছো?
–হ্যাঁ দিদি l আম্মা এসেছে l
— আসুন l যেটা বলার জন্য ডেকেছি আপনার মেয়ে শুধু মেধাবী নয় খুব মনোযোগী l শুধু মেধা থাকলে তো হয়না! ইচ্ছে টাই হচ্ছে আসল l সেটা পারভীনের মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় আছে ল শুধু আপনাদের কাজ হলো মেয়েটাকে সব দিক থেকে সাপোর্ট দেওয়া l
পারভীনের মা চুপচাপ শুনে যায়|
— ওর বাবা কী করে?
— ওর বাবার মাথার দোষ আছে l আমরা তাই বাপের ঘরে চলে এয়েচি l
পারভীন তুমি ক্লাসে যাও l আমি মায়ের সাথে কথা বলে নিচ্ছি l
সেদিন পারভীন স্পষ্ট শুনেছে ওর আম্মা বলছে,
— শ্বশুরবাড়ী ছেড়ে চলে আসার কিছুদিন পর পারভীনের আব্বা মরে গেছে l
— তাহলে আপনার চলে কি করে ?
— আমি নার্সিংহোমে আয়ার কাজ করি l
— আমার অনুরোধ যতই কষ্ট হোক মেয়েটাকে পড়া ছাড়াবেন না l
কীরে আজও ইস্কুলে যাবি না l
এক সপ্তা হয়ে গেল l বড়দিদিমণি খোঁজ নিতে পাঠিয়েছিল l কাল তো ফোন পেলি l বললো তো মাঝে মাঝে আসবে টাকা পয়সাও দেবে l
কিচ্ছু দিতে হবে না ল দরকার নেই আসার, কিচ্ছু দরকার নেই … পারভীনের কান্না দেখে তার ভাইটাও বিকট চিৎকার করে ওঠে l সামনে রাখা এলুমনিয়ামের বাসন কোসন উঠোনে ছুঁড়ে ফেলে তান্ডপ শুরু করে l ইতিমধ্যে সামনের ঘর থেকে মামা লাঠি নিয়ে তেড়ে আসতে পারভীন ছুটে ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলে একদম মারবে না ওকে l ও তোমাদের কি করেছে! ওর মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে l ও বোঝাবে কি করে! ওকে কি আল্লা আমাদের মতো মুখে বুলি ফুটিয়েছে যে কষ্টের কথা জানাতে পারবে! ওকে কোনোদিন মারবে না তোমরা l কোনোদিন নয় … সেদিন ভাই-বন মিলে খানিক কান্নাকাটি করার পর কিশোরী পারভীন মনে মনে চিন্তা করে নেয় তাকে এবার কি করতে হবে l
এরপর থেকে পারভীনকে কোনোদিন মনে করাতে হয় নি স্কুলে যাবার কথা l নিজের পড়াশোনা ছাড়াও ভাইয়ের দেখভালের বেশিরভাগ দায়িত্ব নিজেই পালন
করতো l ওর পড়াশোনার অদম্য ইচ্ছে ওকে সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করার সাহস
জুগিয়েছে l উচ্চমাধ্যমিকের পর শোভা দিদিমণির পরামর্শে কলেজে পড়ার সুপ্ত বাসনা ত্যাগ করে নার্সিং ট্রেনিঙের পরীক্ষা দেয় l এবং সরকারী কলেজে পড়ার সুযোগ পায় l কয়েক বছরের অমানুষিক কষ্টের পর নিজের পায়ে দাঁড়াবার স্বপ্নটা ছুঁতে পারে পারভীন l
মনে মনে শোভা দিদিমণিকে প্রণাম জানায় সে l
মেধাবী আর পরিশ্রমী হওয়ার জন্য অচীরেই কাজের জায়গায় পারভীনের খুব সুনাম হয়| নাতনির গর্বে গর্বিত নানীর আনন্দ আর ধরে না l মনের খুশি তার শরীরকেও আগের থেকে অনেক সুস্থ করে দেয় l হসপিটালে নিউরোলজিস্ট ডাক্তার সোমকে দেখিয়ে নিয়মিত ওষুধপত্র খাওয়ানোর পর আরমান এখন অনেকটা ভালো l
চাকরি পাওয়ার পর হাসপাতালই এখন ওর দ্বিতীয় বাড়ী| সেবার মধ্যে দিয়েই সে নিজেকে খুঁজে পায় l অসুস্থ, অসহায় মানুষের সেবায় নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে দেয় সে l
হঠাৎ একদিন সংকটাপন্ন একজন অন্ত:স্বত্ত্বা মহিলাকে স্ট্রেচারে করে হাসপাতালের লেবার রুমে নিয়ে আসা হয় ওয়াডাররা ছোটাছুটি শুরু করে দেয় l প্রচন্ড ব্লিডিং হচ্ছে রোগীটির l ডাক্তার দাস সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার্ডবয়কে দিয়ে পারভীন আর অন্য দুজনকে ও.টি রেডি করার নির্দেশ দেন l কারণ রোগীটি প্রাইভেটে ডাক্তার দাসের পেশেন্ট l বিন্দুমাত্র দেরি না করে তারাও তৎপতার সাথে সব ব্যবস্থা করে ফেলে কিন্তু শেষ রক্ষা হলোনা l মা বেঁচে গেলেও বাচ্চাটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই মায়ের গর্ভেই মারা যায় l
পারভীন কৌতূহলবশত রোগিণীর দুর্বল মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে l তার পায়ের তলার মাটি যেন কেঁপে ওঠে! হায় আল্লা!! এটাও তার কপালে ছিল l
আম্মি! মরা বাচ্চাটা ওরই মায়ের পেটের ভাই!
সন্তান জন্ম দেওয়া সংজ্ঞাহীন মা, অর্ধেক শেষ হওয়া সেলাইনের বোতল, ভূমিষ্ঠ মৃত শিশুর অসহায় অবয়ব, ও.টি-র চাপা, তীব্র ওষুধের গন্ধ সব মিলে-মিশে পারভীন কয়েক সেকেন্ডের জন্য সঙ্গাহীন করে দেয় l পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে ওর কলিগ তনুজা ওকে ধরে ফেলে l
অবাক তনুজা ওকে ধরে নাড়া দিলে ওর সম্বিৎ ফেরে,
— জানিস পারভীন ডাক্তার দাস আগেই জানতো বাচ্ছাটাকে বাঁচানো যাবেনা l মা বেঁচেছে অনেক কপাল জোর, মহিলার বয়স ও বেশ বেশি, চল্লিশের ওপরে l শুরুর থেকেই নাকি অনেক কমপ্লিকেশনস ছিল l
— পারভীনের কানে আর কোনো শব্দ প্রবেশ
করে না l
ও আস্তে আস্তে ও.টি থেকে বেরিয়ে আসে l
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।