• Uncategorized
  • 0

রবিবারে রবি-বার – এ মৃদুল শ্রীমানী

যুদ্ধ এবং শ্রাদ্ধ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “শ্রাদ্ধ” কবিতার নিবিড় পাঠ

ইতিহাস যে পড়েছে, তাকে যুদ্ধের কথা পড়তেই হয়েছে। ভারত ইতিহাসে হোক, আর চীন জাপান স্পেনের ইতিহাস হোক, রুশ জার্মান হোক আর ইংল্যান্ড ফ্রান্সের হোক, যুদ্ধ মানেই লোকক্ষয়, হাহাকার, আর মানবাধিকার দলন একটা অবধারিত ব‍্যাপার। যুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী ও শিশুরা। বিজয়ী সেনাবাহিনীর হাতে নারীদের প্রতি অকথ্য নির্যাতন ও যৌনলাঞ্ছনা এক কঠোর বাস্তব।
সুদূর অতীতে রাম রাবণের যুদ্ধ ঘটেছিল কি না, তার কোনো পাথুরে প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। কিন্তু রামকথা যাঁরা লিখেছিলেন, সেই বাল্মীকির দল যুদ্ধের গোড়ায় শূর্পনখার নাক কান কাটার গল্পটা বলে নিলেন। বললেন, অশোক বনে সীতাকে রাবণ যৌন লালসায় স্পর্শ করতে যেতে পারে নি একটাই ভয়ে, তা হল, সীতাকে তাঁর অনিচ্ছায় যৌনস্পর্শ করলেই রাবণের মাথা চৌচির হয়ে যাবে, এমন একটা ভয় রাবণকে সামলে সুমলে রাখত। তারপর রামকথায় বালী সুগ্রীবে ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পত্তি দখলের যুদ্ধে রামকে বহিরাগত হয়েও লুকিয়ে চুরিয়ে তীর মেরে বালীকে খুন করতে হয়েছিল। সেটাকে মহাকাব‍্যের ধীরোদাত্ত নায়কের কাজ বলতে মুখে বাধে। ইন্দ্রজিতের নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে লক্ষ্মণ প্রবেশ করছেন, আরো কি কি করছেন, সে সব মেঘনাদবধ কাব‍্যে লিখেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সেখানে ইন্দ্রজিৎ স্বদেশপ্রেমী নায়ক। লক্ষ্মণ স্রেফ তস্কর আর বিভীষণ দেশদ্রোহিতা ও স্বজাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত।
রামায়ণের গল্পে লঙ্কাকাণ্ড ঘটানোর পালাটা যাত্রার দর্শকের চোখ বিস্ফারিত করে তোলে। আর মহাভারতে প্রকাশ‍্য রাজসভায় যাজ্ঞসেনী দ্রুপদনন্দিনী আত্মীয় স্বজনের হাতে গুরুজনদের উপস্থিতিতে চরম লাঞ্ছিত হচ্ছেন, এই দৃশ‍্যটা সচেতন পাঠকের মনে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। আর জ‍্যাঠাদের হাতে কিশোর অভিমন‍্যু চক্রব‍্যূহে আটকা পড়ে মরণান্তিক আঘাত বুক পেতে নেয়। নিশীথের অন্ধকারে পাণ্ডব শিবিরে ঢুকে দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রের ঘুমন্ত অবস্থায় নিধন‌ও অশ্বত্থামার তরফে জঘন্য ক্রূরকর্ম বলে নিন্দিত।
আগুন লাগানোর গল্প‌ও রামায়ণ ও মহাভারতে কম নেই। হনুমানের লঙ্কাকাণ্ড, পাণ্ডবদের জতুগৃহকাণ্ড ও খাণ্ডব দাহনে তার প্রমাণ মেলে।
রামায়ণ ও মহাভারত নিছক গল্পকথা হলেও মানুষের বুদ্ধি তাকে যুগ যুগ ধরে গ্রহণ করেছে।
আর যুদ্ধ জিনিসটা যে আসলে কি মহাকবিরা ওইখানে সূক্ষ্ম অক্ষরে লিখে রেখে গিয়েছেন।
এই প্রেক্ষাপটে আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবীণ বয়সে লেখা “শ্রাদ্ধ” কবিতাটা পড়তে পারি। ছড়ার ছন্দে আপাত লঘুচালে লেখা কবিতাটি তিনি শান্তিনিকেতনে বসে ১৯৪০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে লিখেছেন। কবিতাটা সঞ্চয়িতাতেও সংকলিত হয়েছে। শ্রাদ্ধকে বলছি বটে কবিতা, তবে পণ্ডিতেরা কি বলবেন জানি না। ওঁরা এটাকে ছড়া বলতেই পারেন। কেননা, এখানেই আছে “আতাগাছের তোতাপাখি, ডালিমগাছের মউ;/ হীরেদাদার মড়মড়ে থান, ঠাকুরদাদার বউ।” আরো আছে, ” সাঁতরাগাছির নাচনমণি কাটতে গেল সাঁতার,/ হায় রে কোথায় ভাসিয়ে দিল সোনার সিঁথি মাথার। / মোষের শিঙে বসে ফিঙে লেজ দুলিয়ে নাচে -/ শুধোয় নাচন, সিঁথি আমার নিয়েছে কোন্ মাছে?”
পণ্ডিতবর্গের মত যাই হোক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “শ্রাদ্ধ” রচনাটিতে আমি এমন কয়েকটি পংক্তি দেখতে পাচ্ছি, যা আজ আমাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করছে। বলা ভাল, আমি শিউরে শিউরে উঠছি। এই “শ্রাদ্ধ” কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিটলার সহ সমকালীন নিষ্ঠুর রক্তপিপাসু একনায়কদের প্রবল ধিক্কার দিয়েছেন। এই শ্রাদ্ধ কবিতাটি লেখার চৌদ্দ পনের বছর আগে
১৯২৫ সালে এপ্রিল মাসের চার তারিখে তৈরি হয়েছিল জার্মানির কুখ্যাত এস এস বাহিনী। পুরো নাম শুটজ়স্ট‍্যাফেল, ইংরেজি ভাষায় যার অর্থ দাঁড়ায় প্রোটেকশন স্কোয়াড্রন। হেন জঘন্য ও অমানবিক কাজ নেই যা এই শুটজ়স্ট‍্যাফেল করে নি। শুটজ়স্ট‍্যাফেলকে দুনিয়া এস এস নামেই চিনেছে। প্রতিষ্ঠার সময় এস এস এর সদস‍্যসংখ‍্যা ছিল মেরেকেটে দুশো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “শ্রাদ্ধ” কবিতা লেখার সময়ে এর সক্রিয় সদস্য সংখ্যা আট লক্ষ। জঘন্য জার্মান হিটলারের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সঙ্গে এই শুটজ়স্ট‍্যাফেল এর সমৃদ্ধিশালী হয়ে ওঠা, আর হিটলারের পতনের সমান্তরাল ঘটনা হিসেবে এস এস এর পতন।
অ্যাডলফ হিটলারের একজন জঘন্যতম একনায়ক হয়ে ওঠার আগের ঘটনাগুলো জানা দরকার।
হিটলার জন্মেছিলেন অস্ট্রিয়ায়। এক জার্মান লোকের তিন নম্বর বউয়ের সন্তান অ্যাডলফ হিটলার। সালটা ছিল ১৮৮৯। তারিখটা ছিল এপ্রিল মাসের ২০। হিটলারের মৃত‍্যুও এপ্রিল মাসে। ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল। জার্মানির বার্লিনে মাটির নিচে এক বাঙ্কারে এই কুখ্যাত একনায়ক নিজের কপালে গুলি করে আত্মহত্যা করেন।
জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতায় আসেন নাৎসি পার্টির সূত্রে। জার্মানির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার অনেক আগেই হিটলার নাৎসি পার্টির ক্ষমতা হাসিল করেছিলেন।
১৯৩৩ এ হিটলার জার্মানির চ‍্যান্সেলর হন এবং ১৯৩৪ সালে নিজেকে ফুয়েরার ও রাইখস্ক‍্যানজ়লার বা সর্বাধিনায়ক বলে ঘোষণা করেন।
১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ এর এপ্রিল, এই সময়কালে হিটলার জার্মানির সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। এর মধ‍্যেই ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি পোল‍্যাণ্ড আক্রমণের মধ‍্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে দেন।
মনে রাখা দরকার, ১৯১৪ সালের এইরকম জুলাই মাসেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯১৪ সালের আঠাশে জুন গ‍্যাভরিলো প্রিনসিপ নামে এক বসনিয়ান সার্ব যুগোশ্লাভ উগ্রপন্থী সারাজেভোতে আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ ও তাঁর স্ত্রী সোফিকে হত‍্যা করে। আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ ছিলেন অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরির রাজমুকুটের উত্তরাধিকারী। বসনিয়ান সার্ব যুগোশ্লাভ উগ্রপন্থী গ‍্যাভরিলো প্রিনসিপের ঘটানো এই হত‍্যাকাণ্ড এক ঘটনার ঘনঘটা গড়ে তোলে। একে সারাজেভো ক্রাইসিস বলা হয়।
আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ ও তাঁর স্ত্রী সোফিকে হত‍্যার বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি সার্বিয়ার কাছে জবাব চায়।
সারাজেভো হত‍্যাকাণ্ডের ঠিক একমাস বাদে ১৯১৪ সালের আঠাশে জুলাই তারিখে অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি সার্বিয়ার উপর যুদ্ধ ঘোষণা করে। রাশিয়াও এই যুদ্ধে নিজেকে জড়ায় ও ত্রিশে জুলাই তারিখে সৈন‍্যসমাবেশ করে। আগস্ট মাসে ১ থেকে ৩ তারিখে জার্মানির তরফে সৈন‍্য সমাবেশ হয়। আগস্টের চার তারিখে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ব্রিটিশ শক্তি। এর পরেই অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এভাবেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। চার বৎসর তিন মাস দুই সপ্তাহ যুদ্ধ চলার পর এগারো নভেম্বর ১৯১৮ তারিখে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এরও ছয়মাসের বেশি সময় পার করে আঠাশে জুন, ১৯১৯ তারিখে ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ভার্সাই চুক্তিতে ফ্রান্স ও অন‍্যান‍্য জয়ীপক্ষ বিজিত পক্ষ (মূলতঃ জার্মানি) এর উপর ভীষণ একতরফাভাবে যুদ্ধ বাধানোর দায় চাপিয়ে ক্ষতিপূরণ আদায়ের সঙ্গে অসম্মানের ব‍্যবস্থা করে।
ভার্সাই চুক্তি জার্মানিকে বহু অধিকৃত এলাকা ছেড়ে দিতে বাধ‍্য করে। রাইনল‍্যাণ্ডকে অসামরিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ‍্য করে। তার উপর বিস্তর অর্থনৈতিক বাধা নিষেধ ও প্রভূত পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ‍্য করে জার্মানির জনতার মধ‍্যে উগ্র স্বাজাত‍্যবোধ খুঁচিয়ে তোলে। বহুসংখ্যক জার্মান নাগরিক এই ভার্সাই চুক্তিকে জার্মান জাতীয়তাবাদের উপর একটা ক্রূর ও কঠোর অপমান বলে বিবেচনা করতেন। বিশেষতঃ ভার্সাই চুক্তির আর্টিকেল ২৩১, যেখানে যুদ্ধ বাধানোর জন‍্য জার্মানিকে দায়ী করা হয়েছিল, ওটা যুদ্ধবিরোধী মানবতাবাদী মানুষকে তলিয়ে দেখতেই হবে।
আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশি ছুঁই ছুঁই বয়সে লেখা “শ্রাদ্ধ” কবিতার পরতে পরতে জার্মানির নাৎসি জঘন‍্যতার আঁচ পাই। ১৯৪০ সালে লেখা ওই কবিতায় মনস্ক পাঠক দেখতে পাবেন :
ওই শোনা যায় রেডিয়োতে বোঁচা গোঁফের হুমকি –
দেশ বিদেশে শহর গ্রামে গলা কাটার ধুম কি!

রেডিয়োতে খবর জানায় বোমায় করলে ফুটো,
সমুদদুরে তলিয়ে গেল মালের জাহাজ দুটো।
….
আকাশ থেকে নামল বোমা, রেডিয়ো তাই জানায়-
অপঘাতে বসুন্ধরা ভরল কানায় কানায়।

গ‍্যাঁ গ‍্যাঁ করে রেডিয়োটা কে জানে কার জিত,
মেশিন্ গানে গুঁড়িয়ে দিল সভ‍্য বিধির ভিত…
“শ্রাদ্ধ” কবিতায় উপরের পংক্তি গুলিতে গলা কাটার ধুম, মালবাহী জাহাজ সমুদ্রে বোমার আঘাতে ডুবে যাওয়া, আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ করে নিরীহ মানুষকে হত‍্যা, এবং মেশিনগান দিয়ে সভ‍্য নিয়মকানুনকে গুঁড়িয়ে দেওয়া যত্নশীল পাঠকের নজর টানবে। আর “বোঁচা গোঁফের হুমকি” এই কথাটা পড়লেই ইতিহাস সচেতন পাঠক সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করতে পারেন কার কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতে চেয়েছেন।
হিটলারের ওই যে স্টুরমাবটেইলুঙ বা এস এ সংগঠন, ওরই একটা শাখা ছিল সিইচারহেইটডিয়েনস্ট, বা এসডি, বা আরো সহজ কথায় গেস্টাপো বাহিনী, যার কাজ ছিল শত্রু খুঁজে বেড়ানো। হারমান উইলহেলম গোরিং এই গেস্টাপো বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। পরে, ১৯৩৪ সালের কুড়ি এপ্রিল তারিখে ওই বাহিনীর রাশ তুলে দেন হাইনরিশ লুইটপোল্ড হিমলারের হাতে। ওই যে ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রাদ্ধ কবিতায় বলেন, হিটলারের তরফে ‘দেশ বিদেশে শহর গ্রামে গলাকাটার ধুম কি’, গেস্টাপো বাহিনী ছিল সেইসব শত্রু খুঁজে বেড়ানোর দায়িত্বে। ১৯৩৯ সালের নভেম্বরের ছয় তারিখে পোল‍্যাণ্ডের ক্রাকাও এলাকায় “সোনডার‍্যাকশন ক্রাকাউ” নাম দিয়ে গুণ্ডামি চালায় গেস্টাপো বাহিনী। জাগিয়েলোনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় ও ওখানে সমবেত অন‍্যান‍্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গবেষক ছাত্রদের ধরে ধরে সাজা দেওয়া হল। ১৮৪ জন স্কলারকে পাঠানো হল কনসেনট্রেশন ক‍্যাম্পে। সেখানে নির্যাতনের প্রহরে বাঁচলেন না অনেক স্কলার। ওই নভেম্বরেরই সতেরো তারিখে প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে তছনছ করল হিটলারের বাহিনী। চেক জাতিগোষ্ঠীর নয়জন স্নাতক ছাত্রকে নাৎসিরা খুন করল, আর বারোশো’র বেশি ছাত্রকে আটক করে কনসেনট্রেশন ক‍্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হল অকথ‍্য নির্যাতনের উদ্দেশে। আজো ওই নির্মমতার স্মরণে “আন্তর্জাতিক ছাত্র দিবস” পালিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিটলারের নাৎসি বাহিনীর এইসব কার্যকলাপের বিস্তারিত খবর রাখতেন। এছাড়াও বোমা বা টর্পেডো প্রয়োগে জাহাজ ডোবানো আর আকাশ থেকে বোমা ফেলে জনপদ ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। “শ্রাদ্ধ” কবিতা রচনার অল্প কয়েকটি মাস আগে ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৩ তারিখে এস এস অ্যাথেনিয়া ওশান লাইনার জাহাজটি জার্মান বাহিনীর হাতে টর্পেডো আক্রান্ত হয়ে অতলান্তিক মহাসাগরে ডুবে গেল। কয়েকটি দিন পরে, ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ এইচ এম এস কারেজিয়াস জার্মান বাহিনীর হাতে টর্পেডোয় ঘায়ল হয়ে ডুবল। অক্টোবর ১৪ তারিখে রয়াল ওক ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ জার্মান ইউ ৪৭ সাবমেরিনের হামলায় ডুবল। ডিসেম্বর মাসের ৪ তারিখে ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজ এইচ এম এস নেলসন একটি জার্মান ইউ ৩১ সাবমেরিনের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ওই ৪ তারিখেই ব্রিটিশ সাবমেরিন এইচ এম এস স‍্যামন একটি জার্মান সাবমেরিনকে টর্পেডোর ঘায়ে ডুবিয়ে দেয়। সেই প্রথম ব্রিটিশ বাহিনী জার্মান সাবমেরিনকে ডুবিয়েছিল।
হিটলার কিভাবে দানবিক হয়ে উঠেছিলেন, আমরা দেখেছি। তার সাথেই দেখেছি হিটলারের চারপাশের লোকজনকে। আর ভার্সাই চুক্তি। ভার্সাই চুক্তিতে যেভাবে জার্মানির সম্ভ্রমবোধকে অপদস্থ ও বিধ্বস্ত করা হয়েছিল, তার প্রতিক্রিয়ায় জার্মান জাত‍্যভিমান গজিয়ে উঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছিল।
সুদূর অতীতে ভারতে এক যুদ্ধনিপুণ রক্তপিপাসু চণ্ডাশোক ছিল। কলিঙ্গ যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ সৈন‍্যের প্রাণহানি করাতে সেই দানবের বাধে নি। মানুষের লাশের রক্ত গড়িয়ে দয়া নদীর জল লাল হয়ে গিয়েছিল। নদীর নামটি দয়া, আর তাতে ব‌ইছে রক্তের ধারা।
এরপরে আর সাহস করে মাথা তুলে অশোকের মুখোমুখি হয়ে চ‍্যালেঞ্জ করবে, দেশে এমন কোনো যোদ্ধা আর অবশিষ্ট ছিল না। তখন অশোকের পক্ষে চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকের আলখাল্লা পরে নিলেও আর সাম্রাজ্য হাতছাড়া হয়ে যাবার ভয় ছিল না। ক্রমে অশোক হয়ে গেলেন প্রিয়দর্শী।
যুদ্ধের মহাকাব‍্যের মতোই যুদ্ধের গল্প‌ও সাগ্রহে গিলেছে মানুষ। আকাশে মেঘ গর্জালে, বিদ‍্যুৎ চমকে সে দেব দানবের অসির ঝনৎকার দেখেছে। পুরাণে পুরাণে, মঙ্গলকাব‍্যে, সে গল্প ফাঁদল মহিষাসুরমর্দিনীর। মানবসমাজে যুদ্ধলোলুপতা এক ভয়াবহ মাত্রা পেয়েছে।
অথচ কবিকে দেখাতে হল যুদ্ধের ফলে এমনকি বিজয়ীর‌ও কোনো উপকার হয় না। রাবণের বিরুদ্ধে রাম যুদ্ধে জিতেছিলেন, এ যেমন সত‍্য, তার চেয়ে বেশি সত‍্য যাকে উদ্ধার করবেন ঘোষণা করে তিনি যুদ্ধে লিপ্ত হলেন, সেই সীতার উপর অবিচার আর মানসিক অত‍্যাচার করে তিনি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলেন।
খুব তন্নিষ্ঠ পাঠকের কাছে লোকরঞ্জনের কথাটা আবছা শোনাবে। জুরিসপ্রুডেন্স বলে, শত অপরাধী পার পেয়ে যাক, একটিও নিরপরাধ যেন সাজা ভোগ না করে। রাম, প্রজাপালক রাম নিঃশঙ্কচিত্তে সীতার বনবাস দণ্ড কার্যকর করিয়েছেন।
যুধিষ্ঠির ছিলেন ধর্মপুত্র। রথ তাঁর মাটির মালিন‍্য ছুঁত না। কিছুটা উপর দিয়ে চলত। যুদ্ধজয়ের লোভে তিনি মিথ‍্যা বললেন। শুধুমাত্র তাই নয়, ইতি গজ করে অর্ধসত‍্য বানালেন, যা মিথ‍্যার চেয়েও কূট। মিথ‍্যা দিয়ে কোনোভাবেই সত‍্য তৈরি করা যায় না। এ একেবারেই অসম্ভব। যুধিষ্ঠির নিজের সমস্ত অতীত গরিমা দু পায়ে ঠেলে অনৃতভাষণে লিপ্ত হলেন। তখন রথ তাঁর নেমে এল ধূলার ধরণীতে। আর নিরবচ্ছিন্ন স্বর্গবাস তাঁর জুটল না। প্রথমে নরকদর্শন করতে হয়েছিল। আর বাড়তি পাওনা হয়েছিল উত্তরার গর্ভস্থ শিশুর প্রতি সাংঘাতিক আঘাত।
যুদ্ধ মানেই তাই। কবিরা চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দেন, যুদ্ধ মানে আসলে মনুষ‍্যত্বের পরাজয়, মূল‍্যবোধের বিনষ্টি। নিয়ম মেনে যুদ্ধ এক কল্পকাহিনী মাত্র। একটা মিথ বা অতিকথা।
মহাকবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর সময়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কণ্ঠ ধ্বনিত করতে হয়েছে। বিচিত্রিতা কাব‍্যগ্রন্থের যাত্রা কবিতা, পরিশেষ কাব‍্যগ্রন্থের প্রশ্ন কবিতা, শ‍্যামলী কাব‍্যগ্রন্থের আফ্রিকা, আরোগ্য কাব‍্যগ্রন্থের ওরা কাজ করে…. রবীন্দ্র কাব‍্যসম্ভারে যুদ্ধবিরোধী ভাবনা নেহাত কম নয়।
শুধু কবির চোখ দিয়েই নয়, দর্শন, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, ও অর্থনীতির পরিশীলিত মন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যুদ্ধের গভীর গহন জায়গাটার দিকে তাকিয়েছিলেন। কালান্তরের লোকহিত প্রবন্ধে, এবং মানুষের ধর্ম, রাশিয়ার চিঠি, ও সভ‍্যতার সংকট সহ উগ্র জাতীয়তাবাদ বিরোধী আরো নানা প্রবন্ধে তাঁর এই মনটা খুঁজে পাওয়া যায়।
আমরা চাই বা না চাই, পুঁজিবাদ, তার ক্ষয়িষ্ণু চারিত্র‍্যবিন‍্যাস প্রতিক্রিয়াশীল অস্তিত্ব নিযে আমাদের বিকাশের রাস্তাটি আটক করে দাঁড়িয়ে আছে। পুঁজিবাদের সবচাইতে সংকটাপন্ন অবস্থাকে বলতে হবে সাম্রাজ্যবাদ‌। নাটক রক্তকরবী গড়ে তোলার আগে তিনি যক্ষপুরীর কথা ভেবেছিলেন। আর ভেবেছিলেন রাম রাবণের কথা। বয়স‍্যপ্রতিম সম্পর্কিত পৌত্র দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে আমেরিকা থেকে চিঠি লিখেছিলেন তিনি‌। সেখানে সাম্রাজ্যবাদের কুৎসিত রূপটি তিনি গোপন করতে চান নি।
আধুনিক যুগে যুদ্ধ কিভাবে ঘটছে, তার ঐতিহাসিক বাস্তবতা, আর ভিতরে ভিতরে অর্থনীতির সুতোর টান, দার্শনিক স্তরে জাতিঘৃণা, আর রক্তের বিশুদ্ধতার প্রলাপ রবীন্দ্রনাথকে যে ভাবিয়েছিল, এ জিনিসটা রবীন্দ্র সাহিত‍্যের চিন্তাশীল পাঠক মাত্রেই উপলব্ধি করবেন। কুখ্যাত জার্মান সমরনায়ক অ্যাডলফ হিটলার আর ইতালির ফ‍্যাসিস্ট নায়ক বেনিতো মুসোলিনি গোটা মানব সভ‍্যতার বিরুদ্ধে সাংঘাতিক যুদ্ধ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। উপাধি পাওয়া বৈজ্ঞানিক ভৃত‍্যদের কাজে লাগিয়ে হিটলার, মুসোলিনি তো বটেই, যে কোনো যুদ্ধোন্মাদ শাসক আস্ফালন করতে থাকে। ‘বৈজ্ঞানিক ভৃত‍্য’ কথাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুদিনের আবিষ্কার, সেই জুতা আবিষ্কার কবিতা থেকেই। আর রবীন্দ্রনাথের কল্পনায় কাঞ্চী ও কর্ণাট দ্বৈরথে কাঞ্চীরাজের হাতে শিশুদের ও তাদের অভিভাবকদের প্রবল নিগ্রহ ও লাঞ্ছনা বিদূষককে কী বলিয়েছিল, লিপিকার পাঠকের তা মনে থাকার কথা।
রামায়ণে কথিত আছে, হনুমান ব্রাহ্মণের বেশ ধরে মন্দোদরীর কাছ থেকে রাবণের মৃত‍্যুবাণ চেয়ে এনেছিল। দ্বৈপায়ন হ্রদের তীরে ন‍্যায়মূর্তি কৃষ্ণ ভীমকে অঙ্গুলিসংকেত করে নির্দেশ দেন, গদাঘাতে দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করো। আজ বিজ্ঞানকে সাথে নিয়েই যুদ্ধোন্মাদদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।
“গ‍্যাঁ গ‍্যাঁ করে রেডিয়োটা — কে জানে কার জিত,
মেশিন্ গানে গুঁড়িয়ে দিল সভ‍্যবিধির ভিত।
টিয়ের মুখে বুলি শুনে হাসছে ঘরে পরে —
রাধে কৃষ্ণ, রাধে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে”।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।