জ্যেঠু, ইউনিভার্সিটির বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় কেন?
জ্যাঠামশায় টোস্টরুটি খাচ্ছেন। সামনে চা।
জ্যাঠাইমা জিজ্ঞাসা করলেন, খোকা, তুই টোস্টরুটি খাবি?
খোকা বলল, না, আমি খই মুড়কি খেয়েছি। আর ছানা দিয়েছিল।
জ্যাঠাইমা বললেন, তা খেয়েছিস খেয়েছিস। এখন একটু পাঁউরুটি খা।
খোকা বলল, দেখছ একটা দরকারি কথা বলছি। তখন থেকে ভ্যাজরম ভ্যাজরম করছে!
জ্যেঠু, বলো না, বিশ্ববিদ্যালয় বলে কেন?
এই ছেলেটা ঠিক ছোড়দার ধারা পেয়েছে! একটা কথা ভাল মুখে বলতে কি হয়? কতবার বলি, ছোটরা বাপ জ্যাঠার অনুকরণ করে। সাবধানে কথা বলতে শেখো। তো কে শোনে কার কথা!
জ্যাঠামশায় বলছেন, ছাড়ো না, ছেলেমানুষ, ইচ্ছে করলে চেয়েই না হয় খাবে!
খোকা বলল, জ্যেঠু, আমি ভবতারণ সরকার বিদ্যালয়ে পড়ি। আর কলেজের গায়ে লেখা দেখেছি নিস্তারিণী মহাবিদ্যালয়।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জ্যাঠামশায় বললেন, তাহলে মহাবিদ্যালয় মানে কি দাঁড়াল?
খোকা বলল, এ তো বোঝাই যাচ্ছে, কলেজকে বাংলায় মহাবিদ্যালয় বলে।
জ্যাঠাইমা বললেন, কলকাতায় আমার বাপের বাড়ি তোকে নিয়ে যেতাম, মনে আছে তো? সেখানে পাশেই মহাকালী পাঠশালা। পাঠশালা মানেও স্কুল।
খোকা বলে, মোটেও নয়! পাঠশালা একটা অজ পাড়াগেঁয়ে জিনিস। বিচ্ছিরি!
জ্যাঠাইমা বলেন, ও কি বলছিস রে? বিচ্ছিরি হবে কেন? কলকাতার মহাকালী পাঠশালা নামকরা স্কুল। আমি পড়েছি ছোটবেলায়!
খোকা বলে, আমি যেন জানি না? পথের পাঁচালির নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের অপু পাঠশালায় যেত না? বিন্দুর ছেলে পড়েছ? ওখানে ছোটমা ছেলেকে পাঠশালায় যদি কেউ মারে, ভয় পাচ্ছিল না?
জ্যাঠামশায় বললেন, তুমি এগুলো পড়েছ?
খোকা হেসে বলে, পড়ে ফেলেছি।
জ্যাঠাইমা বললেন, পড়ার বই ফেলে গল্পের বই পড়ে। ওইজন্যে তো বাবার কাছে অতো মার খায়। আর তখন কি চেঁচায়! বাড়িতে যেন ডাকাত পড়েছে!
চাণক্য শ্লোকটি মনে পড়ে জ্যাঠামশায়ের। বলেন,
লালয়েৎ পঞ্চবর্ষাণি/ দশবর্ষাণি তাড়য়েৎ/ প্রাপ্তেতু ষোড়শেবর্ষে/পুত্রং মিত্রবদাচরেৎ। জ্যাঠাইমা হাসেন। জ্যাঠামশায় ওই শ্লোকের পরবর্তী অংশটুকু বলেন,
লালনে বহবো দোষাস্তাড়নে বহবোগুণাঃ
তস্মাৎ পুত্রং শিষ্যঞ্চ তাড়য়েন্ন তু লালয়েৎ।
এই মারধোর জিনিসটা আমাদের খুব ক্ষতি করে দিয়েছে। অথচ এই অসভ্যতাটা অনেক আগে ছিল না। গুরু শিষ্য একত্রে বলত, ওঁ সহনাববতু সহ নৌ ভুনক্তু সহ বীর্যং করবাবহৈ। তেজস্বী নাবধীতমস্তু মা বিদ্বিষাবহৈ…
তারপর আধুনিক শিক্ষাবিদরা বললেন, মারধোর করে শেখানো যায় না। পড়ুয়াদের মারধোর করতে দেখলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুব দুঃখ পেতেন।
খোকাকে বলেন, তুমি ইংরেজি পঞ্চাশ সালে জন্মেছ, নভেম্বরের আট তারিখ। ব্রাহ্মমূহূর্ত।তখন পুবের আকাশ সদ্য লাল হয়েছে।
জ্যাঠাইমা বললেন, ছোট আমার কোলে শুয়ে আছে। গাড়িতে সামনে তোমরা দুজন। অত রাতে ব্যথা উঠল। ড্রাইভার আসতে আসতে সকাল হয়ে যাবে। ছোড়দা বলছে, আমি গাড়ি চালাব। তুমি বলছ, তোর এখন টেনশন, আমি চালাব। দুজনে তর্ক বেধেছে। তখন আমি বললাম, তুমি বড়ভাই, তোমার দায়িত্ব বেশি। তুমিই চালাও।
খোকা চুপ করে শোনে।
হাঁসের ডিমসিদ্ধ ছুরি দিয়ে আধখানা করা, পাশে নুন মরিচ। মা এসে দাঁড়াল।
জ্যাঠামশায় স্মৃতিচারণ করছেন, নার্স এসে খবর দিল, আমাদের সবাইকে পেটভরে মিষ্টি খাওয়ান, সুন্দর একটা খোকা হয়েছে।
আমি ভোর হওয়া দেখতে দেখতে বলছি, জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম
ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্ন প্রণতোহস্মি দিবাকরম্।
জ্যাঠাইমা বললেন, তোমরা দুই ভাই নাকি কাঠনাস্তিক! ঠাকুর দেবতা বামুন পুরুত সব একফুঁয়ে উড়িয়ে দেওয়া অভ্যেস। তবু ভোরের আলো দেখে ভেতর থেকে সংস্কৃত শ্লোক বেরিয়ে আসে। হুঁ হুঁ বাবা, মুখে যতো যাই বলো, ভেতরে ভেতরে তোমাদের ঠিক ভক্তি আছে।
জ্যাঠামশায় বলেন, আশ্চর্য তো? সূর্য আমাদের সকল শক্তির উৎস। তাকে সম্মান করব না? সে তো একটা সাংঘাতিক বাস্তব জিনিস। আকাশকুসুম কাল্পনিক জিনিস তো নয়!
খোকা বলল, জবাকুসুম মানে আমি জানি। জবাফুল। কুসুম মানে ফুল। কুসুমের বাস ছাড়ি কুসুমের বাস, বায়ুভরে করে এসে নাসিকায় বাস। মা শিখিয়েছে।
জ্যাঠাইমা বলেন, ওরে, তোর মাকে কে শিখিয়েছে জিগ্যেস কর্। হাঁটুর নিচে নেমে গিয়ে মাটি ছুঁই ছুঁই করত তোর মায়ের চুল। অতো চুল দেখেই আমার পছন্দ হয়ে গেল। এখানেই বিয়ে ঠিক করো ছোড়দা। এই মেয়েই আমার পছন্দ। তোর বাবা বলল, তুমি মানিয়ে গুছিয়ে থাকতে পারলে আমার কিসের অসুবিধে? বললাম, ছোড়দা, তা যেন হল। তবু তুমি দুটি কথা বলে নাও? বলে কি না, তুমি কথা বলেছ, আর ভাবনার কি আছে? সেই তোর মায়ের মাথায় জবাকুসুম তেল মাখাতে বসতাম দুপুরে। বলতাম, কালো যদি মন্দ তবে, কেশ পাকিলে কান্দ কেনে!
জ্যাঠামশায় বললেন, কালো কেশের রাঙা কোসুম হেরেছ কি নয়নে! তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসে আছে।
জ্যাঠাইমা বললেন, তুমি একটা কবিতার বই এনে দিয়েছিলে। অজিত দত্তর।
জ্যাঠামশায় বললেন, কুসুমের মাস। কিন্তু জানো, লাইব্রেরিতে আমি ওই বইটা দেখতে পাচ্ছি না।
জ্যাঠাইমা বললেন, দেখার কথাও নয়। ও বই আমার তোরঙ্গে আছে।
জ্যাঠামশায় বললেন, বই তো লাইব্রেরিতে থাকাই ভাল। সবাই পড়তে পারে।
জ্যাঠাইমা বললেন, এত বই তো আছে। পড়ুক না এগুলো! ওটা আমার নিজস্ব।
মা মৃদু স্বরে বললেন, পুতুল নাচের ইতিকথায় পড়েছি, শশী ডাক্তার বলছে, তোমার মন নাই কুসুম!
জ্যাঠামশায় বললেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়! এই তো ছাপ্পান্ন সালে মারা গেলেন ভদ্রলোক। তেসরা ডিসেম্বর। পুতুল নাচের ইতিকথা ঊনিশ শো ছত্রিশ সালে লেখা। বরানগরে থাকতেন। আটচল্লিশ বছর বয়সেই মারা গেছেন।
জ্যাঠাইমা আফসোস করেন, ইশশ, আটচল্লিশ আবার একটা যাবার বয়স হল?
জ্যাঠামশায় বলেন, ভাল নিউরো স্পেশালিস্ট প্রথম থেকে দেখালে হয়তো বেঁচে যেত। মৃগী ছিল শুনেছি। ড্রিঙ্কও করতেন।
খোকা বলল, আচ্ছা, ফুল না হয় কুসুম বুঝলাম। ডিমের কুসুম বলে কেন?
জ্যাঠামশায় বললেন, ডিম জিনিসটা কি?
খোকা চটপট বলল, টিয়াও না, পায়রা না, ডিম পাড়ো হয় ছানা।
জ্যাঠাইমা বললেন, খোকা আজ ছানা খেয়েছিস বললি না?
খোকা বলল, ওটা তো ডেলি রুটিন। সাতটার সময় ছানা। ন’টার সময় ডিমসিদ্ধ। বাবা তৈরি করেছেন।
খোকা বাবাকে আপনি বলে, অথচ জ্যাঠামশায়কে বলে তুমি।
জ্যাঠামশায় বললেন, দুটো ছানা আলাদা। ডিমের থেকে যে ছানা, তার মানে হল বাচ্চা। আর দুধে অ্যাসিড দিয়ে যে ছানা, ওটা ছিন্ন কথাটা থেকে এসেছিল। ওইজন্যে সেকেলে পণ্ডিতেরা ছানার জিনিস খেতে চাইত না। তাদের ফেভারিট ছিল ক্ষীরের জিনিস।
খোকা বলে, জ্যেঠু, আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু পেলাম না। ডিমের কুসুম বলে কেন?
জ্যাঠামশায় বললেন, আরে, তুমি ওই কবিতাটা শোনো নি,
ফুল কহে ফুকারিয়া ফল ওরে ফল,
কতদূরে রয়েছিস বল মোরে বল…
মা বললেন,
মহাশয়, মিছে ডাকাডাকি
তোমারি অন্তরে আমি চিরদিন থাকি।
জ্যাঠামশায় বলেন, ফুল হল গাছের যৌনাঙ্গ। ওটাই ফল হয়ে ওঠে। ফলের ভিতর থাকে বীজ। সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে আবার গাছ।
জ্যাঠাইমা বলেন, সবকিছু এখনই শিখিয়ে দিও না। ডেঁপো হয়ে যাবে।
জ্যাঠামশায় বললেন, ডিমের কুসুমটাই বাচ্চা হয়ে ওঠে।
খোকা বলল, আর শাদাটা?
সেটা ওই বাচ্চার প্রাথমিক পুষ্টি যোগায়।
খোকা বলল, আর বিশ্ববিদ্যালয় বলে কেন, সেইটা তো বললে না?
জ্যাঠামশায় বলেন, আগে বলো ইউনিভার্স মানে কি?
খোকা বলে, ইউনিভার্স মানে বিশ্ব।
জ্যাঠামশায় বলেন আর ওখানে পড়াশুনা হয়, বিদ্যাচর্চা হয়, তাই বিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করতে হয়। বিশ্বকে আপন করতে শেখাই আসল শিক্ষা। আমরা প্রকৃত বিদ্যার্থীরা কোনো নির্দিষ্ট দেশের লোক নয়, নির্দিষ্ট জাতির সদস্য নয়, আমরা সারা বিশ্বের। ওইজন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী নাম দিলেন। যত্র বিশ্ব ভবত্যেকনীড়ম। যেখানে বিশ্ব একটি নীড়ে মিলেছে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ্বনাগরিক।
খোকা বলল, তাহলে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি করে দিলেই তো ঠিক হত!
মা বললেন, কি ছেলেমানুষি করছিস? এখন সবে ক্লাস ফাইভ। স্কুল ফাইনালের বেড়া ডিঙোও। তার পর প্রি ইউ। তবে না ভার্সিটি?
জ্যাঠাইমা বললেন, কি যে বলিস ছোট! ছেলেমানুষ ছেলেমানুষি করবে না তো কি বাড়ির কর্তাব্যক্তিরা করবে?
খোকা মায়ের কাছে জানতে চায়, ভার্সিটি আবার কি জিনিস?
মা হেসে বললেন, আমাদের কলেজ হোস্টেলে ওপার বাংলার অনেক মেয়ে পড়ত। ওরা ইউনিভার্সিটিকে বলত ভার্সিটি।
জ্যাঠাইমা বললেন, আমার বাপের বাড়ির কাছে একটা ইসকুল আছে, ওটা কলেজিয়েট স্কুল।
জ্যাঠামশায় বললেন, স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল।
খোকা বলল, কলেজিয়েট কেন?
জ্যাঠামশায় বললেন, ওটা যে কলেজের সঙ্গে জড়িয়ে। তাই কলেজিয়েট।
মা বললেন, স্কটিশচার্চ কলেজ দেখেছি। সুভাষচন্দ্র বসু ওখানে পড়েছেন। বিবেকানন্দও।
জ্যাঠামশায় বললেন, ওর নাম আগে ছিল জেনারেল অ্যাসেম্বলি। আলেকজান্ডার ডাফ সাহেব মে মাসে কলকাতায় এলেন, তারপর ১৮৩০ সালের জুন মাসের তেরো তারিখে জেনারেল অ্যাসেম্বলি গড়লেন। প্রথমে জোড়াসাঁকোর ওদিকে আপার চিৎপুর রোডে ছিল। কমল বসু জমি দিয়েছিলেন। ১৮৩৬ সালে ওটা উঠে এল গোরাচাঁদ বসাকের গরাণহাটার বাড়িতে। ১৮৩৭ এ দায়িত্ব নিলেন ম্যাকফারলন। তিনি কলকাতার চিফ ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ১৮৩৯এ বাড়ি কমপ্লিট হল।
তার নব্বই বছর পরে ১৯২৯ সালে জেনারেল অ্যাসেম্বলির নতুন নাম হল স্কটিশচার্চ কলেজ। বাঙালির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেশি বিদেশি সবার ভালবাসা মিশেছে। ডাফ, বেথুন, ডেভিড হেয়ার, স্যর হাইড ইস্ট, উইলিয়াম কেরি, বেন্টিঙ্ক আর রামমোহন বিদ্যাসাগর
মা বললেন, ডিরোজিও।
জ্যাঠামশায় বললেন, উনি বাংলা ভূমির সর্বকালের সেরা শিক্ষক।
খোকা বলল, জ্যেঠু, অ্যাসেম্বলি মানেও স্কুল?
জ্যাঠাইমা বললেন, ইনস্টিটিউশন মানেও স্কুল। যেমন মিত্র ইনস্টিটিউশন, তীর্থপতি ইনস্টিটিউশন।
মা বললেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিছু দিন পড়েছিলেন ওরিয়েন্টাল সেমিনারীতে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির উলটো দিকেই।
সেমিনারী মানেও স্কুল।
খোকা বলে, আমার একটা বই আছে, বিশ্বপরিচয়। বিশ্ব নিয়ে অনেক কিছু লেখা আছে ওখানে। সূর্য থেকে আলো আমাদের পৃথিবীতে আসতে সাড়ে আট মিনিট সময় লাগে। সেকেণ্ডে একলক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল স্পিডে ছুটে তবে সাড়ে আট মিনিটে পনের কোটি কিলোমিটার পাড়ি দিচ্ছে। আর জানো জ্যেঠু, চাঁদের থেকে আলো আসতে পুরো দেড় সেকেণ্ডও লাগছে না। কিন্তু অনেক দূরের গ্রহ ঠিকমতো সূর্যের তাপটাও পায় না। তাই ওরা বরফ হয়ে আছে।
জ্যাঠামশায় বললেন, নাম কি ওদের?
খোকা বলে, ইউরেনাস আর নেপচুন। দুটো আইস জায়েন্ট।
জ্যাঠামশায় বললেন, রোদের তাপ যায় না বলে বরফ হয়ে আছে?
খোকা বলে, হুঁ।
জ্যাঠামশায় বললেন, রোদ পড়লে খুব গরম হয়, তাই না?
খোকা বলল, হুঁ। গরমের সময় দুপুরে বেরোতে নেই। বাড়িতে বসে ডাব, শসা, তালশাঁস, তরমুজ খেতে হয়।
জ্যাঠাইমা বললেন, পেটুক দামু। সব সময় খাবারের গল্প।
জ্যাঠামশায় ইঙ্গিতে জ্যাঠাইমা কছ থামিয়ে বললেন, তাহলে, পৃথিবীর মেরুপ্রদেশে, হিমালয়ের মাথায়, আল্পসের চূড়ায় চূড়ায়, সাইবেরিয়ায় সারা বছর বরফ কেন? মাউন্ট কিলিমানজারোর চূড়াতে বরফ থাকে কেন?, ওটা তো আফ্রিকার তানজানিয়াতে, ৫৮৯৫ মিটার উঁচু। বিষুবরেখার কাছাকাছি। তাহলে ওর মাথায় সারা বছর বরফ কেন?
বাবা এসে দাঁড়িয়েছেন। খোকা দাঁড়িয়ে উঠল। জ্যাঠাইমা খোকার বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, বেশ চলছিল জ্যেঠুর সঙ্গে আড্ডা। তুমি এলে মূর্তিমান রসভঙ্গ হয়ে।
খোকার বাবা বললেন, না এখানে লেখাপড়াই তো হচ্ছিল। আমার কানে যাচ্ছিল। শোনো খোকা, দূরের জন্য তাপ কমে, এটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য, বাতাস পাতলা হলে, তাপ ধরে রাখতে না পেরে ঠাণ্ডা হয়। ওইজন্য পর্বতের চূড়ায় সারাবছর বরফ থাকে। আর রোদ্দুর কোণাচে হয়ে পড়লেও তার তাপ কমে যায়। তাই মেরুপ্রদেশে সবসময় বরফ।
জ্যাঠামশায় বললেন, সত্য অনেক রকম। বহুমাত্রিক, বহুকৌণিক।
বাবা বললেন, খোকা, এবার চলো, কালেকটিভ নাউন পড়তে হবে।
জ্যাঠাইমা বললেন, দাঁড়াও বাপু, কতদিন বাদে সবাই মিলে এই ঘরে জমিয়ে আড্ডা হচ্ছে, একটু বোসো দেখি। তালশাঁস আনিয়েছি। তোমার ছেলে খাবে বলছিল।
খোকা বলল, আমি কখন বললাম?
জ্যাঠামশায় বললেন, তুমি না উচ্চারণ করলেও জ্যাঠাইমা শুনতে পেয়েছেন। উনি তোমাকে জন্মের আগে থেকে চেনেন।
জ্যাঠাইমা বললেন, এই যে আমাদের পরিবারের সদস্যরা সবাই একঘরে বসেছি, এটাই কালেকটিভ নাউন। খোকার মনে হল, এখানে সবার মধ্যে অনুটাও থাকলে ঠিক হত।
জ্যাঠামশায় বললেন কালেকটিভ নাউন খুব সোজা। গ্যাগল অফ গীজ, লিটার অফ পাপিজ, ফ্লক অফ ডাকস, প্রাইড অফ লায়নস্, প্যাক অফ উলভস, মার্ডার অফ ক্রোজ…
বাবা বললেন, শোল অফ ফিশ।
জ্যাঠামশায় বললেন, যখন নানা রকম মাছ ঘোঁট পাকিয়ে থাকে, তাকে বলতে হবে শোল অফ ফিশ। আর যদি একই প্রজাতির মাছ, একই রকম ভাবে সাঁতার কাটে, একই রকম ভাবে মোড় নেয়, চলার ছন্দ এক রকম হলে, তাকে বলতে হবে, স্কুল অফ ফিশ।
খোকা বলল, কি আশ্চর্য, মাছেদেরও স্কুল!
মা বললেন, এটা স্কুল অফ দাশগুপ্ত’জ। এখানে আমরা একই ভাবে একই লক্ষ্যে বাঁচতে চাইছি। তারপর গেয়ে উঠলেন, পাখিদের ওই পাঠশালাতে কোকিল গুরু শেখায় গান, ময়না ভালো গান শিখেছে, শুনলে পরে জুড়ায় প্রাণ!..
জ্যাঠাইমা বাবার হাতে তালশাঁসের বাটি দিতে দিতে বলল, কি মিষ্টি করে গানটা গেয়েছিল। তাতেই তো পছন্দ হয়ে গেল। ছেলে বড় হচ্ছে, আবার গানে বসা শুরু কর্ তো।
বাবা বললেন, দাদা, খোকা বড় হচ্ছে। তাই আর বাবা মায়ের সাথে একঘরে শোয়া ঠিক নয়। ওর জন্য একটা চৌকি বানাতে দিয়েছি।
জ্যাঠামশায় বললেন, আমার ডিভানটা তো আছেই। ওটাই তো কাজে লাগাতে পারতিস।
বাবা বললেন, না, এবার ওর জন্মদিন উপলক্ষে কিছু দেওয়া হয় নি। এই চৌকি ও গোছাবে, মশারি ও খাটাবে। স্বনির্ভর হবে। লাইব্রেরি ঘরের কোণে চৌকি রাখা থাকবে। আর দুবেলা লাইব্রেরি ঘরের মেঝে সাফ করবে।
জ্যাঠাইমা রেগে বললেন, তাহলে বাড়ি থেকে কাজের লোক সব বিদেয় করো। ওইটুকু খোকা ঘর মুছবে, বাসন ধোবে।
খোকা ভাবল, এ বেশ হবে। নিজস্ব একটা কোণ। নিজস্ব বিছানা। শুধু অনুটা পাশে থাকলে বেশ হয়। জ্যাঠামশায় বলছিলেন ফুল হল গাছের যৌনাঙ্গ। অপরাজিতা গাছের ফুলের মতো যৌনাঙ্গ অনুর। দেখে দেখে আশ মেটেনি। এনসাইক্লোপিডিয়াতে কত ছবি। বত্তিচেল্লির বার্থ অফ ভেনাস, মাতিস, ক্লদ, মনে, মিকেল্যাঞ্জেলোর কত কাজ। অনুকে ওইভাবে দেখতে ইচ্ছে করে। অনু অনু অনু।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন