• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৭)

আমার কথা

২৫
পাণ্ডবেরা যখন অজ্ঞাতবাসে ছিল, তখন তাদের গোপনে মেরে ফেলার জন্য দুর্যোধনের উদ্যোগে কৌরবেরা সক্রিয় ছিল। কৌরবদের তরফে লাক্ষা দিয়ে একটা বাড়ি বানিয়ে সেখানে পাণ্ডবদের বসবাসের ব্যবস্থা হয়। বাড়িটিতে ঢোকার সময়েই পাণ্ডবেরা লাক্ষার গন্ধ পেয়ে দুর্যোধনের কুপ্রবৃত্তি আঁচ করতে পারেন। তার পর নিজেরাই ওই জতু গৃহে আগুন লাগিয়ে গা ঢাকা দেন।
তার আগে একটি খাওয়া দাওয়ার আয়োজন হয়েছিল। গরিব গুরবোরা খেতে এসেছিল। একটি দলিত পরিবারের পাঁচ ছেলে মা সহ ওই জতুগৃহে থেকে যায় ও পুড়ে মরে। তাদের পোড়া শরীর দেখে যাতে দুর্যোধনেরা নিশ্চিন্ত হয়, এমন একটা বোকা বানানোর কৌশল পাণ্ডবদের তরফে নেওয়া হয়েছিল।
দলিতেরা পুড়ে মরলে আসলে কোনো ক্ষতি হয় না। কেন না, তারা শূদ্র এবং ব্রহ্মার শরীরের পা থেকে জন্মেছে। শূদ্র ভারত এই রকমই । তার পুড়ে মরায় বা ধর্ষিত হওয়ায় বা বিবস্ত্র করে ঘোরানোয় প্রকৃত ভারতের সম্মান হানি হয় না। সমস্ত রকম নিষ্ঠুর অত্যাচার এর শিকার হবার জন্যেই শূদ্র ভারতের সৃষ্টি ।

২৬

আধুনিক সমাজে মানুষ নির্ভয়ে কথা বলবেন, এটা সভ্যতার অন্যতম শর্ত । কিন্তু প্রায়শঃ সেই শর্ত মান্য হয় না। যে মানুষ সহজ ভাষায় মনের কথা বলতে চায়, তাকে সর্বদা সুনজরে দেখা হয় না। ওপরে ওপরে গণতন্ত্রের একটা নামাবলী চাপানো থাকে। কিন্তু ভালো করে ঠাহর করলে নামাবলী পরা ব্যক্তিটির সর্দারি চেহারাটা আর আড়াল থাকে না।
অধিকার পাই বা না পাই, যে সমাজে নিশ্চিন্তে মুখ খুলতেও মানুষ ভয় পায়, সে বড় সুস্থ সমাজ নয়।
রক্তকরবী রবীন্দ্র নাটক পড়তে পড়তে আমি এমত ভাবনায় প্রশ্রয় পেয়েছি।

২৭

কুরুসভায় যখন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ হচ্ছিল, তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। আর ছিলেন ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য । এঁরা প্রত্যেকে বিরাট বীর। ধৃতরাষ্ট্র দৃষ্টিগত প্রতিবন্ধী হলে কি হবে, “অন্যভাবে ক্ষমতাসম্পন্ন” বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন ঠিক তাই। কাউকে তেমন ভাবে চেপে ধরতে পারলে পিষেই মেরে দিতে পারতেন। ছিলেন সাক্ষাৎ ধর্ম বিদুর। পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই তো ছিলেনই। কিন্তু নিয়ম, নিয়মের ফ্যাস্তাকলে পড়ে কেউ কিছু বলতে চাইলেন না। পাঞ্চালী যাজ্ঞসেনী সেই দিনটাতে রজস্বলা, মানে মাসিক চলছে, আর একটাই কাপড় পরা, সেই তাঁকে প্রকাশ্য রাজসভায় রাজপুরুষরা বিবসন করতে কাপড়টা ধরে টানছেন। এই দেখে ভীম একটু তেড়ে মেরে উঠেছিলেন। সেও আপন অগ্রজের নির্বুদ্ধিতার উপর। কিন্তু “দুর্যোধন, দুঃশাসন, তোমরা এটা করতে পারো না। এই তরবারি ধরলাম। তোমাদের এ অন্যায় সহ্য করছি না”, এ কথা কোনো বীর বললেন না।
যে সমাজে শিক্ষিত, পদস্থ, গুণী, মান্য ব্যক্তিরা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে ভুলে যান, নিয়মের যাঁতাকলে আছেন ভেবে চুপ করে থাকেন, সেই সমাজটা ফ্যাসিবাদের রাহুগ্রাসে পড়েছে। ওই নিয়মটা, যেটাকে পূজা করেন সেই সমাজের নিয়মনিষ্ঠ সুনাগরিকেরা, ওটা আসলে কোনো নিয়মই নয়। ওটা নির্লজ্জ সুবিধাবাদ। অবিমিশ্র স্বার্থপরতা। নিজেকে টিঁকিয়ে রাখার কল কৌশল। ধান্ধাবাজির প্রকারভেদ।

২৮

নজরুলের “কুলি মজুর” কবিতাটি নিয়ে পাড়ার কাছেই আবৃত্তি প্রতিযোগিতা হচ্ছে খবর এসেছিল। মায়ের কাছে সেটি মুখস্ত করার চেষ্টা করে ছিলাম। বলতে গিয়ে গেল গুলিয়ে। বাড়ি ফিরে এলাম নিরাশায়। সেই শুনে বাবা ওই কবিতাটি বার বার করে আমায় বোঝালেন আর ভেতরকার লড়াকু ধারণাটাও সঞ্চারিত করলেন। তার পর এল সেই দিন। পাড়ার আর একটি বড়ো মঞ্চে নজরুলের কুলি মজুর। আমার ভাই সেখানে অনুষ্ঠানের তথ্য খেয়াল করেছিল। সেটা দুর্গাপূজার অষ্টমী। দুপুরে সবাই মিলে বেলুড় মঠে ঘুরে সন্ধ্যায় ময়রাডাঙ্গা পূজা প্রাঙ্গণে অজস্র প্রতিমা দর্শনার্থীর সামনে আবৃত্তি প্রতিযোগিতা আর আমার জন্যে প্রথম পুরস্কার। বহু সংখ্যক দর্শকের সামনে সেই আমার প্রথম আবৃত্তি। সেই থেকে গরিব মেহনতি মানুষকে আপন জানা। শ্রমিকের মুক্তি আন্দোলনের প্রতি সংহতি চেতনা। বাবা মা আমি ও নজরুল এভাবে মিলে মিশে আছি। এই ১১ জ্যৈষ্ঠের বারবেলাতেই কাশিপুরের নর্থ সুবারবন হাসপাতালে আমি জন্মেছিলাম। বাবা যখন ছেলে দেখতে গেলেন, মাসীরা সমস্বরে বললেন ছেলেকে গিফট দাও। বাবা তাঁর হাতঘড়িটাই নবজাতকের বুকের উপর রেখে দিলেন। সময়চেতন না হয়ে কি পারি? সে সব পঞ্চাশ বছর আগের কথা।
শিক্ষকের তিন রকমের কথা বলেন প্রবীণেরা। অতি সাধারণ শিক্ষকেরা পাঠ্য বস্তু মোটের উপর বুঝতে সাহায্য করেন। আর একটু উচ্চ স্তরের শিক্ষকেরা পাঠ্য বস্তুর গভীরে নিয়ে যান। সেরা শিক্ষকেরা শিখতে অনুপ্রাণিত করেন। বলাই বাহুল্য, সেরা শিক্ষকের ছোঁয়ায় ছাত্র নিজেই হয়ে ওঠে নিজের শিক্ষক, এবং শিক্ষার প্রতি প্রবল ক্ষুধায় সে নিজের ভিতর জ্ঞান অর্জনের প্রবল তাড়না অনুভব করে।
কুলি মজুর কবিতা নিয়ে বাবার একান্ত উদ্যোগ আমাকে শ্রম ও পুঁজির সম্পর্ক বিন্যাস নিয়ে ভাবতে অনুপ্রাণিত করে। সমাজ বিকাশে শ্রমের অবদান উপলব্ধি করায়। আর শ্রমিক যে বর্তমান দুনিয়ায় সব চাইতে প্রগতিশীল শ্রেণী তা বুঝতে বলে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।