দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২৪৬)

পর্ব – ২৪৬

খাবার টেবিলে বাবা ও জ‍্যাঠামশায়ের সাথে খোকা খেতে বসেছে। তাদের খাওয়া হলে মায়েরা খাবেন।  বাবা বললেন, খোকা, খেয়েদেয়ে চলো আমরা একটু হাঁটতে বেরোবো।
কাতর দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকাল খোকা। রাতের খাওয়ার পর জ‍্যাঠামশায়ের কাছে বসে একটু গল্প করে সে। নয়তো একটু গল্পের বই পড়ে। তার গল্পের বই পড়ার মজা মাটি হতে বসেছে ভেবে সে বলল, বাবা, একটা গল্পের বই এনেছি। পড়তাম।
বাবা বললেন, না না, একটু হাঁটা চলা করে এলে ঘুমটা ভালো হবে। ভোরে উঠে পড়তে পারবে।
জ‍্যাঠাইমা বললেন, ছেড়ে দাও ছোড়দা, গল্পের বই পড়তে না পেলে আরো ঘুম আসবে না। রাতে কখনো কখনো দেখেছি লুকিয়ে লুকিয়ে টর্চ জ্বেলে ব‌ই পড়ে।
বাবা বললেন, সে কি? রাতে ঠিকঠাক না ঘুমালে তো শরীর খারাপ করবে!
খোকা বলল, ঘুম আসে না যে!
বাবা বললেন, বিকেলে ব‍্যায়াম সমিতিতে যাবে। ওখানে ডন বৈঠক করবে। ওরা ব্রতচারী নাচ‌ও শেখায়। তুমি সেটাও শিখবে।
খোকা কাতর মুখে মায়ের দিকে চাইল। মা বললেন, আচ্ছা। আজ আর বাইরে যেতে হবে না। বারান্দাতেই পায়চারি করিস। তবে বাবার কথা শুনতে হয়।
জ‍্যাঠামশায় বললেন, কী সে ব‌ই যা তোমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে?
খোকা বলল, টারজান।
জ‍্যাঠামশায় বললেন, জন ক্লেটন নম্বর টু।
খোকা বলল, তুমি কি করে জানলে জ‍্যেঠু?
জ‍্যাঠামশায় বললেন, ম‍্যাজিক।
খোকা বলল, তুমি নিশ্চয়ই ব‌ইটা পড়েছ। ন‌ইলে জানলে কি করে?
জ‍্যাঠামশায় বললেন, ওটা জন ক্লেটন আর তার ব‌উ অ্যালিস রাদারফোর্ড ক্লেটনের গল্প।
আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে আফ্রিকার নিরক্ষরেখা অঞ্চলে জন ক্লেটন তার বৌ অ্যালিসকে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে তাদের বাচ্চা হয়।  বাচ্চাটার মা মারা গিয়েছিল তার মোটে এক বছর বয়সে। গহন জঙ্গলে শিম্পাঞ্জি আর গরিলার মাঝামাঝি কোনো একটা কাল্পনিক প্রাণীর দলনেতা কেরচাক জন ক্লেটনকে মেরে ফেলে। আর সেই দলের‌ই একটা মেয়ে এপ কালা ক্লেটন সাহেবের ওই বাচ্চাটাকে বড়ো করে। ক্লেটনদের ওই ছেলেই হল টারজান।  এডগার রাইস বারোজ গল্প ফাঁদলেন টারজান অফ দি এপস। ঊনিশ শো বারো সালে তা পাল্প ম‍্যাগাজিনে বেরোলো। তার পর ১৯১৪ সালে ব‌ই। আর সারা পৃথিবীর নজর পড়ল টারজানের দিকে। তখন কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বেধে গেছে।
খোকা, মনে আছে তো , ১৯১৪ সালের আঠাশে জুলাই যুদ্ধ বাধলো। চার বছর তিন মাস দুই সপ্তাহ ধরে যুদ্ধ চলে, ১৯১৮ সালের এগারো নভেম্বর তারিখে যুদ্ধ থামল। পরের বছর ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তি।
সার্বিয়ার একটা খুনে গুণ্ডা, গ‍্যাভরিলো প্রিনসিপ, সারাজেভোর কাছে গুলি চালিয়ে মেরে দিল আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ আর তার বৌ সোফিকে।
জানো, কে এই ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ? না তিনি হলেন অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের রাজমুকুটের উত্তরাধিকারী। তারিখটা ছিল চোদ্দ সালের আঠাশে জুন। এবার এই মাপের একটা লোককে খামখা মেরে দেওয়ায় অস্ট্রিয়া সার্বিয়ার কাছে কৈফিয়ৎ দাবি করল। সার্বিয়ার জবাব অস্ট্রিয়ার পছন্দ হল না। এদিকে সার্বিয়ার পিছনে দাঁড়াল রাশিয়া। আর অস্ট্রিয়ার পিছনে কাইজার এর জার্মানি। একমাস বাদে বেধে গেল যুদ্ধ।
এই সময় মানুষকে শাদা চামড়ার মহত্ত্ব বোঝাতে বাজার মাৎ করা গল্প টারজান অফ দি এপস। আগেই বলেছি এডগার রাইস বারোজের কলমে সে জিনিস ব‌ই হয়ে বেরোলো ওই ১৯১৪ সালেই। আর প্রথম টারজান মুভি ওই ব‌ইটার নামেই, টারজান অফ দি এপস। তখন সাইলেন্ট মুভির যুগ। ছবিই কথা বলছে। আলাদা করে কথা বলতে হচ্ছে না। ১৯১৮ সালে বাজার গরম করা সিনেমা বানালেন স্কট সিডনি। গর্ডন গ্রিফিথ করল টারজানের বাচ্চা বয়সের পার্ট। আর এলমো লিনকন সাজলেন বড় টারজান। জেন হয়েছিলেন ইনিড মারকি। তারপর বিরাট বক্স অফিস সাফল‍্য। ১৯১৯ সালের এপ্রিল মাসে ভারতের জালিয়ান‌ওয়ালাবাগে নিরীহ নিরস্ত্র পঞ্জাবি জনতার উপর গুলি চালিয়ে দিল রেজিনাল্ড মাইকেল ও ডায়ারের বাহিনী। কালা আদমির উপর গুলি চালাতে কারো প্রাণ কাঁদল না। যুদ্ধ পরিস্থিতি ব্রিটিশকে দানবিক করে দিয়েছে। রাজনৈতিক দলের নেতারা তাদের দাঁত নখের বহর দেখে গর্তে সেঁধিয়ে গিয়েছে। গান্ধিজী পর্যন্ত কিছু বলতে ভয় পাচ্ছেন। একা প্রতিবাদে নামলেন এক কবি। ইংরেজের বড়লাটকে লিখিতভাবে বললেন, চাই না তোমার দেওয়া সম্মান। ফিরিয়ে নাও।
বাবা বললেন, জনি ওয়াইজমুলারের নাম অতো শুনি যে!
জ‍্যাঠামশায় বললেন, হ‍্যাঁ, তিনিও একজন সেনসেশন। দারুণ সুইমার। আমেরিকান হলে কি হবে, জনি ওয়াইজমুলারের জাত জন্মের শিকড় ছিল অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরিতে। ছয় ফিট তিন ইঞ্চি মাসকুলার চেহারা, ওজন ছিয়াশি কেজি। ১৯২৪ এর পারী অলিম্পিকে সাঁতারের নানা ইভেন্টে তিন তিনটে সোনা তার পকেটে। অবশ‍্য সেবার সবচেয়ে বেশি সোনা জিতেছিল আমেরিকা।
পারী, ফ্রান্সের রাজধানী পারী হল সেই প্রথম শহর, যেখানে দ্বিতীয়বার অলিম্পিক হল। এর আগে পৃথিবীর আর কোনো শহর এই সম্মান পায় নি। মনে রেখেছ কি, সবে ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে পারীতে, আর বাইরে ফরাসি জনতা প্রতিশোধ নেওয়ার আনন্দে আত্মহারা।
জনি ওয়াইজমুলার ১৯২৮ সালের অলিম্পিকেও নজর কেড়েছেন। সাঁতারের দুটি ইভেন্টে সোনাজয়ী তিনি। আর সাঁতারের কত যে রেকর্ড তিনি ভেঙেছেন! তা  মনে করো, গোটা পঞ্চাশ তো হবেই! এই জনি ওয়াইজমুলার সিনেমায় টারজান সাজলেন। ওই এক‌ই গপ্প। টারজান অফ দি এপস। সালটা ১৯৩২। ডবলিউ এস ভ‍্যানডাইকের পরিচালনায় আবার দুনিয়া কাঁপাল টারজানের গপ্প। জেন সেজেছিলেন মৌরিন ও সুলিভ‍্যান। জলের ভিতর ফরসা টারজান আর ফরসা জেনের সা‍ঁতার দুনিয়ার ঘুম কেড়ে নিল। শাদা চামড়া যে বর্ণশ্রেষ্ঠ, তা উচ্চকিত করে বলার গল্প টারজান। জানো, টারজান শব্দটির অর্থ‌ই হল শাদা চামড়ার মানুষ। একদল মানুষ অন‍্য সকলের চাইতে অনেক বেশি উন্নত, এই কথাটা সবচেয়ে নৃশংসভাবে বলতে পেরেছিলেন যিনি সেই হিটলারের উত্থানের সময়টাও খেয়াল কোরো। ১৯৩৩ সালে তিনি নাৎসিপার্টির সর্বেসর্বা হয়ে গেলেন। আর ১৯৩৪ সালে নিজেকে বললেন ফুয়েরার। আর ইহুদিরা হল জগতের নিকৃষ্টতম জীব। ওরা না কি ঠিকঠাক মানুষের পর্যায়েই পড়ে না।
হেরিডিটি না এনভায়রনমেন্ট, বংশগতি না পরিবেশ, কোন্ টা মানুষের ব‍্যক্তিত্ব ও মনন গড়ে তোলে, এই প্রশ্নে হেরিডিটিকে সাংঘাতিক ভাবে উঁচুতে তুলে ধরতে চেয়েছেন এডগার রাইস বারোজ। রক্তের বিশুদ্ধতার পক্ষে দুনিয়াজোড়া একটা সমর্থন ছিল‌ই। ইংরেজরা হিটলারের বিরোধী ছিল ব‍্যবসা দখলের স্বার্থে। ন‌ইলে দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাস ঘেঁটে দ‍্যাখো তারা জুলুদের ওপর অত‍্যাচার করেছে। সেখানকার ভারতীয়দের ওপরেও অত‍্যাচার করত। কুলি বলত। লাথি মারত। লণ্ডন থেকে পাশ করা ব‍্যারিস্টার হলেও, গান্ধীজি  ইংরেজের অত‍্যাচার থেকে রেহাই পান নি। প্রায় একুশ বছর ধরে সেখানে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন গান্ধী। ইংরেজের  বর্ণবৈষম্য কিছুই কম ছিল না। হিটলারের ইহুদি বিদ্বেষ আর ইংরেজের বর্ণবৈষম্য আসলে এক‌ই গাছের বিষাক্ত ফল।  আমাদের দেশেও বিয়ের সময় অনুলোম প্রতিলোম  হুজুগ তুলে কিছু অশিক্ষিত লোক ঘোঁট পাকাতে চায়।  তো সেই টারজানের লেখক এডগার রাইস বারোজ জন্মেছিলেন ১৮৭৫ সালে। তাঁর জন্মের বছর দশেক আগে  ১৮৬৫ সালে জন্মেছিলেন জোসেফ রাডিয়ার্ড কিপলিং। আরেকটি উৎকট সাম্রাজ্যবাদী লেখক। কিপলিং এর জাঙ্গল বুকের অনুপ্রেরণায় যেসব গপ্প তৈরি হয়েছিল, টারজান তার‌ই একটা।
খোকা বলল, জ‍্যেঠু, কিপলিং এর ব‌ই পড়েছি। মৌগলি। দি জাঙ্গল বুক।
জ‍্যাঠামশায় বললেন, হ‍্যাঁ। রাডিয়ার্ড  কিপলিং এর এই জাঙ্গল বুক ১৮৯৪ সালে বেরিয়েছিল। ভারতের মধ‍্যপ্রদেশের শিউনিতে একটা মানুষের বাচ্চা নেকড়ে মায়ের আশ্রয়ে বড়ো হয়ে উঠছে। এই গল্পটাও বেশ বাজার পেয়েছিল। তবে টারজানের মতো ক্লিক করে নি। জানো, এই কিপলিং লোকটা ভয়াবহ রকমের শ্বেতাঙ্গপ্রেমী ছিল। কুইন ভিক্টোরিয়ার সিংহাসনে অধিষ্ঠানের ডায়মণ্ড জুবিলি হয়েছিল ১৮৯৭ সালে। জুন মাসে।
খোকা বলল ওই বছরের জানুয়ারিতে নেতাজি সুভাষ জন্মেছিলেন।
মা ফিসফিস করে তার কানে কানে বললেন, চুপ কর, পরে বলবি।
 জ‍্যাঠামশায় বললেন, তা ওই উপলক্ষে ফিলিপাইন আর আমেরিকার যুদ্ধে আমেরিকার পক্ষ নিয়ে, অসভ‍্য জাতগুলোকে তুমি আমেরিকা সুসভ‍্য করে তোলো, বলেছিলেন রাডিয়ার্ড কিপলিং। “হোয়াইট ম‍্যানস বার্ডেন” বলে কবিতায় বললেন, কালা আদমিদের মানুষ করে তোলার জন্য শ্বেতাঙ্গরা কী অপরিসীম আত্মত‍্যাগ করে চলেছে! এটা ১৮৯৯ এর কথা। শ্বেতাঙ্গরা নাকি কালা আদমিকে শাসন করে অপার উপকার করছে!
 মা জ‍্যাঠাইমার মনে পড়ল, ফরসা না হলে ভদ্রলোকের পরিবারে বাঙালির মেয়ের বিয়ে হ‌ওয়া কঠিন হত।  বিয়ের যুগ‍্যি মেয়েটার গায়ের চামড়া ঘষে মেজে উজ্জ্বল করতে আজো অভিভাবকদের ঘুম ছুটে যায়।
খোকা বলল, বড্ড ঘুম পাচ্ছে জ‍্যেঠু।
জ‍্যাঠামশায় বললেন, তা হলে যে বলো ঘুম পায় না!
জ‍্যাঠাইমা বললেন, ঘুমের আর দোষ কি! ঘড়িতে কটা বাজে দেখেছ? গপ্প শুরু করলে তুমি তো আর থামতে জানো না।
 খোকা বলল, মা, তুমি আজ আমার কাছে শোও না?
মা প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।