দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২৪৭)

পর্ব – ২৪৭

খোকা জিজ্ঞাসা করল, জ‍্যেঠু আমরা ঘুমোই কেন?
জ‍্যাঠামশায় বললেন, তোমার কি মনে হয়?
খোকা বলল, আমাদের শরীর বিশ্রাম চায়।
কেন চায়?
ক্লান্ত হয়।
কেন ক্লান্ত হয়?
খোকা বলল, কাজ করে তাই ক্লান্ত হয়। ঘুমিয়ে নিয়ে আবার  তরতাজা হয়ে ওঠে।
জ‍্যাঠামশায় বললেন, তাহলে ঘুম জিনিসটা দরকার?
খোকা বলল, হ‍্যাঁ। আমার মাসির বাড়ি একদিন গিয়েছিলাম। মাসির একটা বাচ্চা ছেলে আছে। এখনও খুবই ছোট। সে খুব ঘুমোয়।
জ‍্যাঠাইমা বললেন, ও কিরে, মাসির ছেলেকে ভাই বলতে হয়। মাসতুতো ভাই।
খোকা বলল, কেন তাকে আমি ভাই বলব, সে কি আমাকে দাদা বলে?
 জ‍্যাঠাইমা বললেন, খুব বুদ্ধি তোমার! ও কথা বলতে শিখবে, তবে না তোমাকে দাদা বলবে? ততদিনে তুমি স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা টপকে যাবে।
খোকা বলল, জ‍্যেঠু, ছোট বাচ্চারা অতো ঘুমোয় কেন?
ওদের দরকার হয়। সবে হয়েছে, এমন বাচ্চাদের দিনে সতেরো আঠারো ঘণ্টা অবধি ঘুমাতে হয়।
জ‍্যেঠু, আমার কতক্ষণ ঘুমানো উচিত?
তুমিই বলো, কতটা ঘুমোলে তোমার চলে?
ধরো দশটায় ঘুমিয়ে পড়লাম। আবার সকালে ছটায় উঠলাম।
তাহলে কয় ঘণ্টা হল?
আটঘণ্টা।
জ‍্যাঠামশায় বললেন, হ‍্যাঁ, তোমার বয়সী পড়ুয়াদের ঘণ্টা আষ্টেক ঘুমোনো ভাল।
 জ‍্যাঠাইমা বললেন, আমাদের বাড়িতে একটা ছেলে থাকত। পড়ত। সে নাকি রাত জেগে পড়ত। আর দিনের বেলা ঘুমাত। বাবা তার বেলায় পড়ে পড়ে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমানো দেখে খুব রাগ করতেন। সে শুনত না। বলত রাত জেগে পড়লে আমার পড়া ভাল হয়।
জ‍্যাঠামশায় বললেন, কেউ কেউ বলে বটে অমন কথা।
 খোকা বলল, বাবা বলেন, দিনের বেলা মোটেও ঘুমোবে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতেন সূর্য কখনোই তাঁকে বিছানায় শুয়ে থাকা দেখেন নি।
জ‍্যাঠাইমা বললেন, ওরে বাবা, দুটি ভাত খেলে আমার চোখে যেন রাজ‍্যের ঘুম জড়িয়ে আসে। কিন্তু আমাদের দিদিশাশুড়ি, তোর জ‍্যেঠুর ঠাকুরমা, কিছুতেই দুপুরে ঘুমাতেন না। কিন্তু রাত আটটা বাজল কি ঘুমিয়ে পড়তেন। উঠতেন কোন্ ভোরে। তখন একটু একটু কাক ডাকব ডাকব করছে। তখন বাগানে একটা শিউলি গাছ ছিল। তার ফুল ঝরে পড়ে থাকত। সাজি ভরে ফুল কুড়োতেন।
জ‍্যাঠামশায় বললেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওই গানটা শুনেছ? বিশ্ব যখন নিদ্রামগন গগন অন্ধকার…
আড্ডা চলছে টের পেয়ে খোকার মা এসে জুটলেন। জ‍্যাঠামশায় বললেন, বৌমা, গানটা একটু গাইতে চেষ্টা করছি। তুমি যেন হেসো না।
মা বললেন, বলেন কি দাদা, আপনি চমৎকার উচ্চারণ করেন। আর কি ঝকঝকে স্মৃতি! আমি অবাক হয়ে যাই।
জ‍্যাঠামশায় গাইছেন,
বিশ্ব যখন নিদ্রামগন, গগন অন্ধকার,
          কে দেয় আমার বীণার তারে এমন ঝঙ্কার ॥
নয়নে ঘুম নিল কেড়ে,   উঠে বসি শয়ন ছেড়ে–
                   মেলে আঁখি চেয়ে থাকি, পাই নে দেখা তার ॥
গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া প্রাণ উঠিল পুরে,
          জানি নে কোন্‌ বিপুল বাণী বাজে ব্যাকুল সুরে।
কোন্‌ বেদনায় বুঝি না রে   হৃদয়  ভরা অশ্রুভারে,
                   পরিয়ে দিতে চাই কাহারে আপন কণ্ঠহার ..
জানো বৌমা, কবিগুরু ১৯১০ সালে গানটা বেঁধেছেন । মানে তখনো নোবেল পুরস্কার পান নি। জানো বৌমা, ঘুম জিনিসটাকে আমাদের প্রাচীনপন্থী দার্শনিকরা তামসিকতা হিসেবে দেখিয়েছেন।
খোকা জানতে চাইল, জ‍্যেঠু, তামসিকতা মানে কি?
আগে বলো তমসা মানে কি?
খোকা চটপট জবাব দিল, জ‍্যেঠু, তমসা মানে অন্ধকার।
তামসিক হল তমসার গুণ। খেয়া কাব‍্যগ্রন্থে আগমন নামে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কবিতা আছে , ওখানে বলছেন,
দু এক জনে বলেছিল
‘চাকার ঝনঝনি’
ঘুমের ঘোরে কহি মোরা,
‘মেঘের গরজনি’।
এটাও নোবেল পুরস্কার পাবার আগেই লেখা।
মা বললেন, একটা গান আছে, কেন যামিনী না যেতে জাগালে না…
জ‍্যাঠামশায় গাইছেন, কেন    যামিনী না যেতে জাগালে না, বেলা হল মরি লাজে।
     শরমে জড়িত চরণে কেমনে চলিব পথেরি মাঝে।
আলোকপরশে মরমে মরিয়া     হেরো গো শেফালি পড়িছে ঝরিয়া,
     কোনোমতে আছে পরাণ ধরিয়া    কামিনী শিথিল সাজে॥
     নিবিয়া বাঁচিল নিশার প্রদীপ ঊষার বাতাস লাগি,
     রজনীর শশী গগনের কোণে লুকায় শরণ মাগি।
পাখি ডাকি বলে ‘গেল বিভাবরী’,   বধূ চলে জলে লইয়া গাগরি।
     আমি এ আকুল কবরী আবরি   কেমনে যাইব কাজে॥
জানো বৌমা, এটা রবিঠাকুরের অনেক আগে লেখা গান। ১৮৯৭। কবির বয়স তখন ছত্রিশ বছর। কবিপত্নী বেঁচে আছেন।
খোকা বলল, জ‍্যেঠু তুমি সব সময় সাল তারিখ বলো কেন?
মা বললেন, সালটা বললে, কোন্ সময়ে জিনিসটা হচ্ছে, স্পষ্ট করে বোঝা যায়। কোনটা আগে, কোনটা পরে।
 জ‍্যাঠাইমা বললেন, আমার বাবা বলতেন, বাম দিক ফিরে শোবে। শোয়ার সময় বলবে শয়নে পদ্মনাভঞ্চ। বলতো খোকা, পদ্মনাভ কে?
খোকা বলল, সবাই জানে। অনন্ত সলিলে বিষ্ণু শয়ান ছিলেন। তাঁর নাভি থেকে একটা পদ্ম উঠল, সেখানে ব্রহ্মা এসে বসলেন। পদ্ম নাভিতে যাহার। পদ্মনাভ। বহুব্রীহি সমাস।
কিন্তু আগে বলো, শয়নে পদ্মনাভঞ্চ বললে কি সুবিধা হবে?
জ‍্যাঠাইমা বললেন, কি জানি, বাবা বলতেন। আমরা অতো মুখে মুখে কথা বলতে সাহস করতাম না। বাবা একটা ডাক দিলেই অমনি ছুটে যেতাম।
সব সময় পায়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলতাম।
খোকা বলল, কি কথায় কি কথা! একটা জিনিস বলছি, তো কেন বলছি জানব না? যুক্তি তো থাকতে হবে। না বুঝে ভাল কাজ করাও ভাল নয়। যা কিছু করব, আগে বোঝাও কেন, তবে করব।
জ‍্যাঠাইমা বললেন, হ‍্যাঁ, তুমি যখন ছোট ছিলে, তোমাকে চাপড়ে চাপড়ে ঘুম পাড়াতাম। আরো ছোটবেলায় তোমার দোলনা ছিল। সেই দোলনায় দোল বন্ধ করলেই তোমার ঘুম ছুটে যেত। তোমার বাবা সেই দোলনা টাঙাতে গিয়ে নাকের ওপর আঘাত খেয়ে সে কি রক্ত!
খোকা বলল, জ‍্যাঠাইমা, তুমি থামবে? একটা দরকারি আলোচনা করছি, তোমার শুনতে ইচ্ছে হলে চুপ করে বসে শোনো। জ‍্যেঠু, আমরা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখি কেন?
জ‍্যাঠামশায় বললেন, না ঘুমালে স্বপ্ন দেখবে কি করে!
জ‍্যাঠাইমা বললেন, কিছু লোক কিন্তু দিবাস্বপ্ন দেখে।
খোকা বলল, জ‍্যাঠাইমা, দিবাস্বপ্নের কথা হচ্ছে না। আমি জেনুইন স্বপ্নের কথা বলছি। দিবাস্বপ্ন একটা ফালতু জিনিস। ওর কোনো ভিত্তি নেই। জ‍্যেঠু, স্বপ্নের কথা হচ্ছিল, আমরা স্বপ্ন দেখি কেন?
তার আগে শোনো স্বপ্ন নিয়ে মহাজনরা কে কি বলছেন। গ‍্যয়ঠে, জার্মানির লোক, তিনি বলছেন, তোমার স্বপ্ন যেন বেঁটে গোছের না হয়। কেননা অমন ক্ষয়া খর্বুটে জিনিস দিয়ে লোকজনের মন জয় করা শক্ত।
আর অস্কার ওয়াইল্ড, আয়ারল্যান্ডের সাহিত‍্যিক, স্বপ্ন নিয়ে কী বলছেন? তিনি বলছেন চাঁদের আবছা আলোয় যে লোক পথ খুঁজে বের করতে পারে, সেই হল স্বপ্নদ্রষ্টা। আর তার শাস্তি হল, বিশ্ববাসী ঘুম ভেঙে ওঠার আগেই সে ভোর হ‌ওয়া দেখতে পায়। জর্জ বার্নার্ড শ, ইনিও আইরিশ সাহিত‍্যিক, কি বলছেন জানো? বলছেন, তোমরা চারপাশে যা আছে, সেইসব জিনিস পত্তর দ‍্যাখো। আর দেখে প্রশ্ন করো, এগুলো কেন? আর আমি স্বপ্ন দেখি সেইসব জিনিস, যা ভূভারতে কোনোদিন ছিল‌ই না। আমি অবাক হয়ে ভাবি, এগুলো নেই কেন?
আর এঁদের সকলের চেয়ে বয়সে ছোট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলছেন, শালগাছের সমস্ত জীবনটাই স্বপ্ন। ও স্বপ্নে চলে এসেছে বীজ থেকে অঙ্কুরে, অঙ্কুর থেকে গাছে। পাতাগুলোই তো ওর স্বপ্নে ক‌ওয়া কথা।
খোকার বাবার পায়ের শব্দ শোনা গেল। কলেজ থেকে ফিরলেন। সেই শব্দ শুনেই মা উঠে গেলেন।
জ‍্যাঠাইমা বললেন, খোকা, আর আড্ডা নয়, ওঠো, পড়তে বসো, ন‌ইলে তোমার বাবা আবার রাগ করবেন।
খোকা উঠে পড়তে বসতে গেল।
জ‍্যাঠামশায় গান ধরলেন,
  আমি    কেবলই স্বপন করেছি বপন বাতাসে–
তাই    আকাশকুসুম করিনু চয়ন হতাশে॥
     ছায়ার মতন মিলায় ধরণী,    কূল নাহি পায় আশায় তরণী,
          মানসপ্রতিমা ভাসিয়া বেড়ায় আকাশে॥
কিছু    বাঁধা পড়িল না কেবলই বাসনা-বাঁধনে।
কেহ    নাহি দিল ধরা শুধু এ সুদূর-সাধনে।
     আপনার মনে বসিয়া একেলা   অনলশিখায় কী করিনু খেলা,
          দিনশেষে দেখি ছাই হল সব হুতাশে॥

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।