ইলা মিত্র সাঁওতালি মেয়ের পোশাক পরে ছিলেন। সাঁওতালি ভাষায় কথা বলছিলেন। তখন পঁচিশ বছর বয়স। পূর্ণ যুবতী। সীমান্ত টপকাতে গিয়ে গোয়েন্দাদের চোখে পড়ে গেলেন। সেটা ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসের সাত তারিখ। গরিবের রাণীমাকে পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ বেঁধে আনল নাচোল থানায়। দেশের পুলিশি আইনে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার হওয়া মানুষকে আদালতে হাজির করার নিয়ম। কিন্তু পুলিশ দরকার মত আইনের বইকে ফালতু চোতা মনে করতে জানে। ইলা মিত্রের বয়ান থেকে জানা যায়, আমাকে কিচ্ছু খেতে দেওয়া হয়নি। একফোঁটা তেষ্টার জল পর্যন্ত না। যেদিন আমায় ধরে আনল, সেইদিন সন্ধ্যায় সাব ইন্সপেক্টরের সামনে সিপাইরা তাদের বন্দুকের কুঁদো দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করছিল। আমার নাক দিয়ে ভীষণ ভাবে রক্ত পড়ছিল। তারপর…বলতে গিয়ে ইলা মিত্র একটু দম নেন, ওই হাজতখানায় সাব ইন্সপেক্টর সিপাইদের বললেন, যা চারটে সেদ্ধ হতে থাকা গরম ডিম নিয়ে আয়, দেখবি, তারপর কথা কি করে বলাতে হয়। তারপর চারটে কি পাঁচটা সিপাই আমাকে চিৎ করে শুইয়ে চেপে ধরে রইল। আর একটা সিপাই আমার গুহ্যদ্বার দিয়ে একটা গরম সেদ্ধ ডিম চাপ দিয়ে ঢোকাতে লাগল। আমার শরীরের ভেতরে ওই নরম জায়গাটায় যখন ফুটন্ত জল থেকে তুলে আনা সেদ্ধ ডিম ঢুকে গেছে, আমার মনে হচ্ছিল যেন আমার গায়ে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তখন আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
আমার জ্ঞান ফিরল নয় তারিখ সকালে। জ্ঞান ফিরেছে দেখে সাব ইন্সপেক্টরটা কটা সিপাইকে নিয়ে আবার হাজতখানায় ঢুকল। তাদের বুটপরা পায়ে তারা আমার পেটে লাথি মারছিল।
তারপর আমার ডানপায়ের গোড়ালিতে ওরা একটা পেরেক ঠুকে ঢুকিয়ে দিল। আমি তখন জ্ঞান হারাতে বসেছি। অর্ধচেতনার মধ্যেই শুনলাম, সাব ইন্সপেক্টরটা বিড়বিড় করে বলছে, দ্যাখ্ হারামজাদি মাগি, আমরা আবার রাত্তিরে আসব, তখনও তুই যদি মুখ না খুলিস, আমাদের একটার পর একটা সিপাই তোকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবে।
নিশুতি রাতে সাব ইন্সপেক্টরটা আর সিপাইগুলো আবার ঢুকল। আবার আমাকে হুমকি দিল। তবুও কিছুতেই আমি মুখ খুলি নি। তখন তিনটে না চারটে সিপাই আমার হাত পা চেপে ধরলো। আর একটা সিপাই আমাকে ধর্ষণ করতে শুরু করল।
খানিকক্ষণের মধ্যেই আমি জ্ঞান হারালাম। পরের দিন, পঞ্চাশ সালের দশই জানুয়ারি, আমার যখন জ্ঞান ফিরল, আমি দেখলাম আমার তলপেট দিয়ে বীভৎস রক্ত বেরিয়েছে, আর পরনের কাপড়টা রক্তে ভেসে গিয়েছে। ওই অবস্থায় ওরা আমাকে নাচোল থানা থেকে নবাবগঞ্জে পাঠাল। নবাবগঞ্জ জেল গেটে ওখানকার সিপাইরা আমায় যথেচ্ছভাবে কিল চড় লাথি মারল।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে এই হল পূর্ববঙ্গের অবস্থা। আর পশ্চিমবঙ্গে অর্চনা গুহের কথা মনে পড়ে শ্যামলীর। কলকাতা পুলিশের তরফে অর্চনা গুহ, তাঁঁর ভাইবউ লতিকা গুহ, আর এক আপনজন গৌরী চ্যাটার্জির উপর নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয়েছিল। সময়টা ছিল চুয়াত্তর সাল। তখন পশ্চিমবঙ্গে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের অপশাসনের যুগ। ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ থেকে ১৯৭৭ সালের ২১জুন অবধি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রিত্বে গদিয়ান ছিলেন এই কুশাসক। ১৯৫৭ সালে বিধান রায়ের মন্ত্রিসভায় ইনি আইনমন্ত্রী ছিলেন। আবার ১৯৬৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকারে ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভায় ইনি শিক্ষামন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করেছেন। ইনি আবার বিলেতফেরত ব্যারিস্টার ছিলেন। ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নাতি। জরুরি অবস্থা জারি করে দেশবাসীর যাবতীয় গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেবার জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে শলা পরামর্শ দিয়ে কুখ্যাতি আরো বাড়িয়েছেন। এঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলেই রুনু ওরফে রঞ্জিত গুহনিয়োগী নামে কলকাতা পুলিশের এক ডেপুটি কমিশনার এর নেতৃত্বে কলকাতার লালবাজার পুলিশ হেড কোয়ার্টারে মেয়েদের উপর অকথ্য যৌন নির্যাতন হয়। পশ্চিমবঙ্গে তখন নকশাল দমন চালাচ্ছে সিদ্ধার্থশঙ্করের পুলিশ।
তারিখটা ছিল ১৯৭৪ সালের আঠারো জুলাই। নকশাল নেতা সৌমেন গুহকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল লালবাজার। না পেয়ে তারা মাঝরাতে তার দিদি, অর্চনা গুহ, যিনি একজন প্রধান শিক্ষক ছিলেন, তাঁকে, আর তাঁর ভাইবউ লতিকা গুহ ও লতিকার আত্মীয়া গৌরী চ্যাটার্জিকে কাশিপুর থানায় তুলে আনে। এক আধ দিন নয়, টানা সাতাশ দিন ধরে কলকাতা পুলিশের কুখ্যাত ডেপুটি কমিশনার রুনু গুহনিয়োগী আর কনস্টেবল সন্তোষ দেব এর হাতে যৌন নির্যাতিত হন অর্চনা, লতিকা আর গৌরী। অর্চনা গুহকে উলটো করে ঝুলিয়ে নিজের হাতে তাঁর যৌনাঙ্গের ভিতরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আঘাত করে তাঁর নিম্নাঙ্গকে অকেজো করে দেন রুনু গুহনিয়োগী। সাতাত্তর সালের একুশে জুন সিদ্ধার্থ শঙ্করের অপশাসন শেষ হলে, ২০ আগস্ট কলকাতার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে অর্চনা গুহদের তরফে রুনু গুহনিয়োগীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়।
ভারতের ইতিহাসে সুদীর্ঘতম সময় ধরে চলা আইনি লড়াইয়ের অন্যতম অর্চনার মামলাটি। এই ঊনিশ শো চুরাশি সালেও সে মামলা চলছে। দাঁতে দাঁত দিয়ে লড়ে যাচ্ছেন নির্যাতিতা প্রধান শিক্ষকের ভাই সৌমেন গুহ। আশ্চর্যের বিষয় বামফ্রন্টের শাসনেও রুনু গুহনিয়োগী প্রশাসনের কাছের মানুষ হিসেবে সুরক্ষা তো বটেই, প্রমোশন পর্যন্ত পেয়েছে।
সাহিত্য সম্রাটের দেবী চৌধুরাণী উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের ষোড়শ পরিচ্ছেদ মনে পড়ে শ্যামলীর।
ভবানী ঠাকুর বলিতে লাগিলেন, প্রফুল্ল শুনিতে লাগিল।
ভবানী, ওজস্বী বাক্যপরম্পরার সংযোগে দেশের দুরবস্থা বর্ণনা করিলেন, ভূম্যধিকারীর দুর্ব্বিষহ দৌরাত্ম্য বর্ণনা করিলেন, কাছারির কর্ম্মচারীরা বাকিদারের ঘরবাড়ী লুঠ করে, লুকান ধনের তল্লাসে ঘর ভাঙ্গিয়া, মেঝ্যা খুঁড়িয়া দেখে, পাইলে একগুণের জায়গায় সহস্রগুণ লইয়া যায়, না পাইলে মারে, বাঁধে, কয়েদ করে, পোড়ায়, কুড়ুল মারে, ঘর জ্বালিয়া দেয়, প্রাণবধ করে। সিংহাসন হইতে শালগ্রাম ফেলিয়া দেয়, শিশুর পা ধরিয়া আছাড় মারে, যুবকের বুকে বাঁশ দিয়া দলে, বৃদ্ধের চোখের ভিতর পিঁপড়ে, নাভিতে পতঙ্গ পূরিয়া বাঁধিয়া রাখে। যুবতীকে কাছারিতে লইয়া গিয়া সর্ব্বসমক্ষে উলঙ্গ করে, মারে, স্তন কাটিয়া ফেলে, স্ত্রী জাতির যে শেষ অপমান, চরম বিপদ্, সর্ব্বসমক্ষেই তাহা প্রাপ্ত করায়। এই ভয়ঙ্কর ব্যাপার প্রাচীন কবির ন্যায় অত্যুন্নত শব্দচ্ছটাবিন্যাসে বিবৃত করিয়া ভবানী ঠাকুর বলিলেন, এই দুরাত্মাদিগের আমিই দণ্ড দিই। অনাথা দুর্ব্বলকে রক্ষা করি।
শ্যামলী ভাবে, ওয়ারেন হেস্টিংস এর সময় থেকে শুরু করে স্বাধীন হওয়া ভারত পাকিস্তানে পুলিশের হাতে নারীর উপর যৌন অত্যাচার ও ধর্ষণ সমানে চলেছে। সাহিত্য সম্রাট হয়তো ধর্ষণ শব্দটা ব্যবহার করেন নি। কিন্তু তিনি যা বলেছেন, সেই ট্রাডিশন সমানে চালু রেখেছে স্বাধীন দেশের পুলিশ।