প্রয়াণ লেখ : মৃত‍্যুঞ্জয়ী বিজ্ঞানী গ‍্যালিলিও গালিলেই – লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

আজ গ‍্যালিলিও গালিলেইর প্রয়াণদিবস। গ‍্যালিলিও গালিলেই (  15.2.1564 – 08.01.1642) ছিলেন উঁচু দরের বিজ্ঞানী । হান্স লিপারসে নামে এক চশমা শিল্পী একটা নলের দুপাশে দুটো লেন্স লাগিয়ে দূরের জিনিসকে কাছে দেখার খেলনা তৈরি করেছেন শুনে তিনি নিজেই লেন্স এর ফোকাস দূরত্ব বিষয়ক অঙ্ক কষে টেলিস্কোপ বা দূরবীন বানান। গাণিতিক সূত্রের ভিত্তিতে লেন্স গঠন আর স্থাপনার প্রকৌশলে সেই দূরবীন হয়ে উঠল বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম, আর সেই দূরবীনে আকাশ দেখা তাঁকে পেয়ে বসে। তিনি দেখতেন গ্রহ নক্ষত্রের চলন। দেখতেন আর সেই নিয়ে অঙ্ক কষতেন।
সেই সময় চালু ধারণা ছিল যে পৃথিবী স্থির আর সূর্য তার চার দিকে ঘুরছে। এর বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে অনেক কথা বলা হলেও ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ পৃথিবীর নিশ্চলতার পক্ষে ছিলেন বলে, অনেক বোদ্ধা ব্যক্তিও সব বুঝে শেষমেশ পৃথিবীকে দাঁড় করিয়ে, অন্য সকল গ্রহ নক্ষত্রকে তার চার দিকে ছুটিয়ে মারতেন। চার্চের ভয়ে, আর পিঠের চামড়া বাঁচাবার দায়ে এ কাজ তাদের করতে হত।
নিকোলাস কোপার্নিকাস ছিলেন বিজ্ঞানের অধ্যাপক। ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৪৭৩ সালে তিনি জন্মেছিলেন, আর ১৫৪৩ এর ২৪ মে তারিখে তিনি মারা যান।
নিকোলাস কোপার্নিকাস বুঝতে পেরেছিলেন যে পৃথিবী স্থির আর সূর্য তার চার দিকে ঘুরছে, এই মতটা একেবারে ভুলভাল। একেবারেই অন্তঃসারশূন্য। কিন্তু সেটা স্পষ্ট ভাবে সোজা সরল ভাষায় পাঁচজনের সামনে বুঝিয়ে বলার জমানা ছিল না। তাই চার্চের কোপের ভয়ে, উৎপীড়িত হবার  ভয়ে, কোপার্নিকাস তার দীর্ঘ গবেষণাসঞ্জাত উপলব্ধি পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন একেবারে নিজের মৃত্যুশয্যায়। সে বইয়ের নাম  দ্য রেভোল্যুশনিবাস অরবিয়াম কোয়েলেস্টিইয়াম De revolutionibus orbium coelestium (On the Revolutions of the Celestial Spheres), । সেই বইয়ের কপি গিয়ে পড়েছিল  এক পাদ্রি সাহেব জিওর্দানো ব্রুনোর ( ১৫৪৮ – ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৬০০) হাতে। তিনি সেই বই পড়ে নিশ্চিত হলেন যে সূর্যকে ঘিরেই পৃথিবী ঘুরছে। আর সেই কথা তিনি প্রকাশ্যে বলা শুরু করে দিলেন। চার্চ জিওর্দানো ব্রুনোকে ধর্মদ্রোহী বিবেচনা করে প্রাণদণ্ড দেন। পাদ্রি সাহেবকে খুঁটিতে বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। মারার আগে তাঁর জিভ কেটে নেওয়া হয়ে ছিল যাতে পুড়তে পুড়তেও উপস্থিত জনতার সামনে বৈজ্ঞানিক সত্য প্রকাশ করে দিতে না পারেন।
ব্রুনো সৌরজগত সম্পর্কে কোপার্নিকাসের মতবাদ সমর্থন করার পাশাপাশি বলেছেন দূর আকাশের নক্ষত্রগুলি আসলে এক একটি সূর্য। তিনি বিশ্বাস করতেন সূর্য ও তার গ্রহমণ্ডল নিয়ে যে জগৎ, তা ছাড়া আরো বিস্তর সূর্যসম জ‍্যোতিষ্ক ও তাদের গ্রহমণ্ডল থাকা খুবই সম্ভব। তিনি ভাবতেন মহাবিশ্ব প্রকৃতপক্ষে অপরিমেয় অর্থাৎ অসীম, এবং এই মহাবিশ্বের সুনির্দিষ্ট কোনো কেন্দ্র নেই। ১৫৮৪ সালে প্রকাশিত তাঁর দুটি গবেষণা পুস্তক লা সেনা ডি লে সেনেরি এবং ডি লা ইনফিনিটো ইউনিভারসো এট মোন্ডি তে এই চিন্তা ধরা আছে।
জিওর্দানো ব্রুনোর সূত্রে আমরা সুইডেনের বিজ্ঞানী টাইকো ব্রাহে ( ১৪. ১২. ১৫৪৬ – ২৪.১০. ১৬০১) এর কথা স্মরণ করতে পারি। চাঁদ যে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে, এ কথা তিনি গাণিতিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বলেছিলেন।
কিন্তু ব্রাহে ছিলেন পুরাতন পন্থী। অসাধারণ গাণিতিক দক্ষতা ও পর্যবেক্ষণে অসামান্য কৃতিত্ব সত্ত্বেও ব্রাহে তাঁর পশ্চাৎমুখী দার্শনিক অবস্থানের কারণে বিশ্বাস করতেন আরিস্ততলীয় পদার্থবিজ্ঞানে, টেলিস্কোপের সাহায্য না নিয়েই তিনি আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে অভ‍্যস্ত ছিলেন। ব্রাহে আস্থা রাখতেন পৃথিবীকেন্দ্রিক বিশ্বভাবনায়। ১৫৮৮ সালে ব্রাহে দুটি পুস্তক প্রকাশ করেন। ইনট্রোডাকশন টু দ‍্য নিউ অ্যাস্ট্রোনমি এবং অ্যাবাউট রিসেন্ট ফেনোমেনা ইন দ‍্য সেলেসচিয়াল ওয়ার্ল্ড। পরবর্তীকালের বিশ্ববিখ্যাত জ‍্যোতির্বিজ্ঞানী জোহান্স কেপলার তাঁর কনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করলেও কেপলার ব্রাহের চিন্তাগত ভিত্তির দুর্বলতা ও পশ্চাৎমুখীনতা সম্বন্ধে জানতেন। কেপলারের সাথে মিলে টাইকো ব্রাহে দৃশ্যমান নক্ষত্রের অবস্থান সমন্বিত তালিকা রুডলফিন টেবল প্রকাশ করেন।
ওই যে জোহান্স কেপলার ( ২৭.১২.১৫৭১ – ১৫.১১. ১৬৩০) নামে মহাবিজ্ঞানীর কথা বলছিলাম, তিনি ছিলেন জার্মানির মানুষ। এই অসামান্য  গণিতপ্রতিভা গ্রহগুলির চলনগতি নিয়ে গবেষণা করে অ্যাস্ট্রোনমিয়া নোভা ( ১৬০১) পুস্তক রচনা করেন। তাঁর পর্যবেক্ষণলব্ধ জ‍্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার আরো নিদর্শন ধরা আছে মিসটেরিয়াম কসমোগ্রাফিকাম (১৫৯৬), হারমোনিসেস মুন্ডি (১৬১৯), তিন খণ্ডে এপিটোম অ্যাস্ট্রোনমিয়া কোপার্নিকা ( ১৬১৮ – ১৬২১) প্রমুখ ব‌ইতে। কেপলারের সাধনা বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইজ‍্যাক নিউটনকে প্রভাবিত করেছিল।
কিন্তু সেরা কাজটি করে দেখালেন বিজ্ঞানী গ‍্যালিলিও। দূরবীন যোগে তন্নতন্ন করে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে করতে
গ্যালিলিও দেখতে পেয়েছিলেন বৃহস্পতি গ্রহকে ঘিরে তার উপগ্রহগুলি ঘুরছে । প্রথম দিন তিনি তিনটি উপগ্রহ দেখেন। সেগুলির নাম ইউরোপা, আইও আর ক্যালিস্টো। পরদিন তিনি দেখেন গ্যানিমিড, যেটি বৃহস্পতির সর্ববৃহৎ উপগ্রহ।
গ্যালিলিও বিবেচনা করলেন যদি বৃহস্পতিকে ঘিরে তার চার চারটি উপগ্রহ ঘুরছে, এটা চোখে দেখা যায়, পাঁচজনকে দেখানো যায়, তাহলে পৃথিবীই তাবৎ মহাবিশ্বের কেন্দ্রে এই কথা বলার যুক্তি কি? গ্যালিলিও পৃথিবীর গতিশীলতার সপক্ষে আর সূর্যকেন্দ্রিক চলনের সপক্ষে বললেন।
ব্রুনোর মতো তাঁর বিরুদ্ধেও নেমে এল চার্চের আঘাত। কারাদণ্ড । সেখানে অশেষ নির্যাতন সয়েছেন তিনি।
আজ আট জানুয়ারি মহান গ‍্যালিলিওর প্রয়াণ দিবস। সেই মানুষটি যিনি সত্যের সপক্ষে প্রাণ হাতের মুঠোয় করে মাথা তুলে দাঁড়াতে ভয় পান নি, দ্বিধা করেন নি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।