T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় মৃদুল শ্রীমানী
by
·
Published
· Updated
আমি ও রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে আমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে আমার নিচু ক্লাসেই। প্রাথমিক স্তরে ক্লাস টু বা থ্রিতে বিদ্যালয়ে একটি আবৃত্তি প্রতিযোগিতা হয়েছিল। কবিতার নাম ‘রবিবার:। কবিতার শুরুটি ছিল এইরকম: ‘সোম মঙ্গল বুধ এরা সব আসে তাড়াতাড়ি…’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা। তো বাচ্চারা বাড়ি থেকে সবাই বেশ করে মুখস্থ করে এসেছে কবিতাটি। এক এক করে বাচ্চারা উঠছে, তোতাপাখির মতো গড়গড়িয়ে কবিতাটি বলছে আর নেমে যাচ্ছে। কয়েকজন বিচারক আছেন। নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে অন্য বিদ্যালয় থেকে শিক্ষকগণ এসে সে গুরুদায়িত্ব পালন করছেন। আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় স্মৃতির দাম খুব। আর উপস্থাপনার শৈলী। উচ্চারণ স্পষ্ট ও প্রমিত, এবং মার্জিত কি না, তাও দেখার কথা। তো এক সময় আমাকেও স্টেজে উঠে শুরু করতে হল ‘সোম মঙ্গল বুধ এরা সব…’।
ওই কবিতার একখানে একটা সাংঘাতিক কথা আছে। ‘রবিবার সে কেন মা গো …. সে বুঝি মা তোমার মতো গরিব ঘরের মেয়ে?’
এখন রবিবারকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটা মানুষী চেহারা দিলেন, আর তাকে গরিব ঘরের মেয়েদের মতো করে দেখলেন। গরিব ঘরের মেয়েরা এদেশের মানুষের হাতে বড় কষ্ট পায়। শুধু তো অন্নকষ্ট আর প্রয়োজন মেটানোর মতো পোশাকের অভাব নয়, গরিবের মেয়েদের সম্মানের অভাবটা এদেশে সাংঘাতিক। গরিবের মেয়েদের কাপড় টেনে খুলে নেওয়া এমন কিছু সাংঘাতিক অপরাধ নয়। গরিব মেয়েকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে বিবস্ত্র করে গ্রামে ঘোরানোর ঘটনা স্বাধীন দেশেও চালু আছে। আর শ্বশুরবাড়ি তেও মেয়েদের শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের কোনো অভাব হয় না।
যে গরিব চাষি মজুর বাইরে সর্বত্র বেকুবের মতো নির্যাতন ও লাঞ্ছনা সহ্য করতে বাধ্য হয়, সেও বাড়িতে এসে স্ত্রীর উপর জুলুম করতে দ্বিধা বোধ করে না। মালিক সেজে হুকুম ফলায়। গরিব বাড়ির মেয়ে যেন সর্বহারার সর্বহারা। সারা বিশ্বে অপুষ্টি, অস্বাস্থ্য আর অশিক্ষার শিকার যে মেয়েরা, তাদের বেশির ভাগের ঠিকানা ভারতবর্ষ।
এখন কবিতাটা যত্ন করে বলতে গিয়ে আমার ভিতর কি যেন হয়ে গেল। একজন নক্ষত্র মাপের কবিই পারেন রবিবারকে গরিবের ঘরের মেয়ের সঙ্গে লগ্ন করতে। ঘটনাচক্রে সাধারণ স্বচ্ছল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম হলেও, আমি গরিব ঘরের মেয়েদের খুব কাছ থেকে দেখেছি। তাদের লাচারির আমি সাক্ষী। ভারতে প্রতি মুহূর্তে কিভাবে গরিবের মেয়ের মানবাধিকার হরণ করা হয়, তা আজ আমি জানি। কিন্তু সেদিনও তা কিছু কিছু জানতাম। শিশু হলেও ভারতের নিচের থাকের মেয়েদের দুর্বিষহ অবস্থা সম্পর্কে আমি অজ্ঞ ছিলাম না।
কবিতা বলতে বলতে “সে বুঝি মা তোমার মতো গরিব ঘরের মেয়ে”, ওই জায়গাটা বলতে গিয়ে আমার ভেতরে হু হু করে আবেগ উছলে উঠল। আমি নিজের উথলে ওঠা আবেগ সামলে নিতে চুপ করে খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে রইলাম। বিচারকরা দেখছেন আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। আমার কণ্ঠমণিতে চোখের পাতায় লুটোপুটি খাচ্ছে গরিব মেয়ের লাচারি।
আমি কবিতা বলতে বলতে থেমে গিয়েছিলাম। তাই আমি প্রথম বা দ্বিতীয়, এমনকি তৃতীয় স্থান পর্যন্ত অধিকার করতে পারি নি। কিন্তু কোনোক্রমে বিচারকগণ অনুভব করেছিলেন প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় এইসব মাপের বাইরে গিয়ে আমার বোধটাকে একটা স্বীকৃতি দেওয়া দরকার। আমার জুটল একটা সান্ত্বনা পুরস্কার।
অনেক দিন পর যখন “আফ্রিকা” কবিতাটি পড়ি, তখন রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে, বলো, ক্ষমা করো…’ তখন আমার আবার ‘রবিবার” কবিতার কথা মনে পড়ে গেল।