দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৯২)

পর্ব – ১৯২

নীরবতা ভাঙলেন ওসি। বললেন, শুনেছি পরীক্ষা সামনেই। এইমুখে এইভাবে আড্ডা মেরে বেড়ালে হবে?
শ‍্যামলী বলল, আমি তো পড়তেই চাইতাম। গান শিখতাম। ছেড়ে দিয়েছি। আবৃত্তি করতাম। আর করি না। স্কুলে যখন পড়তাম, নাটকের ডিরেকশন দিতাম। সবাই সুখ‍্যাতি করত। পড়াশুনাটা মন দিয়ে করব বলেই তো সব দিক থেকে নিজেকে গুটিয়ে এনেছিলাম।
ওসি বললেন, আপনি ভাল করে পড়লে সেটা সমাজের জন্য একটা ভাল কাজ হবে।
শ‍্যামলী বলল, আমি মন দিয়ে পড়াশুনার মধ‍্যে ডুব দিতে পারলাম ক‌ই? গোটা সন্ধেবেলাটা কারখানার কাজে মাথা দিতে হল।
ওসি বললেন, প্রত‍্যেককে নিজের নিজের বাস্তবতা নিয়ে বাঁচতে হয়। পরিবেশ পরিস্থিতি আপনাকে এই জায়গায় ঠেলে দিয়েছে। আপনাকে লড়তে হবে।
শ‍্যামলী বলল, লড়তে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু বিয়ে করা নিয়ে সারাক্ষণ বাড়িতে চাপ দিচ্ছে। এতে আমার অস্বস্তি। রক্তের সম্পর্ক না থাকলে কি তার সাথে সহজে মেশা যাবে না?
ওসি বলল, আপনি তো শুনলাম, নিজের দিদির বাড়িতেও তার বিয়ের পর একবারের জন‍্য‌ও যান নি। এটা কি ঠিক?
শ‍্যামলী বলল, কারণ ছাড়া কার্য হয়?
ওসি বললেন, তার মানে? নিজের দিদি জামাইবাবুর বাড়িতে না যাবার কারণ কি?
শ‍্যামলী বলল, কারণ বহুবিধ। প্রকাশ‍্য এবং অপ্রকাশ্য।
ওসি বললেন, প্রকাশ‍্য কারণগুলো তো জানতে পারি?
শ‍্যামলী বলল, দিদিরা মাঝে মধ্যে ই বাবা মায়ের কাছে আসে। কখনো কখনো রাতে থাকে। তখন অনেক গল্পগুজব হয়। তাই মোটামুটি প্রয়োজন মিটে যায়।
আর দ্বিতীয় কারণ হল, মানুষ কোথাও যায়, কিছু পাবে বলে। সমস্ত সম্পর্ক‌ই একটা না একটা উৎপাদন সম্পর্ক। সেই উৎপাদনের সুযোগ সম্ভাবনা না থাকলে খামোখা সময় নষ্ট কেউ করে?
ওসি বললেন, গতকাল আপনি রামনারায়ণ মিশ্রের বাড়ি গিয়েছিলেন। আমার কাছে খবর আছে। কিন্তু কেন?
শ‍্যামলী বলল, আমার একটা থাকার জায়গা বড্ড দরকার। তাই। অবশ‍্য ওঁকে আমি আর বলে উঠতে পারি নি। ওঁর বাচ্চাদের সাথে গল্পের ঝোঁকে সব ভুলে গিয়েছিলাম।
ওসি বললেন, তারপর গান শুনিয়েছিলেন। কোন্ গানটা?
শ‍্যামলী হেসে বলল, সব নিখুঁত করে খোঁজ নিয়ে রেখেছেন। আর এইটা শোনেন নি, এ কি হয়?
ওসি বললেন, যে গান‌ই গেয়ে থাকুন না কেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সব গান‌ই মানুষকে সত‍্য ও সুন্দরের প্রতি আকৃষ্ট করে। মানুষকে ভাল হতে বলে। রামনারায়ণ মিশ্র নিজের পুরোনো জীবনটাকে পিছনে ফেলে এই যে পুলিশ প্রশাসনের কাছে নির্দ্বিধায় আত্মসমর্পণ করলেন, এটা আমার খুব ভাল লাগল।
শ‍্যামলী বলল, আমার লাগল না।
ওসি বললেন, সব ব‍্যাপারেই একটা উলটো কথা বলে খুব মজা পান্  আপনি, তাই না?
শ‍্যামলী বলল, যেটা সকলে দ‍্যাখে, তার ভিতর অন‍্য কিছুকে দেখতে গেলে অন‍্য রকম করে ভাবতে শিখতে হয়।
ওসি বললেন, যেমন?
শ‍্যামলী বলল, লোকেরা দ‍্যাখে সূর্য পুবদিকে উঠে সারাদিন আকাশে চলে চলে বিকেল গড়ালে পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। তাই তারা ভাবে পৃথিবী স্থির, আর সূর্য চলছে। বিজ্ঞানীর চোখ দিয়ে দেখতে গেলে অন‍্য রকম দাঁড়িয়ে গেল। যা সোজা সহজ ভাবে গেলানো হয়, সবাই তো তা গিলবে না।
ওসি বললেন, আমি কি জিনিস গেলাতে চেয়েছি?
শ‍্যামলী বলল, আপনি বলছিলেন মিস্টার মিশ্রের বিরুদ্ধে কগনিজেবল অফেন্স এর অভিযোগ রয়েছে।
ওসি বললেন, হ‍্যাঁ বলেছি।
শ‍্যামলী বলল, তাহলে দরকার মনে করলে পুলিশ তাকে আটক করে কোর্টে চালান দিতে পারত। কগনিজেবল অফেন্সে তাই করার কথা। অথচ সেই করণীয় কাজটা পুলিশ করে নি। কেন করে নি, সেটা এক একজন লোক এক এক রকম ধরে নেবেন।
ওসি বললেন, সব করণীয় কাজ সবসময় করা যায় না।
শ‍্যামলী বলল, বিশেষ করে যখন অভিযুক্ত ব্যক্তির মাথায় নেতা মন্ত্রীর হাত থাকে, তখন সেই হাতের কারণে পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকে। শুনেছি, পুলিশের লোকেরা অভিযুক্ত ব‍্যক্তির সাথে এক টেবিলে চা খেতে খেতে থাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে রিপোর্ট দিতে পারে।
ওসি বললেন, পুলিশ তো একটা ব‍্যবস্থার অঙ্গ। সে তো বিচ্ছিন্ন হয়ে চলতে পারে না।
 শ‍্যামলী বলল, তাহলে মিশ্র যে অপরাধমূলক কাজগুলো করত বলে অভিযোগ, তা মিশ্রের নিজের ছাড়া আরো কারো না কারো স্বার্থরক্ষা করত। এমন‌ও হতে পারে, তাদের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে মিশ্রকে একটার পর একটা অপরাধ করে যেতে হচ্ছিল।
 ওসি বললেন, যাই হোক, দেরিতে হলেও মিশ্র যে আত্মসমর্পণ করল, তাতে ন‍্যায়ের প্রতি তার আগ্রহ দেখতে পারতেন।
শ‍্যামলী বলল শুনুন, এমন‌ও তো হতে পারে, নেতাদের খাঁই যেভাবে বেড়ে যাচ্ছিল, তাতে মিশ্র আর সামাল দিয়ে উঠতে পারছিলেন না।
 ওসি বললেন, তবুও আমি বলব, মিশ্র পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে ভাল কাজ করলেন।
শ‍্যামলী বলল, ডাহা বোকামিও করলেন।
ওসি বললেন, কেন, বোকামি বলছেন কেন?
শ‍্যামলী বলল, বেশি দিন আগের কথা নয়। এই চলতি  ১৯৮৪ সালের‌ই আঠারো মার্চ। কলকাতার গার্ডেনরীচে পুলিশ অফিসার বিনোদ মেহতার হত‍্যাকাণ্ডের কথা আপনাকে মনে করিয়ে দিতে বাধ‍্য হচ্ছি।
বিনোদ মেহতা এলি তেলি লোক ছিলেন না। আইপিএস অফিসার । কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার। তাঁকে আর তাঁর বডিগার্ড মোক্তার আলিকে গার্ডেন রীচে খুন করে ফেলা হল। পুলিশ বাহিনী মেহতার সঙ্গে যেতে চায় নি। ফতেপুর ভিলেজ রোডে মেহতাকে যে খুন করেছিল বলে অভিযোগ, সেই ইদ্রিস আলি যখন পুলিস কাস্টডিতে মারা গেল, তখন গল্পটা হজম করা একটু শক্ত হয়ে গেল না কি?
 ওসি বললেন, এই আলোচনাটা আমি আপনার সাথে করতে পারি না।
শ‍্যামলী বলল, আমিও চাই না, পুলিশের নিন্দা করতে। শুধু বলছি, কাস্টডিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুলিশ নিজের হাতে সাবাড় করে দিলে, তাকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত আছে, বলা যায় না। আমি আজকে উঠছি ওসি সাহেব। কিন্তু আমার দেশের আইন শ্রেণীস্বার্থনিরপেক্ষ নয়। রামনারায়ণবাবুকেও পুলিশ তার হাজতখানায় পিটিয়ে মেরে ফেললে আমি অবাক হব না।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।