অনসূয়া চ্যাটার্জির বাড়িতে ফিরে বেসিনে মুখ ধুয়ে বসতে না বসতেই একগ্লাস ছাতুর শরবত এনে দিল সহায়িকা। বলল, ভাত খেতে একটু দেরি আছে।
শ্যামলীর মনে পড়ল, ছেলেদের কলেজের ক্যান্টিনে সবজি ভাত খেত সে। রিডিং রুমে পড়াশুনা করলে ফুডকুপন পাওয়া যায়। সকালে বাড়ি থেকে চা বিস্কুট খেয়েই চলে যেত সে। দুপুরে খিদের মুখে ক্যান্টিনে যা দিত, অমৃত মনে হত। সেই অতিসাধারণ চালের ভাত ফুটতে গিয়ে অসাধারণ একটা গন্ধ পেত নাকে। ভাতের গন্ধ নিয়ে কত কবি কত কবিতা লিখেছেন।
হোস্টেলের ব্যবস্থা হয়ে যেতে শ্যামলী খুব নিশ্চিন্ত বোধ করছিল। থাকার আশ্রয় জুটল। একটা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল তার। কতজনকে বলবে ভেবেছিল শ্যামলী। বলতে পারেনি। আত্মসম্মানবোধে বেধেছে। আর আজ কিভাবে সব কিছু সমাধান হয়ে গেল। শুধু থাকা নয়, খাবার খরচটাও জুটবে। জীবনানন্দ দাশের কবিতার কথা মনে পড়ে শ্যামলীর।
খররৌদ্রে পা ছড়িয়ে বর্ষীয়সী রূপসীর মতো ধান ভানে— গান গায়— গান গায়
এই দুপুরের বাতাস।’
এত কষ্ট কেন পৃথিবীতে? দার্শনিক বলবেন আকাঙ্ক্ষা থেকেই যত বেদনা ও দুঃখের উৎপত্তি। কিন্তু আমি তো কারো কাছে কিছুই চাই নি। বাবার কাছে কি কিছু চেয়েছি? দিনের পর দিন পড়াশুনার সময় কাটছাঁট করে সারা সন্ধ্যায় কারখানায় শ্রম দিয়েছি। ব্যাঙ্কে কারবারের লেনাদেনা, মহাজনের সাথে যোগাযোগ, কাস্টমার ধরার চেষ্টা। বিনিময়ে কোনো কিছু আশা করেছি আমি? তবুও ভায়েরা তাকে অকারণে ঈর্ষা করে গেছে। গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছে। কুৎসিত ইঙ্গিত করেছে। জীবনানন্দ লিখছেন,
‘সৃষ্টির মনের কথা মনে হয়— দ্বেষ।
সৃষ্টির মনের কথা: আমাদেরি আন্তরিকতাতে
অামাদেরি সন্দেহের ছায়াপাত টেনে এনে ব্যথা
খুঁজে আনা। প্রকৃতির পাহাড়ে পাথরে সমুচ্ছল
ঝর্ণার জল দেখে তারপর হৃদয়ে তাকিয়ে
দেখেছি প্রথম জল নিহত প্রাণীর রক্তে লাল
হ’য়ে আছে ব’লে বাঘ হরিণের পিছু আজো ধায়;
মানুষ মেরেছি আমি— তার রক্তে আমার শরীর
ভ’রে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার
ভাই অামি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু
হৃদয়ে কঠিন হ’য়ে বধ ক’রে গেল, ‘
রমানাথের বাড়িতে জ্যেঠাইমার দুর্ব্যবহারটা তাকে প্রাণে সব চাইতে বড় ব্যথা দিয়েছে। ডাইনি বলবে? এত ক্লিন্নতা তাঁর মনের ভিতরে? ভালই হয়েছে জাল ছিঁড়ে গেছে। এতখানি কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবেশে তার দমবন্ধ হয়ে যেত।
‘ইতিহাস অর্ধসত্যে কামাচ্ছন্ন এখনো কালের কিনারায়;
তবুও মানুষ এই জীবনকে ভালোবাসে; মানুষের মন
জানে জীবনের মানে: সকলের ভালো ক’রে জীবনযাপন।
কিন্তু সেই শুভ রাষ্ট্র ঢের দূরে আজ।
চারিদিকে বিকলাঙ্গ অন্ধ ভিড়— অলীক প্রয়াণ।
মন্বন্তর শেষ হ’লে পুনরায় নব মন্বন্তর;
যুদ্ধ শেষ হ’য়ে গেলে নতুন যুদ্ধের নান্দীরোল;
মানুষের লালসার শেষ নেই;
উত্তেজনা ছাড়া কোনো দিন ঋতু ক্ষণ
অবৈধ সংগম ছাড়া সুখ
অপরের মুখ ম্লান ক’রে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ
নেই।
কেবলি আসন থেকে বড়ো, নবতর
সিংহাসনে যাওয়া ছাড়া গতি নেই কোনো।
মানুষের দুঃখ কষ্ট মিথ্যা নিষ্ফলতা বেড়ে যায়।’
তার ঝিমুনি ভাঙল কাজের সহায়িকার ঠেলাঠেলি তে। ওমা, দেখেছ, এত বড়ো মেয়ে, টেবিলে মাথা রেখে কি রকম ঘুমিয়ে পড়েছে! ঘুমিয়ে একেবারে কাদা! এই রকম জানলে আগেই ভাত খাইয়ে দিতাম গো!
কাজের সহায়িকা বলল, কি করব বলো, আমরা হুকুমের চাকর। দিদি যে নিজেও খুব খেতে পারে, তা মোটেও মনে কোরো না। এই একটুখানি ভাত খায়। তিন বছরের ছেলের মতো। কিন্তু রান্না করতে হবে। দেখে সুখ পায়।
আশ্চর্য হয়ে গেল শ্যামলী। তাহলে এসব রান্না খায় কে?
কাজের সহায়িকা বলল, আমরা খাই। এই যে আমরা পাঁচ ছজন আছি।
শ্যামলী হাসল। হোস্টেলে কেমন রান্না হয় কে জানে? সেখানে যাই রান্না হোক, সে চাঁদপানা মুখ করে খেয়ে নেবে।
কাজের সহায়িকা বলল, হ্যাঁ গো, রান্না ভাল লেগেছে?
শ্যামলী তখন একটু খেয়ে উঠতে পারলে বাঁচে। বিছানায় একটু শুতে পেলেই হল! যত রাজ্যের ঘুম নেমে আসছে চোখে। এত ঘুম কোথায় ছিল কে জানে?