• Uncategorized
  • 0

চলন্ত ও পরিবর্তনশীল বিশ্বের খোঁজে বিজ্ঞানসাধকেরা – লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।
এই ফেব্রুয়ারি এক অদ্ভুত সুযোগ এনে দিল আমায়। একই সাথে কোপার্নিকাস ব্রুনো আর গ‍্যালিলিওকে নিয়ে ভাবতে মনে করিয়ে দিল। কথা শুরু করি নিকোলাস কোপার্নিকাসকে নিয়ে। ঊনিশে ফেব্রুয়ারি ছিল তাঁর জন্মদিন। তাঁর  সময় চালু ধারণা ছিল যে পৃথিবী স্থির আর সূর্য তার চার দিকে ঘুরছে। এর বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে অনেক কথা বলা হলেও ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ পৃথিবীর নিশ্চলতার পক্ষে ছিলেন বলে, অনেক বোদ্ধা ব্যক্তিও সব বুঝে শেষমেশ পৃথিবীকে দাঁড় করিয়ে, অন্য সকল গ্রহ নক্ষত্রকে তার চার দিকে ছুটিয়ে মারতেন। চার্চের ভয়ে, আর পিঠের চামড়া বাঁচাবার দায়ে এ কাজ তাদের করতে হত।
নিকোলাস কোপার্নিকাস ছিলেন বিজ্ঞানের অধ্যাপক। ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৪৭৩ সালে তিনি জন্মেছিলেন, আর ১৫৪৩ এর ২৪ মে তারিখে তিনি মারা যান।
নিকোলাস কোপার্নিকাস বুঝতে পেরেছিলেন যে, পৃথিবী স্থির আর সূর্য তার চার দিকে ঘুরছে, এই মতটা একেবারে ভুলভাল। একেবারেই অন্তঃসারশূন্য। কিন্তু সেটা স্পষ্টভাবে সোজা সরল ভাষায় পাঁচজনের সামনে বুঝিয়ে বলার জমানা ছিল না। তাই চার্চের কোপের ভয়ে, উৎপীড়িত হবার  ভয়ে, কোপার্নিকাস তার দীর্ঘ গবেষণাসঞ্জাত উপলব্ধি পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন একেবারে নিজের মৃত্যুশয্যায়। সে বইয়ের নাম  দ্য রেভোল্যুশনিবাস অরবিয়াম কোয়েলেস্টিইয়াম De revolutionibus orbium coelestium (On the Revolutions of the Celestial Spheres), । সেই বইয়ের কপি গিয়ে পড়েছিল  এক পাদ্রি সাহেব জিওর্দানো ব্রুনোর ( ১৫৪৮ – ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৬০০) হাতে। তিনি সেই বই পড়ে নিশ্চিত হলেন যে সূর্যকে ঘিরেই পৃথিবী ঘুরছে। আর সেই কথা তিনি প্রকাশ্যে বলা শুরু করে দিলেন। চার্চ জিওর্দানো ব্রুনোকে ধর্মদ্রোহী বিবেচনা করে প্রাণদণ্ড দেন। পাদ্রি সাহেবকে খুঁটিতে বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। মারার আগে তাঁর জিভ কেটে নেওয়া হয়ে ছিল যাতে পুড়তে পুড়তেও উপস্থিত জনতার সামনে বৈজ্ঞানিক সত্য প্রকাশ করে দিতে না পারেন।
ব্রুনো সৌরজগত সম্পর্কে কোপার্নিকাসের মতবাদ সমর্থন করার পাশাপাশি বলেছেন দূর আকাশের নক্ষত্রগুলি আসলে এক একটি সূর্য। তিনি বিশ্বাস করতেন সূর্য ও তার গ্রহমণ্ডল নিয়ে যে জগৎ, তা ছাড়া আরো বিস্তর সূর্যসম জ‍্যোতিষ্ক ও তাদের গ্রহমণ্ডল থাকা খুবই সম্ভব। তিনি ভাবতেন মহাবিশ্ব প্রকৃতপক্ষে অপরিমেয় অর্থাৎ অসীম, এবং এই মহাবিশ্বের সুনির্দিষ্ট কোনো কেন্দ্র নেই। ১৫৮৪ সালে প্রকাশিত তাঁর দুটি গবেষণা পুস্তক লা সেনা ডি লে সেনেরি এবং ডি লা ইনফিনিটো ইউনিভারসো এট মোন্ডি তে এই চিন্তা ধরা আছে। ব্রুনোর প্রয়াণ দিবস ছিল ১৭ ফেব্রুয়ারি।
জিওর্দানো ব্রুনোর সূত্রে আমরা সুইডেনের বিজ্ঞানী টাইকো ব্রাহে ( ১৪. ১২. ১৫৪৬ – ২৪.১০. ১৬০১) এর কথা স্মরণ করতে পারি। চাঁদ যে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে, এ কথা তিনি গাণিতিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বলেছিলেন।
কিন্তু ব্রাহে ছিলেন পুরাতন পন্থী। অসাধারণ গাণিতিক দক্ষতা ও পর্যবেক্ষণে অসামান্য কৃতিত্ব সত্ত্বেও ব্রাহে তাঁর পশ্চাৎমুখী দার্শনিক অবস্থানের কারণে বিশ্বাস করতেন আরিস্ততলীয় পদার্থবিজ্ঞানে, টেলিস্কোপের সাহায্য না নিয়েই তিনি আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে অভ‍্যস্ত ছিলেন। ব্রাহে আস্থা রাখতেন পৃথিবীকেন্দ্রিক বিশ্বভাবনায়। ১৫৮৮ সালে ব্রাহে দুটি পুস্তক প্রকাশ করেন। ইনট্রোডাকশন টু দ‍্য নিউ অ্যাস্ট্রোনমি এবং অ্যাবাউট রিসেন্ট ফেনোমেনা ইন দ‍্য সেলেসচিয়াল ওয়ার্ল্ড। পরবর্তীকালের বিশ্ববিখ্যাত জ‍্যোতির্বিজ্ঞানী জোহান্স কেপলার তাঁর কনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করলেও কেপলার ব্রাহের চিন্তাগত ভিত্তির দুর্বলতা ও পশ্চাৎমুখীনতা সম্বন্ধে জানতেন। কেপলারের সাথে মিলে টাইকো ব্রাহে দৃশ্যমান নক্ষত্রের অবস্থান সমন্বিত তালিকা রুডলফিন টেবল প্রকাশ করেন।
ওই যে জোহান্স কেপলার ( ২৭.১২.১৫৭১ – ১৫.১১. ১৬৩০) নামে মহাবিজ্ঞানীর কথা বলছিলাম, তিনি ছিলেন জার্মানির মানুষ। এই অসামান্য  গণিতপ্রতিভা গ্রহগুলির চলনগতি নিয়ে গবেষণা করে অ্যাস্ট্রোনমিয়া নোভা ( ১৬০১) পুস্তক রচনা করেন। তাঁর পর্যবেক্ষণলব্ধ জ‍্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার আরো নিদর্শন ধরা আছে মিসটেরিয়াম কসমোগ্রাফিকাম (১৫৯৬), হারমোনিসেস মুন্ডি (১৬১৯), তিন খণ্ডে এপিটোম অ্যাস্ট্রোনমিয়া কোপার্নিকা ( ১৬১৮ – ১৬২১) প্রমুখ বইতে। কেপলারের সাধনা বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইজ‍্যাক নিউটনকে প্রভাবিত করেছিল।
কিন্তু সেরা কাজটি করে দেখালেন বিজ্ঞানী গ‍্যালিলিও। গত পনেরো ফেব্রুয়ারি ছিল গ‍্যালিলিও গালিলেইর প্রয়াণদিবস। গ‍্যালিলিও গালিলেই (  ১৫.০২.১৫৬৪ –  ০৮.০১.১৬৪২) ছিলেন উঁচুদরের বিজ্ঞানী। হান্স লিপারসে নামে এক চশমা শিল্পী একটা নলের দুপাশে দুটো লেন্স লাগিয়ে দূরের জিনিসকে কাছে দেখার খেলনা তৈরি করেছেন শুনে তিনি নিজেই লেন্স এর ফোকাস দূরত্ব বিষয়ক অঙ্ক কষে টেলিস্কোপ বা দূরবীন বানান। হান্স লিপারসে টেলিস্কোপ বানান ১৬০৮ সালে। আর গ‍্যালিলিওর হাতে গাণিতিক সূত্রের ভিত্তিতে লেন্স গঠন আর স্থাপনার প্রকৌশলে গ‍্যালিলিওর সেই দূরবীন হয়ে উঠেছিল বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম, আর সেই দূরবীনে আকাশ দেখা তাঁকে পেয়ে বসে। তিনি দেখতেন গ্রহ নক্ষত্রের চলন। দেখতেন আর সেই নিয়ে অঙ্ক কষতেন। নিজের তৈরি যোগে তন্নতন্ন করে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে করতে গ্যালিলিও দেখতে পেয়েছিলেন বৃহস্পতি গ্রহকে ঘিরে তার উপগ্রহগুলি ঘুরছে। প্রথম দিন তিনি তিনটি উপগ্রহ দেখেন। সেগুলির নাম ইউরোপা, আইও আর ক্যালিস্টো। পরদিন তিনি দেখেন গ্যানিমিড, যেটি বৃহস্পতির সর্ববৃহৎ উপগ্রহ।
১৬১০ সাল নাগাদ গ‍্যালিলিও নিজের টেলিস্কোপ বানিয়ে দেখে ফেললেন বৃহস্পতির উপগ্রহ চলছে, শনির বলয় ঘুরছে, শুক্রের কলার হ্রাস বৃদ্ধি হচ্ছে। আর চাঁদের পৃষ্ঠতল বড়ই অমসৃণ।
গ্যালিলিও বিবেচনা করলেন, যদি বৃহস্পতিকে ঘিরে তার চার চারটি উপগ্রহ ঘুরছে, এটা চোখে দেখা যায়, পাঁচজনকে দেখানো যায়, তাহলে পৃথিবীই তাবৎ মহাবিশ্বের কেন্দ্রে এই কথা বলার যুক্তি কি? গ্যালিলিও পৃথিবীর গতিশীলতার সপক্ষে আর সূর্যকেন্দ্রিক চলনের সপক্ষে বললেন।
ব্রুনোর মতো তাঁর বিরুদ্ধেও নেমে এল চার্চের আঘাত। কারাদণ্ড । সেখানে অশেষ নির্যাতন সয়েছেন তিনি।
গত আট জানুয়ারি ছিল মহান গ‍্যালিলিওর প্রয়াণ দিবস। সেই মানুষটি যিনি সত্যের সপক্ষে প্রাণ হাতের মুঠোয় করে মাথা তুলে দাঁড়াতে ভয় পান নি, দ্বিধা করেন নি।
 কিন্তু কেন প্রচলিত সমাজ বাস্তবতার পায়ে মাথা না ঠেকিয়ে ওঁরা অন‍্য পথে চললেন? কেন এত বড় ঝুঁকি নিলেন?  নিকোলাস কোপার্নিকাস বলেছিলেন, আমি এখন যা বলছি, তা শুনে আপনাদের হয়তো বা দুর্বোধ্য লাগবে, কিন্তু সময় আসুক, সঠিক জায়গায় কথাগুলি ঠিক ঠিক খেটে যাবে। এঁরা ছিলেন একলা মানুষ। দল পাকিয়ে ক্ষমতা হাসিল করার কথা ভাবতেই পারতেন না তাঁরা।
যাঁরা চিন্তাবিদ, তাঁরা একলা না হলে ঠিক মনের কথাগুলো ভেবে নিতে পারেন না। আর্থার শোপেনআওয়ারের একটা কথা মনে পড়ে, একটা মানুষ যতক্ষণ না একলা হচ্ছে, ততক্ষণ সে নিজেকে খুঁজেই পায় না। যে লোক একাকীত্বকে ভালবাসে না, সে বুঝি স্বাধীনতা বোধকেও পছন্দ করে না। যখন কেউ একলা হয়, একমাত্র তখনই সে সত‍্যিকারের স্বাধীন হয়। ব্রুণো, গ‍্যালিলিও সত‍্যিকারের স্বাধীন মন বলতে কি বোঝায়, আমাদের টের পাইয়ে দিয়েছেন।
কোপার্নিকাস, ব্রুণো, গ‍্যালিলিও, এঁদের কথা ভাবতে ভাবতেই  লিওনার্দো দা ভিঞ্চির কথা মনে করি। লিওনার্দো (১৫.০৪.১৪৫২ – ০২.০৫.১৫১৯) মহান চিত্রকর ছিলেন । মোনালিসা এঁকেছিলেন। আর লাস্ট সাপার। শুধুই তো বড়মাপের চিত্রকর ছিলেন না, ছিলেন বড়মাপের ইঞ্জিনিয়ার। টেকনোলজিস্ট। শুধুই তাই নয়, অ্যানাটমি ফিজিওলজিতে অসম্ভব পারদর্শিতা ছিল তাঁর। ছিলেন একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী চিন্তাবিদ। সত‍্যিকারের রেনেসাঁস পুরুষ।
মোনালিসা আঁকতে ভিঞ্চি সাংঘাতিক ভাবে নিজেকে তৈরি করেছেন। নাক চোখ ঠোঁট, মুখের পেশির গড়ন কি রকম জানবেন বলে মৃত মানুষের শরীর কেটে কেটে পরীক্ষা করতেন। জানার অদম‍্য নেশায় পাগল। চূড়ান্ত পর্যায়ে নিখুঁত করতে চেয়েছেন।
ভিঞ্চির লাস্ট সাপার ছবির সামনে দিয়ে হাঁটলে মনে হবে যীশুর হাত আর শরীর যেন নড়ছে। বাস্তব জীবনকে কতটা নিখুঁত করে জানলে এমন অসাধারণ শিল্পসৃষ্টি করা যায় ! অথচ কতদিন আগের মানুষ। কোপার্নিকাস জন্মেছিলেন ১৪৭৩ সালে। আর তারও একুশ বছর আগে দা ভিঞ্চির জন্ম। ১৫১৯  সালে সাতষট্টি বছর বয়সে ভিঞ্চি মারা যান। কোপার্নিকাস মারা যাবেন ১৫৪৩ এ। বছর চব্বিশ পরে। তাহলে কোপার্নিকাসের বই তো তাঁর পড়বার প্রশ্ন ওঠে না। তবু ভিঞ্চি বলতে পেরেছিলেন, ইল সোলে নন সাই মুভ। ওর মানে হল, পৃথিবীটা ঘুরছে। এই কথাটাই গ‍্যালিলিও বলেছিলেন। গণিতের প্রমাণ সহযোগে বলেছিলেন। বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহের চলন দেখিয়ে বলেছিলেন পৃথিবী সবকিছুর কেন্দ্রস্থলে অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে, এটা অসম্ভব। শুক্রের কলা দেখিয়ে বোঝালেন সে গ্রহও চলমান। শনির বলয় শনিকে ঘিরে ঘোরে এটাও দেখালেন। শুধু আইডিয়া নয়, টেলিস্কোপ বাগিয়ে দেখানো। একবার দেখানো নয়, বার বার দেখানো। ব‍্যস, ধর্মধ্বজীদের স্বার্থে বড়মাপের ঘা পড়ল। তারা বলল গ‍্যালিলিও ঈশ্বরের অপমান করেছেন। সেই ধুয়ো তুলে গ‍্যালিলিওর উপর তো কম অত‍্যাচার হয় নি। অমন যুগন্ধর প্রতিভা। ওঁকে হাঁটু গেড়ে বসে ক্ষমা চাইতে বলা হল। চাইতে হল। কেননা, বিজ্ঞান বিষয়ক আরো গবেষণা বাকি ছিল। মরে গেলেই তো ফুরিয়ে গেল না। ওরা মারলে কোনো ঈশ্বর তো বাঁচাতে আসবেন না। তাই গবেষণার স্বার্থে গ‍্যালিলিও ক্ষমা চেয়ে সে যাত্রা মিটিয়ে নিলেন। গ‍্যালিলিওর ক্ষমাভিক্ষা পত্রটা কেউ লিখে দিয়েছিল নিশ্চয়ই। শাসকের কাছে ক্ষমা চেয়েও তিনি বিড়বিড় করে বলেছিলেন, এপ্পার সাই মুভ। তবুও পৃথিবী ঘুরছে। ১৬৪২ সালের একেবারে গোড়ায়, জানুয়ারি মাসের আট তারিখে কারারুদ্ধ অবস্থায় মারা যান গ‍্যালিলিও। ঠিক ওই বছরেই ডিসেম্বরের পঁচিশ তারিখে জন্মাবেন আইজ‍্যাক নিউটন।
নিউটন সূর্যের আলো ভেঙে দেখিয়ে দিলেন তার ভিতরে সাতরঙা বর্ণালির ঐশ্বর্য। অপটিকস নামে বইও লিখেছেন। সেটা ১৭০৪ সাল। তখন নিউটনের বয়স বাষট্টি।
নিউটনের আসল কাজটা হল ল অফ মোশন। প্রিন্সিপিয়া।
ওই যে সূর্যের আলো ভেঙে দেখালেন নিউটন, সেখানে কাজে লাগিয়ে ছিলেন প্রিজম।  ১৯৮২ সালে ওই প্রিজম দিয়ে আলো প্রতিফলিত করে লেসার রশ্মি বানানো হয়েছে। আজও নিউটনের কাজ আমাদের আলো দেখায়। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে নিউটনের সবচেয়ে নামকরা বইটা প্রকাশ পেয়েছিল, প্রিন্সিপিয়া। পুরো নাম হল, ফিলজফিয়া ন‍্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম‍্যাথমেটিকা। বইটা ছেপে বের করতে টাকা যুগিয়েছেন এডমণ্ড হ‍্যালি। সেই হ্যালি, যিনি নিজের সময়ে ইউরেনাস গ্রহ আবিষ্কার করেছিলেন। নিউটন দেখিয়ে দিলেন, মাধ‍্যাকর্ষণের জন‍্যই সূর্যের চারিদিকে না ঘুরে পৃথিবী আর অন‍্য গ্রহগুলোর কোনো উপায় নেই। কোনো ভগবান গ্রহগুলোকে দম দিয়ে ছেড়ে দেননি। সবটুকু পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে তবেই হচ্ছে। আর ওই যে অ্যারিস্টটলের চিন্তা, টলেমির চিন্তা, সে সবের ত্রুটি সবাই বুঝে ফেলল। এই সমস্তটুকু এক মহান যুদ্ধের ফসল, যা প্রমাণ করে দিয়েছে সব ধর্মই মানবতার কঠিন শত্রু।
মাইক্রোসকোপে জীবকোশের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম গঠন লক্ষ্য করা বলুন আর দূরের কোনো গ্রহ দেখা বলুন, কাচের লেন্সের ভূমিকা আর তার সাথে আলোর চলার ধরন ধারনটা নজর করতেই হয়। ১৭০৪ সালে ‘অপটিকস’ নামে বই লিখে ফেললেন আইজ‍্যাক নিউটন ( ০৪.০১.১৬৪৩ – ৩১.০৩.১৭২৭)। বললেন আলোর কণাধর্মী অস্তিত্বের কথা। কিন্তু, ১৬৭৮ সালে ট্রাইট দে লা লুমিয়ের নামে বই লিখে আলোর তরঙ্গধর্মী অস্তিত্বের কথা বলেছিলেন নেদারল্যান্ডসের বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস ( ১৪.০৪.১৬২৯ – ০৮.০৭.১৬৯৫)।  নিউটনের কথাটা লোকজন বুঝতে পারল। কিন্তু হাইগেনস এর তত্ত্ব লোকে কানে নিল না। অনেক পরে সে তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে যে আলো আসলে তড়িৎ চৌম্বক তরঙ্গ। তার চরিত্রে কণাধর্ম আর তরঙ্গধর্ম একই সাথে রয়েছে।
আলো আর তার গতিবিধি নিয়ে বিজ্ঞানী মহল  নিউটনের অপটিকস লেখার অনেক দিন আগে থেকে গভীর ভাবে ভাবছিলেন। ১৬১০ সালে লেন্সের ফোকাস দূরত্ব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে বৈজ্ঞানিক টেলিস্কোপ বানিয়েছিলেন গ‍্যালিলিও। আর জার্মান জ‍্যোতির্বিজ্ঞানী জোহানস কেপলার ১৬১১ সালে লেন্স বিষয়ে খুঁটিনাটি নিয়ে ডায়োপট্রিসে নামে  বই লিখেছিলেন । এরপর দুই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মাধ‍্যমের ভিতর দিয়ে যেতে গেলে আলোর চলনপথের কী পরিবর্তন হয়, তা লক্ষ্য করলেন ডাচ জ‍্যোতির্বিজ্ঞানী উইলব্ররড স্নেল। ১৬৩৭ সালে ফরাসি গণিতবিদ দার্শনিক রেনে দেকার্তে লা ডাইঅপট্রিক নামে বই লিখে ফেললেন। ১৬৫৭ সালে গণিতবিজ্ঞানী পিয়ের দ‍্য ফার্মা বললেন একটি বিন্দু থেকে আলো আরেকটি বিন্দুতে পৌঁছাতে সেই পথেই চলে, যে পথে সময় লাগবে সবচেয়ে কম। ১৬৬৫ সালে ফ্রানসেসকো গ্রিমালডি দেখালেন যে, কোনো বাধাকে টপকে যাবার সময় যেখানে বাধাদানকারী বস্তুর ছায়া পড়ার কথা, সেই জ‍্যামিতিক এলাকার ভিতরেও আলো টুকি দেয়। ১৬৭৬ সালে ডেনমার্কের জ‍্যোতির্বিজ্ঞানী ওলে রোমার আলোর গতিবেগ কষার চেষ্টা করলেন। এইসবের ভিত্তির উপর এল নিউটনের গবেষণা। পৃথিবীর কোনো গবেষণাই শিকড়হীন স্বয়ম্ভূ নয়। পূর্বজের কৃতির সূত্রে অনুজের অনুসন্ধানের ফসল।
কোপার্নিকাস ব্রুণো আর গ‍্যালিলিওর ধারাবাহিক যুদ্ধটা যেন আত্মস্থ করে নিয়ে জার্মান নাট‍্যকার বারটোল্ট ব্রেখট তাঁর লাইফ অফ গ‍্যালিলিও নাটকে বিজ্ঞান জিনিসটা কেন, বিজ্ঞানের লক্ষ্য কি, এই প্রসঙ্গে বলছেন, অসীম প্রজ্ঞার দ্বারোদ্ঘাটন করাটা আদৌ বিজ্ঞানের লক্ষ্য নয়। বিজ্ঞানের লক্ষ্য হল, আমাদের মধ‍্যে যে অসীম ত্রুটি বিচ‍্যুতি ভুলভ্রান্তি আছে, তাতে একটু লাগাম পরানো। ১৯৪৩ সালে লেখা এই নাটক। তখন ব্রেখট পঁয়তাল্লিশ বছরের জ্ঞানতাপস। গভীর মন্ময়তায় মহাবিজ্ঞানী গ‍্যালিলিওর জীবন সন্দর্শন করেছেন। তাঁর প্রতি রাষ্ট্রযন্ত্র ও ধর্মতন্ত্রের আক্রমণটা খুঁটিয়ে দেখছেন। আর ঐতিহাসিক ঘটনার পরতে পরতে বুনে নিচ্ছেন সমকালীন যন্ত্রণার ছবিটি।
ওই গ‍্যালিলিও নাটকে আরো বলছেন, সেই দেশ বড়ই দুঃখী, যাদের বীর খুঁজে খুঁজে বের করতে হয়। মহৎ সত‍্যদ্রষ্টা গ‍্যালিলিওকে স্মরণ করতে করতে ব্রেখট ওই নাটকে বলছেন, আজকের দিনে যিনি মিথ‍্যার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাইবেন, অজ্ঞতার বিপ্রতীপে তরবারি ধরবেন, যিনি নিজের কলমে সত‍্যপ্রতিষ্ঠা করতে চাইবেন, তাঁকে অন্ততপক্ষে পাঁচটি বাধা জয় করতে হবে। প্রথমতঃ, যে সময় সব জায়গায় সত‍্যকে বিরুদ্ধতার মুখে পড়তে হচ্ছে, সেই সময় তাঁকে নিজের কলমে সত‍্য লিখতে হবে। যে সময়ে সত‍্যকে ঢেকে চেপে রাখতে সবাই ব‍্যস্ত, সেইরকম সময়ে  সত‍্যকে খুঁজে বের করতে তাঁর অকুণ্ঠ আগ্রহ থাকতে হবে।
সত‍্যকে একটা হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলবার এলেম তাঁর থাকতে হবে, আর কাদের হাতে সত‍্য পৌঁছে দিতে পারলে তা সবচাইতে কার্যকর হবে, এটা বোঝার মতো বিচারবোধ তাঁর থাকতে হবে। আর সেই সব মানুষের কাছে সত‍্যের আলো পৌঁছে দিতে গিয়ে তাঁকে দৌড়ে বেড়াতে হবে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।