জাহাজ, জলযাত্রা আর ডার‌উইনের ব‌ইপত্র – লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

চার্লস রবার্ট ডার‌উইনকে নিয়ে এইচ এম এস বীগল জাহাজ প্লিমাউথ সাউন্ড বন্দর থেকে ২৭ ডিসেম্বর, ১৮৩১ তারিখে জলে ভেসেছিল। জাহাজের ক‍্যাপটেন ছিলেন রবার্ট ফিটজরয়। ডার‌উইনের তখন বয়স তেইশ পেরোয় নি। ভূতত্ত্ব নিয়ে সে আগ্রহী।
তাকে বাবা ডাক্তারি পড়তে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু, ওতে তার মন বসে নি। পোকামাকড়, মাটি পাথরের দিকে ঝোঁক ছিল। তো বীগল জাহাজ চলেছিল সমুদ্রের পথ নিয়ে জানতে বুঝতে। সেই জাহাজের ক‍্যাপটেন চাইলেন ন‌ওজোয়ান ডার‌উইন সঙ্গে থাকুন। তাকে অবশ‍্য বাড়ির খরচেই যেতে হয়েছিল। তো, দুবছরের জন‍্য জলে ভাসতে বেরিয়ে বীগল ভেসে বেড়াল প্রায় পাঁচ বছর। তবে ডার‌উইন কিন্তু গোটা সময়টা জলে কাটান নি। জলে তিনি ছিলেন মোটে আঠারো মাস। বাকিটা ডাঙায়।
১৮৩৬ সালের ২ অক্টোবর বীগল ফিরল ইংল্যান্ডের মাটিতে। জলে জলে জাহাজীদের সাথে ঘোরার একটা বিবরণী লিখে ফেলেছিলেন ডার‌উইন। এইসব বুকে নিয়ে ১৮৩৯ সালে প্রকাশিত হল তাঁর ‘দি ভয়েজ অফ বীগল’। এই ভ্রমণ সেই সময় হয়েছিল, যখন পশ্চিম ইউরোপীয়রা পৃথিবীর নানা স্থানে ঘুরে বেড়িয়ে সেই সব জায়গাকে চেনা ও তার নিষ্ঠাবান বিবরণ ও ম‍্যাপ তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ডার‌উইন তাঁর এই ব‌ইটি বিবরণীর মতো তারিখ ধরে ধরে লেখেননি। বরং স্থানগুলিতে কিভাবে ঘুরেছেন, সে কথাই লিখেছেন। ব‌ইটি তিনি সাজিয়েছেন ভৌগোলিক এলাকা অনুযায়ী। জীববিদ‍্যা, ভূতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, কত কী নিয়েই না আলোচনা আছে এই ব‌ইতে! এইসব বিষয় নিয়ে এমনভাবে ডারউইন লিখেছেন, যা তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণী পরাক্রম প্রকাশিত করেছে।
 ডারউইন জন্মেছিলেন ১৮০৯ সালে। আর মৃত্যু ১৮৮২ সালে।
সারাজীবন ধরে কতো না ব‌ই লিখেছেন ডার‌উইন।
১৮৩৯ এ দি ভয়েজ অফ বীগলের পর ১৮৪২ সালে দি স্ট্রাকচার অ্যাণ্ড ডিসট্রিবিউশন অফ কোরাল রীফস, ১৮৬২ সালে ফার্টিলাইজেশন অফ অর্কিডস, ১৮৬৮ সালে দি ভ‍্যারিয়েশন অফ অ্যানিম‍্যালস অ্যাণ্ড প্ল‍্যান্টস আন্ডার ডামেসটিকেশন, ১৮৭১ সালে দি ডিসেন্ট অফ ম‍্যান অ্যাণ্ড সিলেকশন ইন রিলেশন টু সেক্স, ১৮৭২ সালে দি একসপ্রেশন অফ দি ইমোশনস ইন ম‍্যান অ্যাণ্ড অ্যানিম‍্যালস, ১৮৭৫ সালে ইনসেকটিভোরাস প্ল‍্যান্টস, ১৮৭৬ সালে দি এফেক্টস অফ ক্রস অ্যাণ্ড সেলফ ফার্টিলাইজেশন ইন দি ভেজিটেবল কিংডম, ১৮৭৭ সালে দি ডিফারেন্ট ফর্মস অফ ফ্লাওয়ারস অন প্লান্টস অফ দি সেম স্পিসিস, ১৮৮০ সালে চমৎকার একটি ব‌ই লিখলেন ‘দি পাওয়ার ইন মুভমেন্ট ইন প্ল‍্যান্টস’,
 ১৮৮১ সালে জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে অশক্ত দুর্বল শরীরে প্রবীণ ডার‌উইন লিখেছেন ‘দি ফরমেশন অফ ভেজিটেবল মোল্ড থ্রু দি অ্যাকশন অফ ওয়র্মস’।
তবে যে ব‌ইটির জন‍্য চার্লস ডার‌উইনের বিশ্বজোড়া খ‍্যাতি, সে হল ১৮৫৯ সালের ‘অন দি অরিজিন অফ স্পিসিস বাই মিনস অফ ন‍্যাচারাল সিলেকশন’।
বুড়ো হাড়ের ভেলকি বলতে যা বোঝায়, ঠিক তাই যেন দেখিয়েছেন কেঁচোর কীর্তি কাহিনী নিয়ে ওই ১৮৮১ সালের ব‌ইটায়। এইটিই বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে তাঁর শেষতম ব‌ই। এটাকে ছোট করে অনেক সময় ‘ওয়র্মস’ বলেও পরিচিত করা হয়।
বীগল জাহাজে চড়ে সেই যে তিনি ভ্রমণ পর্যবেক্ষণে বেরিয়েছিলেন ১৮৩১ সালে, সেখান থেকে ফিরলেন ১৮৩৬ সালের অক্টোবরে। এই সময় নিজের সংগৃহীত তথ‍্য সাজানো, তথ‍্য বিশ্লেষণ নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে পরিশ্রম করতে করতে ডার‌উইন অসুস্থ হয়ে পড়েন।
২০.০৯.১৯৩৭ তারিখে তিনি কঠিনরকম অসুস্থ হয়ে পড়লে, তাঁর চিকিৎসকরা তাঁকে সব রকম গবেষণা ছেড়ে ছুড়ে পূর্ণমাত্রায় বিশ্রাম নিতে নির্দেশ দেন।
 এইসময় গ্রামে আপনজনের বাড়িতে বিশ্রাম নিতে যান ডার‌উইন। গ্রামে তাঁর আত্মীয় তাঁকে দেখালেন যে, কিছু চুনাপাথর আর পাথর একজায়গায় ছিল। তার উপর মাটি তৈরি হয়েছে। আত্মীয় বললেন যে, এটা বোধহয় কেঁচোর কাজ। আত্মীয়টি জানতেন, ডার‌উইন মহাদেশের সরণের মতো বিরাট মাপের ভূতত্ত্ব বিষয়ক গবেষণায় রত। তাই তিনি ভাবতেই পারেন নি যে ডার‌উইন এই অতি তুচ্ছ কেঁচোর ব‍্যাপারে আগ্রহ নেবেন।
 কিন্তু ওই আত্মীয়ের জানা ছিল না যে, মহাসমুদ্রের গভীরে প্রবাল প্রাচীর গড়ে তোলে যারা, সেই প্রবাল আসলে একধরণের পোকার শ‍রীর। মহাসমুদ্রের বহু দ্বীপ এই প্রবালের দেহাবশেষ দিয়ে গড়ে উঠেছে। আর ডার‌উইন এই প্রবালদ্বীপের গড়ে ওঠা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তাঁর দেখানো কেঁচোর কর্মকাণ্ড ডার‌উইনের মন জয় করল। ১৮৩৭ এর অক্টোবরের একুশে ডার‌উইন লণ্ডনে ফিরলেন এবং কেঁচোর কীর্তি কাহিনী নিয়ে একটা প্রবন্ধ তৈরি করলেন। ১ নভেম্বর ১৮৩৭ সে প্রবন্ধ লণ্ডনের জিওলজিক্যাল সোসাইটিতে পড়লেন। ১৮৩৮ সালে সে প্রবন্ধ ওই সংস্থার প্রসিডিংসে স্থান পেল। ১৮৪০এ ওই প্রবন্ধ অলংকরণ সহযোগে জিওলজিক্যাল সোসাইটির পত্রিকায় প্রকাশ পেল।
১৮৩৮ এর শেষ দিক থেকেই তিনি বীগল জাহাজ থেকে তাঁর পর্যবেক্ষণলব্ধ ভূতাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে ‘দি স্ট্রাকচার অ্যাণ্ড ডিসট্রিবিউশন অফ কোরাল রীফস’ নামে তিন ভলিউম ব‌ইয়ের প্রথম খণ্ডটি প্রকাশ করে ফেললেন। ১৮৪২ এর সেপ্টেম্বরে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে গাছপালা ও প্রাণী নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালালেন।
জীবনের শেষের দিকে, ১৮৭৬ সালে, যখন তিনি নাতির মুখ দেখতে চলেছেন, নিজের লেখালেখির জীবন অন্তিমে পৌঁছেছে ভেবে, আর কদিন পরেই কবরে শুয়ে যাদের সাথে মেলামেশা করতে হবে, সেই কেঁচোদের কথা ভাবতে সাধ হল। কেঁচো কি খায়, কিভাবে থাকতে পছন্দ করে, কেঁচোরা আলো কতদূর অপছন্দ করে, এসব ঘনিষ্ঠ ভাবে লক্ষ্য করতে শুরু করলেন। এমনকি কেঁচোর যৌনজীবনে পর্যন্ত রীতিমতো উঁকি মারলেন। তিনি দেখলেন, কেঁচো নিজের গর্তের ভিতরে আরাম করে থাকবে বলে, গাছের শুকনো পাতা টেনে নিয়ে যায়। আর কোন্ দিক দিয়ে পাতাটা টানলে তা গর্তে ঢোকাতে সুবিধা হবে, সেটাও কেঁচো বেশ বুঝতে পারে।
 কেঁচো যে কাঁচা গাজর খেতে ভালবাসে, সেটা তিনি লক্ষ্য করে জানলেন। তারা আলো খুবই অপছন্দ করে। তবুও উপযুক্ত যৌনসঙ্গী পেয়ে গেলে, সেই আলোর উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে আলোর মধ‍্যেই যৌনমিলন করে নেয়। কেঁচোরা একে অপরের সাথে কোলাকুলি করে। এইসব দেখে ভেবেচিন্তে ডার‌উইন কেঁচোর মধ‍্যেও যেন একধরনের বুদ্ধিশুদ্ধি খুঁজে পেলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, প্রতি একর জমিতে প্রায় ৫৩৭৬৭টি কেঁচো বসবাস করে। এরা মাটির নিচে প্রায় পাঁচ ছয়ফুট গভীরে চলে গিয়ে মাটি তুলে আনে। আর এভাবে চাষির সুবিধা করে দেয়। এই বাবদে এদের কাছে সভ‍্যতার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। এক ভোজসভায় কার্ল মার্কসের জামাইয়ের সঙ্গে আড্ডা মারতে মারতে তিনি বলেছিলেন কেমন করে কেঁচোর মতো এমন অতি তুচ্ছ প্রাণীর মধ‍্যে তিনি অসামান্য একটি ক্ষমতা দেখতে পেলেন।ডার‌উইন বুঝেছিলেন, সামান‍্যের মধ‍্যেও অসামান‍্যের সংকেত থাকে।
প্রাণের সকল ধরণের প্রকাশের প্রতি অকুণ্ঠ সহমর্মিতায় মহাবিজ্ঞানী বলছেন, মানুষের সবচাইতে বড় অর্জনযোগ‍্য গুণ হল সকল রকম জীবের প্রতি ভালবাসা। বলছেন, এমন নয় যে গায়ে গতরে খুব শক্তিশালী প্রজাতির জীবগুলিই টিঁকে যায়। এমন‌ও নয় যে, সবচাইতে বুদ্ধিমান প্রজাতির জীবগুলিই টিঁকে যায়। সত‍্যি বলতে কি, তারাই টিঁকে থাকে, যারা সময়ের সাথে নিজেকে বদলে নিতে পারে।
ডার‌উইন বলছেন, আমার মনে হয়, মানুষের এত অসাধারণ সব গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও তার মোটেই ভোলা উচিত নয় যে, অত্যন্ত নিচু স্তরের প্রাণী থেকেই তার উদ্ভব হয়েছে। তখন কেঁচো সগৌরবে ঘুরে বেড়াতে থাকে। বলছেন, আমি বোকার মতো পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে ভালবাসি। আমি সর্বদাই তেমনটা করি। কেঁচো তখন মুখ তুলে তাকায়। তার দিকে গভীর আগ্রহে তাকিয়ে ডারউইন আবার বলেন, যে মানুষ একটা ঘণ্টা সময় নষ্ট করতে ভয় পায়, সে কখনো জীবনের মূল‍্য বুঝতে পারে না। কবরে শুয়ে থাকা শরীরটা ভেদ করে কেঁচো ঘোরাফেরা করে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।