সবিতাপিসি বললেন, দোকানের মালিক? না, সে এখানে আসবে না। সন্ধে রাত্তিরে দোকান বন্ধ করে চলে যাবার আগে তার জন্য রুটি গড়ে দিয়েছি। আলুরদম আর ঘুগনি ছিল, তাই নিয়ে গেছে। বাদ দে তার কথা। তোকে এখন কি খেতে দিই বল্ তো।
শ্যামলী বলল, তুমি যে বলেছিলে লোকটা ভাল!
সবিতা বলল, আমি কি একবারও বলেছি, লোকটা খারাপ?
শ্যামলী বলল, আমি ভেবেছিলাম, তুমি, তোমরা একসাথে থাকছ।
সবিতা বলল, কালকে আলুরদম করব বলে আলুসেদ্ধ করা আছে। দুটি মুড়ি দিয়ে তাই খা না মা? নইলে ডিম ছিল, কিন্তু এত রাত্তিরে আঁচ দিই কি করে?
শ্যামলী বলল, না খেয়ে থাকলে কি হবে পিসি? জানো, আমাদের দেশে কত লোক রাতে খালি পেটে শুতে যায়?
লঙ্কা পেঁয়াজ কুচোতে কুচোতে সবিতা বলল, জানি না বাপু। আর আমার জেনেও কাজ নেই।
শ্যামলী বলল, আমাদের দেশে মাটির গভীরে কতকিছু জিনিস। ঝরিয়া রানিগঞ্জে কয়লা, আসামে, বোম্বে, গুজরাটে তেল, কত লোহা, সোনা অবধি পাওয়া যায়। কিন্তু সব বড়লোকের দখলে। দেশ সব্বার, কিন্তু দেশের জিনিসপত্র সব বড়লোকের দখলে।
আলুসেদ্ধ, আর মুড়ি, পেঁয়াজ কুচি আর কাঁচা লঙ্কা মেখে শ্যামলীর হাতে দিয়ে সবিতা বললেন, নাও। দুটো মুখে দিয়ে উদ্ধার করো মহারানি।
শ্যামলী গোঁ ভরে বলল, আমার জন্য তুমি এত খাটতে গেলে কেন পিসি?
সবিতা বললেন, আ খেলে যা! তোদের জন্যেই তো চিরটাকাল খেটে গেছি। অমন দামড়া দুটো ছেলে নিজেদের পরা জাঙিয়াগুলো অবদি কাচতে চাইত না। অবিশ্যি বাঙালির ঘরে ছেলেরা কজনই বা নিজের নিজের জাঙিয়া কাচে?
সবিতা বললেন, তুই আমায় এই মাঝ রাত্তিরে আর বকাস্ না তো। আলুসেদ্ধটা লোহার কড়াইয়ে থলে চাপা ছিল। তাই এখনো গরম আছে। মুড়ি আর আলুসেদ্ধ দিয়ে মহারানির ডিনার হচ্ছে!
শ্যামলী বলল, জানো পিসি, রাজার বৌ, মারি আঁতোয়ানেৎ, সে বলেছিল, ওরা রুটি পায় না তো কেক খায় না কেন?
সবিতা রাগ করে বলল, মরণদশা মাগির! গরিব মানুষের রুটিই জোগাড় করা শক্ত। কেক তো অনেক দূরের জিনিস!
শ্যামলী বলল, ওই তো বলে কে! রাজার বাড়ির সেই রানিটার কথা যেই লোকেদের কানে গেল, তারপর অমনি তারা খেপেটেপে গিয়ে বিপ্লব করে ফেলল।
সবিতা গম্ভীর হয়ে বললেন, তার পর কি হল?
শ্যামলী বলল, ফরাসি বিপ্লব। ১৭৮৯ সাল! মে মাসে বিপ্লব শুরু হল। জুলাই মাসে বাস্তিল দুর্গ দখল করে নিল বিপ্লবী জনতা।
সবিতা কড়া চোখে জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর কি হল?
শ্যামলীর মনে হল, চৈতন্য মহাপ্রভু রায় রামানন্দকে বলছেন, এহো বাহ্য, আগে কহো আর। চৈতন্য চরিতামৃতে কৃষ্ণদাস কবিরাজ অতুলনীয় দক্ষতায় একটি চমৎকার দিসকুর এঁকেছেন।
পিসিকে সে বলল, একুশে জানুয়ারি, ১৭৯৩ সালে আটত্রিশ বছর বয়সী রাজা ষোড়শ লুইয়ের মুণ্ডচ্ছেদ করল বিপ্লবী জনতা।
পিসি মুখে কিছু না বলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন।
শ্যামলী আবার বলল, রানি মারি আঁতোয়ানেৎ এরও মুণ্ডচ্ছেদ হল। চৌদ্দ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল। মে মাস। ১৭৭০ সাল। তারপর, তার বর সম্রাট হল, ১৭৭৪ এ, মে মাসের দশ তারিখ। তখন সে রানি হয়েছিল। সাঁইত্রিশ বছর বয়সে ১৭৯৩তে, অক্টোবর মাসের দশ তারিখে তারও মুণ্ডচ্ছেদ হল।
পিসি একটা ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন। জিজ্ঞাসা নেচে নেচে বেড়াচ্ছে দুচোখে। আগে কহ আর!
শ্যামলী বলল, লিবার্তে, ফ্রাতারনিতে, ইগালিতে।
পিসি বললেন, গালি দিচ্ছিস না কি?
শ্যামলী সচকিত হয়ে বলল, গালি দেব কেন? এগুলো গালি হল?
পিসি বললেন, কি জানি বাপু, লোকে বলে, এক দেশের বুলি, অন্য দেশের গালি।
শ্যামলীর মনে পড়ল, একদিন একজন বয়স্ক মানুষ দুঃখ করে বলেছিলেন, বাঙালির ছেলেরা কথা বলতে গিয়ে এত রকম অপভাষা অসাড়ে বলে ফেলছে যে ভাবা যায় না।
পিসিকে সে বলল, লিবার্তে মানে মুক্তি, যন্ত্রণা থেকে রেহাই। ফ্রাতারনিতে মানে মৈত্রী, মানে বন্ধুত্ব। আর ইগালিতে মানে স্বাধীনতা।
পিসি মজা করে বললেন, তাহলে আর বাকি রইল কি?
শ্যামলীর মনে পড়ল, ১৭৯৩ তে ষোড়শ লুইয়ের মুণ্ডচ্ছেদ হবার আগে ১৭৯১তে মেয়েদের অধিকার ঘোষণার দাবিতে কলম ধরেছেন মহিলা লেখক অলিম্পে দে গজেস। শ্যামলী লেখিকা বলে না। লেখক বলে। লিঙ্গ নিরপেক্ষতা। অলিম্পে ডিভোর্স এর আইন দাবি করলেন। যে বিয়ের সম্পর্ক আমি মেনে নিতে পারছিনা, সেখানে আমাকে বাঁধা থাকতে হবে কেন? ডিভোর্স এর আইন চালু করো। আর বললেন, সন্তান সন্তানই। তার আবার বৈধ অবৈধ কিসের? সব শিশুসন্তান সমান। প্রতিটি সন্তানকে জন্ম দিতে মাকে জান বাজি রাখতে হয়। তাদের সমান সামাজিক সম্মান নিশ্চিত করতে হবে। ১৭৯৩তে মেয়েদের বামপন্থী মনোভাবাপন্ন বলিষ্ঠ সংগঠন দাবি করল রুটির দাম গরিবের ধরা ছোঁয়ার মধ্যে রাখতে হবে।
বিপ্লবী জ্যাকোবিনদের এসব দাবি ভাল লাগল না। লিবার্তে ইগালিতে বলতে বলতে মেয়েরা যা নয় তাই দাবি করছে! সম্রাটের মুণ্ডচ্ছেদ হয়ে গেলে জ্যাকোবিনদের নেতা হয়ে উঠলেন ম্যাকসিমালিয়েন রোবসপীয়র, দাঁতো, মিরাব্যু, সব বাঘা বাঘা বিপ্লবী নেতা। তাঁরা মেয়েদের কথা বলার অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন। তোমরা মেয়েরা আবার জ্যাকোবিন ক্লাবের সদস্য হবে কি করে? আলোচনায় অংশগ্রহণ? ছোঃ, প্রশ্নই ওঠে না! ওই দূরের বারান্দায় বসে বসে শুনতে চাও তো শুনতে পারো। তবে কথা টথা, ট্যাঁ ফোঁ চলবেনা।
বিপ্লবী আইনসভার সমস্ত সদস্যই ছিলেন পুরুষ। তাঁরা বিপুল পরিমাণ ভোটে আইন প্রণয়ন করলেন যে, মেয়েদের যাবতীয় সাংগঠনিক সত্তা ও দলবদ্ধ কার্যকলাপের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হইল। বিপ্লবের স্বার্থে মেয়েদের সমস্ত ধরনের সংগঠন নিষিদ্ধ করা হইল। ১৭৯১ তে মেয়েদের সক্রিয়ভাবে নাগরিকের অধিকার অর্জনের দাবি নস্যাৎ করে দিয়েছেন বিপ্লবী নেতৃত্ব। আর ১৭৯৩ তে মেয়েদের গণতান্ত্রিক অধিকারটুকুও নস্যাৎ করে দিলেন তাঁরা। বলে দিলেন, বলা ভালো, আচ্ছা করে কড়কে দিলেন, পুরুষরা মেয়েদের জন্য যেটা ভালো বলে গণ্য করে, সেটাই নিশ্চুপে, নির্বিবাদে মেনে নিতে মেয়েরা বাধ্য। অক্টোবরের ত্রিশ তারিখে জ্যাকোবিনরা আইন করে বললেন, মেয়েদের বাড়ির বাইরে বেরোনো বারণ। তারা বাচ্চা প্রসব করবে, বুকের দুধ খাওয়াবে, ঘরকন্না দেখবে, ব্যস। সামাজিক ও জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় যা কিছু বিষয়, সবকিছুই পুরুষরা সামলাবে।
কি গো মেয়ে, হিটলারের গলা শুনতে পাচ্ছ?
এক মহিলা লেখক, মাদাম মারি রোল্যাণ্ড আর্তনাদ করে বললেন, ওহ্ মুক্তি, তোর নাম জপতে জপতে কত না ঘৃণ্য অপরাধ হয়ে চলেছে, ধন্য আশা কুহকিনী!
চার্চের বড় ঘড়িতে একটা ঘণ্টা পড়ল। ছয় তারিখ শেষ হয়ে নভেম্বরের সাত তারিখ শুরু হয়ে গেছে একঘণ্টা হল।
পিসি তার চিবুকে আদর করে হাত ছুঁইয়ে বললেন, আহা, বাছা আমার, গলাটা তোর শুকিয়ে গেছে।
শ্যামলীর মনে পড়ল, ত্রাসের ভূতনৃত্যের মহানায়ক ম্যাকসিমিলিয়েন রোবসপীয়র এর পতন ঘটল ১৭৯৪ সালে। জর্জ দাঁতো, ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম মহানায়ক, জনগণের সুরক্ষা কমিটির ফার্স্ট প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে জঘন্য আর্থিক দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ উঠেছিল। চৌত্রিশ বছর বয়সে, ১৭৯৪ এর ৫ এপ্রিল তারিখে দাঁতোর প্রাণ গেল গিলোটিনে। বিপ্লবের প্রাণসত্তা জ্যাকোবিন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, জনগণের সুরক্ষা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, বিপ্লবী বিচারালয়ের সংগঠক, ম্যাকসিমিলিয়েন রোবসপীয়র ছত্রিশ বছর বয়সে গিলোটিনে প্রাণ হারালেন। তারিখটা ছিল জুলাই মাসের আঠাশ। ১৭৯৪ সাল। গিলোটিন কাউকে ছাড়ে নি। ষোড়শ লুইয়ের মুণ্ডচ্ছেদ হবার পর ঊনিশ মাসের মধ্যে বিপ্লবের মহানায়কদের গিলে খেল গিলোটিন। পাপ বাপকে ছাড়ে না।
১৭৯৫ তে ডাইরেকটরি ক্ষমতা দখল করল। ১৭৯৯ তে ডাইরেকটরির খেলা শেষ। কনসুলেট এল ক্ষমতায়। নামে মাত্র। আড়ালে ছিলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। একটা অভ্যুত্থান বা ক্যু ঘটিয়ে তিনি হলেন সম্রাট। ফ্রান্সের সম্রাট। সালটা ১৭৯৯। শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন এক দশকে সঙ্ঘ ভেঙে যায়। বলতেই পারতেন, এক দশকে বিপ্লব নিভে যায়।
জীবনানন্দ দাশ বলছেন,
ওইখানে কেউ নেই।
মৃত্যু আজ নারীনর্দামার ক্বাথে;
অন্তহীন শিশুফুটপাতে;
আর সেই শিশুদের জনিতার কিউক্লীবতায়।
সকল রৌদ্রের মতো ব্যাপ্ত আশা যদি
গোলকধাঁধায় ঘুরে আবার প্রথম স্থানে ফিরে আসে
শ্রীজ্ঞান কী তবে চেয়েছিলো?
সূর্য যদি কেবলি দিনের জন্ম দিয়ে যায়,
রাত্রি যদি শুধু নক্ষত্রের,
মানুষ কেবলি যদি সমাজের জন্ম দেয়,
সমাজ অস্পষ্ট বিপ্লবের,
বিপ্লব নির্মম আবেশের,
তা হ’লে শ্রীজ্ঞান কিছু চেয়েছিলো?
নগরীর সিঁড়ি প্রায় নীলিমার গায়ে লেগে আছে;
অথচ নগরী মৃত।
সে-সিঁড়ির আশ্চর্য নির্জন
দিগন্তরে এক মহীয়সী,
আর তার শিশু;
তবু কেউ নেই।
পিসি হাই তুলে বললেন, শ্যামলিমা, ঘুমিয়ে পড়্। ঘুমিয়ে পড়্। ভোরের বেলা ডেকে দেব। তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসে ছিষ্টির কাজ আছে। শ্যামলী রেগে উঠে বলল, যাব না, বলেইছি তো।
সবিতা রাগ করে বলল, হ্যাঁ, তোমার মতো আগুনপারা মেয়েকে আমি আঁচলের তলায় ঢুকিয়ে রাখব! পারবি তুই ওই কলতলায় চান করতে, পারবি নর্দমার ধারে বসে হাগতে?
শ্যামলী পিসির মুখ চেপে ধরল। বলল, চুপ করবে কি না?
সবিতা বললেন, আমি চুপ করে থাকলেই তো সমিস্যে মিটে যাবে না!
শ্যামলী পিসিকে রাম চিমটি কেটে তার কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে দিল।