।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় মৌসুমী রায়

আরশোলা

মহালয়ার সকালে তর্পণ টর্পণ করে আসার পর থেকেই পিঠটা কেমন চুলকোচ্ছে সুতনুর। প্রথম দুই একদিন পাত্তাই দেয়নি। কিন্তু অস্বস্তি একটা হচ্ছেই। পিউকে বলে লাভ নেই। বহুদিন ধরেই তাঁর সাথে ছোঁয়াছুই লেনদেন বন্ধ। আর কাকেই বা বলবে? একটা ছেলে, সেও মায়ের ছাঁচেই গড়া। বাপকে দেখতে পারেনা। গোল বাঁধলো চতুর্থীর দিন সকালে। এবারে সুতনুর ভাগে কাঁচা আনাজ, ফলফলাদি, দশকর্মা। মোদ্দা কথা বাজারের দায়িত্ব। মেজজ্যাঠার ছেলে সুমন আর সুদীপদা, সুতনুর বড়পিসির বড়ছেলে এই কজন যাবে বাজারে। ওরা দুজন ব্যাগ ফ্যাগ নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে। পিউ হেসে হেসে চা বিস্কুট দিচ্ছে।
সুতনু বাদে বিশ্বের সব ব্যাটাছেলের গায়ের গন্ধ পিউএর ভালো লাগে, মনে মনে ভাবলো সুতনু। যাই হোক, পাঞ্জাবীটা গলাতে যাবে, কিসে একটা আটকে গেলো। কায়দা করে পাঞ্জাবী নামাতে গিয়ে সুতনু টের পেল, পিঠে খুব পাতলা একটা চামড়ার মত কি যেন! ড্রেসিংটেবিলে পিঠ পিছন হয়ে দাঁড়িয়ে সামনে পিউএর মেকাপ বক্সের ছোট আয়নাটা ধরলো সে!
দুটো ডানা!
ঠিক আরশোলার মত। প্রায় স্বচ্ছ কিন্তু বেশ পোক্ত ডানাগুলো! উত্তেজনায় সুতনু বাপের নাম অবধি ভুলে গেছে।সুদীপদা বাইরে থেকে হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়েই যাচ্ছে,
“এ ল্যাবদা, হোলো তোর? ট্যালার ট্যালাই রয়ে গেলি চিরকাল। এই জন্যই পিউ এত বিরক্ত হয়, ধুর বাল, বেরো।মেয়েছেলের মত মেকাপ নিচ্ছে শালা!”
সুতনু কোনমতে বেরিয়ে এলো, নাহলে সুদীপদার কর্পোরেশনের পাস করা মুখে খিস্তির ফোয়ারা থামবে না।
সব্জিবাজার ফলপাকুড় সব কেনাকাটা হচ্ছে, সঙ্গে আড্ডা, সিগারেট, দু-কাপ চা। মনটা কিন্তু সুতনুর পিঠেই পড়ে আছে।ভিতরে ভিতরে একটা অদ্ভূত উত্তেজনা বোধ করছে সে।
দুপুরে কোনমতে লাঞ্চ সেরেই ছাদে ছুটলো, এজমালী পুজো।তার সাতসতেরো ঝক্কর। কেসটা হলো, সুতনুদের সাতমহলা প্যালেস ভেঙে ফ্ল্যাট উঠেছে। না উঠিয়ে উপায় ও ছিলোনা। পলেস্তারা খসে, কড়িবরগা ভেঙে কর্পোরেশনের নোটিসে সে এক যাচ্ছেতাই কান্ড। দুএক জন শরিক শাঁসালো হলেও অধিকাংশের ক্ষমতা ছিলনা, ঐ যক্ষপুরী সারাবার।অগত্যা প্রোমোটিং। সবাই একটা করে ফ্ল্যাট ও পেলো সঙ্গে থোক কিছু টাকা। তবে সিংঘী বাড়ির মহিমাবলয়ে দু’একজন বাইরের লোক ঢুকে গেলো এই যা। তাতে অবিশ্যি অসুবিধা তেমন কিছু হয়নি। শুধু পাঁচতলার ঐ হ্যাপেনিং কাপল, মিঃ, এন, মিসেস শর্মাই যা একটু সন্দেহজনক। পারিবারিক দুর্গাপুজোটা এখন ফ্ল্যাটে বারোয়ারী হয়ে গেছে। যদিও আত্মীয়স্বজন সবাই আসবে মোটামুটি। আর বাড়ির মেয়েরা অধিকাংশই তাদের অংশের ভাগের ভাগ ফ্ল্যাট নিয়ে এখন এখানেই স্বশরীরে বিদ্যমান। পুজোর সেই বনেদীয়ানাটা গেলেও ঠাঁটবাট কমেনি তেমন। ভালোই মোচ্ছব হবে এই ক’দিন। আজকের মিটিংটা সেইসব নিয়েই। মেনু, ভোগ, ধুনুচি নাচ, অন্ত্যক্ষরী, মহাষ্টমী, সন্ধিপুজো, ভাসান, আরো কত কি।
তার মধ্যে সুতনুর এই কেলো! কখন যে ফ্রি হবে, উসখুশ করছে সে।
ডিনার সেরে একটা সিগারেট ধরিয়ে
অবশেষে ছাদে এসে একটু একলা হলো সুতনু। তাঁর ফ্ল্যাটে এখন বারোভূতের হুজ্জুতি চলছে। পিউ আত্মীয়মহলে খুব ফেমাস। সে মক্ষীরাণী হয়ে আড্ডায় জাঁকিয়ে বসেছে। সেই সুযোগেই পা টিপে টিপে ছাদে উঠে এলো সে। টিশার্টটা টান মেরে খুলে একটা দড়িতে ঝুলিয়ে রাখলো। হাত দুটো পিঠে যতটা পারে টেনে নিতেই ডানা দুটো ফট করে খুলে গেলো!কেমন একটা হালকা লাগছে সুতনুর। বেশ ফুরফুরে। একটা লাফ দিলো। উড়িব্বাস, সে তো অনেকটা উঁচুতে উঠে এসেছে। হাওয়ায় দিব্বি ভাসছে। একটু ভয়ভয় লাগছে যদিও। পড়ে টড়ে যাবে না তো?
ধুসস,পড়লেই বা কি? পিউ পরের দিনই ঐ কৌস্তভকে বগলদাবা করে রিসর্টে যাবে। সব জানে সুতনু! সাধে কি ঘেন্নায়…
ওমা, সে কোথায় চলে এলো উড়তে উড়তে? এতো সুদীপদার বেডরুম ! জানলা দিয়ে সহজেই ভিতরে গলে এলো সে। নিজেকে একটা আরশোলার মত লাগছে এখন।দিব্বি দেওয়ালে বসতে পারছে। বৌদি হিসহিস করে সুদীপদাকে কিসব বলছে! অত ডাকাবুকো সুদীপদা কেমন ভেড়ার মত সামনে বসে। কান পাতলো সুতনু! ওরে বাবা, ইনি তো খিস্তিতে সুদীপদার গুরুমা! তাহলে কর্পোরেশনের আপিস নয়, সুদীপদার কোচিংসেন্টার ঘরের ভিতরেই!
নাহ, কান পাতা যাচ্ছেনা। যতই হোক সুতনু মাষ্টার তো।একনাগাড়ে এত খেউড় কান নিতে পারেনা ।
“নাহ,পালাই।”ঝটপট উড়লো সে।
উড়তে গিয়েই ঠাস!
জোর গোত্তা খেলো শর্মাজীদের ব্যালকনির দেওয়ালে। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠলো সুতনুর। ঐ তো মিসেস শর্মা।অমন ভেটকে বিছানায় পড়ে কেন?
তা বলতে নেই, মিসেস শর্মাকে দেখলে সুতনুর তনুতে যা একখানা শিরশিরানি হয়, বেশ বুঝতে পারে, তাঁর মেশিনের পার্টস সব ঠিকঠাক আছে। শুধু পিউকে দেখলেই আজকাল নেতিয়ে যায়!
হায়, হায়। হোল বডিতে কিসব মেখে পড়ে আছে মিসেস শর্মা। কি বিটকেল গন্ধ রে বাবা! নয়তো এমনিতে উনি পাশ দিয়ে গেলে ফ্রেঞ্চ পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ পায় সুতনু! আর ঐ মুক্তোর মত দাঁতের হাসি! আহ,
চোখ বুজে মনে করার চেষ্টা করে সে! কিন্তু চোখ তো তাঁর প্যাটপেটে,পলক ফলক নেই। টের পায় সুতনু। সে কি পুরোটাই তবে আরশোলা হয়ে গেল!
যাকগে, মিসেস শর্মা উঠে বসেছেন। উফ,পাতলা একটা স্প্যাগেটি নাইটি পড়া। বেসিনে মুখ ধুচ্ছেন।
কিন্তু মুখটা এমন তোবড়ানো কেন?
গালদুটো সোনা ঠাকুমার মত লাগছে।
যাঃ কলা, এতো দেখি বাটি থেকে বাঁধানো দাঁত তুলে সেট করে নিল, খটাস করে একটা আওয়াজ হলো। এই জন্যই এত গুপচুপ!
নাহ, সুতনু মনস্হ করলো, ঘরে ফিরে যাবে। একদিনে এত চাপ নেওয়া হার্টের পক্ষে ঠিক নয়। বিশেষত এই মিডল এজেই হার্ট অ্যাটাকটা বেশী হয় ছেলেদের!
কিন্তু সে কি আবার সুতনু হতে পারবে?
ছাদে এসে খানিক জিরিয়ে নিল, দড়ি থেকে জামাটা নিয়ে গায়ে গলাতেই আবার পুরোনো সুতনু!
আচ্ছা! অব আয়ী বাত সমঝমে!
কেসটা বুঝতে পেরে বেশ রিল্যাক্সড লাগছে সুতনুর। তাহলে সে ইচ্ছা মত মানুষ থেকে আরশোলা, আরশোলা থেকে মানুষ হতে পারবে! তর্পণ করতে করতে ঠাকুরদার কাছে মুক্তির বর চেয়েছিলো সে। ঠাকুরদাই কি বরটা দিলেন ?
তিনি নাকি সিদ্ধ পুরুষ ছিলেন।
তাঁর মত আধসেদ্ধ দড়কচা মাল না!
একদিন দুদিন করে পুজো বেশ ভালোই জমে উঠেছে। আজ মহাষ্টমী। ঢাকের শব্দে, ধূপে ধুনোয়, আত্মীয় পরিজনে গগনবিহারী আবাসন গমগম করছে।
“গগনবিহারী! তাঁর ঠাকুরদার নাম তো। এতদিন খেয়াল করেনি সুতনু। ঠাকুরদাও কি তাঁর মত গগনে বিহার করতে পারতেন? এটা কি তবে উত্তরাধিকার সূত্রে পেলো সে?”
সবাই পুজোয় ব্যস্ত। সুতনুর কি মনে হতে চুপচাপ ছাদে এসে জামাটা খুলতেই, আবার ফুরুৎ!
উড়তে উড়তে ছোড়দার ঘরে। ছোড়দা টিনের কৌটোতে কি লুকোচ্ছে?
ভোগের নাড়ু! একথাবা তুলে এনেছে মনে হয়! সত্যি, ছোড়দার নোলা কোনদিন যাবেনা। এত হাই সুগার!
ছোটবৌদি কোথায়? টের পেলে ছোড়দার কপালে দুঃখ আছে।
ঐ তো ছোটবৌদি! ছোড়দা একটা নাড়ু খাইয়ে দিলো বৌদিকে। বৌদি মুখ টিপে টিপে হাসছে। দুজন দুজনের দিকে কেমন চেয়ে আছে দেখো?যেন প্রথম দিন ডেটিং এ গেছে! আহা, ভালো থাক ওরা।
সুতনু তিনতলায় ফুলজ্যাঠার ঘরে উঁকি দিলো। জ্যাঠা বহুকাল বিছানায় পড়ে। দুটো পায়ে জোর নেই। পদ্মমাসি দেখাশোনা করে। দুই ছেলেই বিদেশে থাকে। সুতনুরাই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সবকিছু যোগান দেয়। মাঝেমাঝে বিরক্তও লাগে। তবু ফ্যামিলির লোক, ফেলা তো যায় না।আর বলতে নেই, দীপু টীপু যখনই দেশে আসে, সবার জন্য দুহাত ভরে জিনিস নিয়ে আসে। যত রকম বিলিতি মাল তো সুতনু ওদের কাছেই গিফ্ট পেয়েছে। বেডরুমের আলমারিতে লুকানো আছে। কালেভদ্রে খায়।
শুনেছে মদ যত পুরোনো হবে, তাঁর দাম তত বেশী!
পদ্মমাসি বাটিতে করে ফুলজ্যাঠাকে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছে। কিন্তু জ্যাঠা ওটা কি করছেন? কি কান্ড! ডান হাতটা পদ্মমাসির গায়ে বুলাচ্ছেন যে! অস্হানে, কুস্হানেও! পদ্মমাসি তো রাগ করছে না! বরং বেশ এনজয়ই করছে মনে হচ্ছে! এই জন্য বুড়ো একদিন ও পদ্মমাসিকে ছুটি দিতে চায় না। আচ্ছা, ওদের মধ্যে কি প্রেম ট্রেম হয়ে গেছে? যাকগে যাক। সুতনু পালালো।
গুরুজনদের এসব দেখে ফেললে আর শ্রদ্ধার ছিঁটেফোটাও থাকবে না!

হুড়োহুড়ি করে উড়তে গিয়ে কোথায় যে ঢুকে পড়লো, কি অন্ধকার! ওমা, এতো পাম্পঘর। লিফ্টম্যান সুবলদা কোনে বসে। কি যেন টানছে একটা, লাল আগুন জ্বলছে। সামনে ওটা কে বসে? ও তো সাহেব! তাঁর একমাত্র ছেলে! দপ্ করে মাথাটা জ্বলে উঠলো সুতনুর। হতভাগা, জানোয়ার, এত দূর গেছো তুমি মায়ের আস্কারায়! আর সুবলদা! তোমার চাকরি আমি নট করবোই।
উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে সুতনু।
কিন্তু ওরা তো পাত্তাই দিচ্ছে না তাকে।
সুবল চটিটা খুলে বরং তাড়া করলো!

“হারামিটা বহুক্ষণ ধরে ফড়ফড় করছে! আর্শুলা দেখলে আমার মটকা গরম হয়ে যায়!”
খিকখিক করে হাসছে সাহেব।
“মেয়েছেলে নাকি তুমি?”
নিরুপায় সুতনু ওখান থেকে উড়ে সিধে এসে পৌঁছলো মায়ের মূর্তির পিছনে। সন্ধিপুজো শুরু হয়ে গেছে। ধূপ ধুনো আগুরু ভোগের গন্ধে জায়গাটা কেমন পবিত্র হয়ে আছে।সবাই দেবীপ্রতিমার সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে। চোখ বুজে ঠাকুরের কাছে নিজের মনোবাসনা বলছে মনে মনে। এক এক করে সবার মন পড়তে পড়তে সুতনু থমকে গেলো পিউএর সামনে এসে।
এতক্ষণ যা সব ভয়ংকর মনোবাঞ্ছা শুনেছে, পিউ এরটা শুনতে বুকটা কেমন ঢিবঢিব করছে। সুতনুর মৃত্যুকামনা করবে নাতো আবার?
কিন্তু পিউ কাঁদছে কেন?
পিউ পুরোনো দিনগুলো ফিরিয়ে দিতে বলছে মাকে!
সুতনু বিশ্বাস করতেই পারছেনা।
পিউ এখনো তাকে ভালোবাসে?
সে তো ভাবতো, সব শেষ। ভালোবাসা মরে গেছে!
ধুর শালা! সুতনু জোরে জোরে উড়ে ছাদে এসে তাড়াতাড়ি জামাটা গায়ে গলিয়ে নিলো। আর সে জামাটা খুলবে না গা থেকে। লিফ্টের কাছে যেতেই সুবল! নাহ, আজ সুবলকেও ক্ষমা করে দেওয়া যায়। সুতনু ছুটছে। পিউ এর পাশে দাঁড়িয়ে মায়ের কাছে তাঁরও যে চাইবার আছে ,অনেক কিছু …
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।