জেমস ক্লার্ক ম‍্যাক্স‌ওয়েল : প্রয়াণ দিবসে স্মরণলেখ || মৃদুল শ্রীমানী

শুক্রগ্রহে একটা পর্বত আছে তাঁর নামে। আরো বলতে ইচ্ছে করে, তাঁর পূর্বে জন্মানো যে সকল বিজ্ঞানসাধক বিদ্যুৎ ও চুম্বক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন, তার সমস্তটুকু আত্মস্থ করে তাকে কুড়িটি গাণিতিক সূত্রের আকারে তিনি উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু এতেও সমস্তটুকু বলা হয়ে ওঠে না। জেমস ক্লার্ক ম‍্যাক্স‌ওয়েল নামে স্কটিশ বিজ্ঞানভাবুক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ভাবনা ও বিচারধারাটাকেই বদলে দিয়েছিলেন। আলো তাপ চৌম্বক ও গতিশক্তির ভিতরে এক অভিন্ন শক্তির অস্তিত্ব দেখান ম‍্যাক্স‌ওয়েল সাহেব।
আমরা মনে করে দেখতে পারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন,
আমার অঙ্গে সুরতরঙ্গে ডেকেছে বান,
রসের প্লাবনে ডুবিয়া যাই…
বলেন,
মেঘলা আকাশে উতলা বাতাসে খুঁজে বেড়াই
বনের গাছে গাছে জেগেছে ভাষা ভাষাহারা নাচে…
বলেন,
ঝড়ের রথে অগম পথে জড়ের বাধা যত করো উন্মূলন
জ্বালো জ্বালো বিদ্যুৎ শিখা জ্বালো,
দেখাও তিমির ভেদী দীপ্তি তোমার দেখাও।
দিগ্বিজয়ী তব বাণী দেহো আনি..
বলেন,
পিয়ে উচ্ছল তরল প্রলয়মদিরা উন্মুখর তরঙ্গিণী ধায় অধীরা
কার নির্ভীক মূর্তি তরঙ্গদোলে কলমন্দ্ররোলে..
বলেন,
দেখা না-দেখায় মেশা হে বিদ্যুৎ লতা,
কাঁপাও ঝড়ের বুকে একি ব‍্যাকুলতা।।
বিদ্যুৎ আলো শব্দ আর গতি যেন এক রহস‍্যময়ী বিশ্বশক্তির রূপে দেখা দেয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলমে। আর রবীন্দ্রনাথ যখন নিতান্তই দুই তিন বৎসরের শিশু, সেই সময় এক পদার্থবিজ্ঞানসাধক গণিতের সূত্র ধরে গতিবান তড়িৎ চৌম্বক ক্ষেত্রের ধর্ম লক্ষ্য করে ছিলেন। তিনি জেমস ক্লার্ক ম‍্যাক্স‌ওয়েল (১৮৩১ – ১৮৭৯)।
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তাঁর অবদানকে বিপুল স্বীকৃতি দিয়েছেন। বলেছেন, তাঁর আপেক্ষিকতাবাদের গবেষণার ভিত্তিমূলে দাঁড়িয়ে আছে ম‍্যাক্স‌ওয়েল এর অবদান। আজ পাঁচ নভেম্বরে, প্রয়াণদিবসে জেমস ক্লার্ক ম‍্যাক্স‌ওয়েলকে গভীর শ্রদ্ধাসহকারে স্মরণ করি। ১৮৩১ সালে স্কটল্যান্ড এর এডিনবরায় জন্মেছিলেন তিনি। সেটা মার্চ মাসের আঠারো তারিখ। ছোটবেলায় চলে যান গ্রামে। সেখানে প্রকৃতির নিবিড় কোলে অপার সম্ভাবনা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করতেন বালক। ছোটো থেকেই চারপাশের জিনিস নিয়ে কৌতূহল ছিল তাঁর। আর ছিল অঙ্কে গভীর আগ্রহ। অঙ্কের ব‍্যাপারে এই ব‍্যুৎপত্তিই তাঁকে অসাধারণ করে দিয়েছিল।
পদার্থবিজ্ঞানের জটিল তত্ত্বকে বুঝতে ও বোঝাতে , যুক্তিসঙ্গত ব‍্যাখ‍্যা যোগাতে গাণিতিক প্রমাণের ভূমিকা প্রশ্নাতীত। এইভাবে ম‍্যাক্স‌ওয়েল পূর্বজ পদার্থবিজ্ঞানীদের আবিষ্কারকে বিশ্লেষণ করে সমন্বয় সাধন করে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটান।
আট বছর বয়সে মাতৃহারা হয়ে তিনি গ্রামের পরিবেশ ছেড়ে এডিনবরায় ফিরে আসেন। এডিনবরা অ্যাকাডেমিতে পড়াশুনা করতে থাকেন। চৌদ্দ বছরের কিশোর ম‍্যাক্স‌ওয়েল পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র লিখে ফেলেন। সেটি এডিনবরা রয়াল সোসাইটির অধিবেশনে পঠিত হয়। তখনই অভিজ্ঞ শিক্ষক ও অধ‍্যাপকবৃন্দ টের পেয়েছিলেন, কিশোর ম‍্যাক্স‌ওয়েল এর মধ‍্যে একটা গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সক্ষমতা বর্তমান।
বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক হয়ে তিনি পড়াশুনা করতে গেলেন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপরের পড়াশুনা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৮৫৬ সালে তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। তখন তাঁর পঁচিশ বছর বয়স। ওই সময়েই আবারদীনের মারিসচাল কলেজে পদার্থবিজ্ঞানে অধ‍্যাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৫৭ সালে শনিগ্রহের অসামান্য দৃষ্টিনন্দন বলয় নিয়ে গবেষণা করে সিদ্ধান্ত নেন, শনির বলয়গুলি কঠিন বস্তুকণা দিয়ে তৈরি। অনেক পরে নাসার ভয়েজার স্পেসক্রাফট শনিগ্রহের কাছে গিয়ে দেখে জেনে বুঝে ম‍্যাক্স‌ওয়েল এর সিদ্ধান্তের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছে। ১৮৬০ সালে লণ্ডনের কিংস কলেজে ন‍্যাচারাল ফিলজফি ডিপার্টমেন্টে অধ‍্যাপনার দায়িত্ব নিলেন। এখানে তড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্র নিয়ে গবেষণা করতে করতে প্রমাণ করলেন, ইলেকট্রো ম‍্যাগনেটিক ফিল্ডের গতি আলোর বেগের সঙ্গে তুলনীয়। বললেন, আলো বাস্তবে একটি তড়িৎ চুম্বকীয় শক্তি। ১৮৬৪ সালে প্রকাশ পেল তাঁর গবেষণা গ্রন্থ “এ ডা‌ইনামিক‍্যাল থিওরি অফ দি ইলেকট্রোম‍্যাগনেটিক ফিল্ড”। ১৮৬৫তে কিংস কলেজ ছেড়ে চলে যান। তারপরে মাঝে মধ্যে কেমব্রিজে ফিজিক্স পড়িয়ে যেতেন। ১৮৭৩ সালে ম‍্যাক্স‌ওয়েল এর ব‌ই বেরোলো “এ ট্রিটিজ অন ইলেকট্রিসিটি অ্যাণ্ড ম‍্যাগনেটিজম”। ওতে তিনি কুড়িটি ইকুয়েশনের আকারে সেই সময় পর্যন্ত তড়িৎ চৌম্বক শক্তি বিষয়ে যা কিছু জ্ঞান আহরিত হয়েছিল, তা প্রকাশ করেন। পদার্থবিজ্ঞান গবেষণার এই গাণিতিক সূত্র পরবর্তীকালে এই শাখার ভাবনা বিকাশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে দিল। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী অলিভার হেভিসাইড (১৮৫০ – ১৯২৫) ম‍্যাক্স‌ওয়েল সাহেবের দেওয়া এই কুড়িটি সূত্রকে ঝাড়াই বাছাই করে সর্বমোট চারটি সূত্রে গোটা বিষয়কে সংহত করলেন। বললেন, আলো তাপ চৌম্বকত্ব ইত্যাদি শক্তিগুলির গভীরে এক‌ই অভিন্ন শক্তি কাজ করে, এবং তা হল তড়িচ্চৌম্বক শক্তি। এই পথেই বিকশিত হল পরবর্তীকালের টেলিভিশন, রাডার ও রেডিও। এমনকি বিকশিত হল আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা চলে পরবর্তী সময়ের পদার্থবিজ্ঞানচর্চার ধারার মৌলিক বাঁকবদল ঘটিয়ে দিলেন তিনি।
১৮৭৯ সালে মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে আজকের দিনে এই মহান বিজ্ঞানসাধকের জীবনাবসান হয়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।