দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২২৭)

পর্ব – ২২৭

শশাঙ্ক স্ত্রীকে বললেন, এবার ওঠো। বাড়ি চলো।
বাসন্তীবালা ঝাঁজিয়ে উঠলেন। বাড়ি চলো তো বলছ। কে করবে বলো তো অতো কাজ? লোক রাখলাম তো তাকে কে টিপে দিল, যেও নি পালবাড়ি। বয়স্ক বিধবা মেয়েলোকটাও টিঁকতে পারেনি। সে কথা ভাবো?
শশাঙ্ক বললেন, সে কথা কি এখানেই বসে ভাবতে হবে? চলো, বাড়ি গিয়ে দুজনে মিলে ভাবব।
বাসন্তীবালা বললেন, হ‍্যাঁ, শুধু ভাবলেই হয় না। গতর নাড়াতে হয়। আজ দুপুরে ছোটখোকার জামাকাপড় কাচতে পারিনি বলে রাগ দেখিয়েছে। আমিও বলে দিয়েছি, বুড়ি মাকে হুকুম করতে লজ্জা করে না তোর? রাঁধব, কুটনো কুটব, এঁটো বাসন মাজব, ঘরদোর ঝাঁটপাট দেব, তার ওপর তোদের মতো দুটো জানোয়ারের কাপড় কাচব, কি পেয়েছিস আমাকে?
শ‍্যামলী মায়ের কথা শুনে অস্বস্তিবোধ করে অন‍্য ঘরে চলে যায়। বলে, মা, আমি পড়তে বসছি। চলে যাবার আগে আমায় ডেকো।
 গলার স্বর খাদে নামিয়ে বাসন্তীবালা বলেন, ওমা, এতক্ষণ ধরে মাটি কামড়ে হত‍্যে দিয়ে পড়ে আছি, সে কি তোকে রেখে যাবার জন্যে? বাড়ি চ। সংসারে থাকলে থাল বাসনে ঠুকঠাক হতেই থাকে। সে সব অত মনে রাখতে নেই।
ঘরের ভিতর থেকে শ‍্যামলী বলল, মা, আমার সামনে পরীক্ষা। কারখানা আর এটাসেটা করে পড়ায় অনেক পিছিয়ে আছি। আমাকে এখন আর কিছু বোলো না।
অনসূয়া অস্বস্তিবোধ করতে থাকেন। বলেন, আমার কাল কোর্টে জরুরি মামলা আছে। তাহলে আপনারা বসুন। আমি নিজের ঘরে যা‌ই।
বাসন্তীবালা অনসূয়াকে তেড়ে উঠে বললেন, তোমার এখানে বসে থাকব বলে আমি আসি নি। আমি এসেছি আমার মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে যাব বলে। তুমি মা তো হ‌ওনি, হলে বুঝতে, মায়ের প্রাণে কোথায় ব‍্যথা লাগে।
অনসূয়া বললেন, চাটুজ‍্যেবাড়ি অতিথিকে নারায়ণ বলে সম্মান করে। আমার সেই সম্মান দেখানোটাকে যদি আপনি দুর্বলতা ভাবেন, তাহলে ভুল করবেন। আমি আপনাদের সম্মান করেছি। আমি কিন্তু বিনিময়ে ভদ্র ব‍্যবহারের আশা করি।
শশাঙ্ক স্ত্রীকে বললেন, তুমি কি উঠবে? যদি না ওঠো, তাহলে আমি একাই চলে যাচ্ছি।
বাসন্তীবালা অনসূয়াকে বললেন, আমি রাগের মাথায় কি বলে ফেলেছি, নিজেই বুঝিনি। ভেতরটা খুব অস্থৈ হয়ে আছে। আশেপাশের বাড়ির লোকজন যখন জানতে চাইবে, কি গো তোমাদের সোমত্ত মেয়েটা গেল কোথায়, কি জবাব আমি দেব আমায় বলে দাও। আমি চলে যাচ্ছি।
অনসূয়া বললেন, আপনি রাগ করবেন হয় তো, আমার কিন্তু কাল সত‍্যি সত‍্যি সিরিয়াস মামলা আছে। আমাকে তৈরি হতে হবে। আপনার যা ইচ্ছে হয় আপনি করতে পারেন, আমি বিদায় নিচ্ছি। বলে আলগোছে বুকের কাছে হাত জোড় করে অনসূয়া চলে গেলেন।
ঘর থেকে শ‍্যামলী বেরিয়ে এসে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, মা, লোকজন যদি কিছু জিজ্ঞাসা করে, তো যা সত‍্যি বলে জানো, সেটাই বলবে। কোনো কিছু বানিয়ে বা ঢাকা চাপা দিয়ে বলতে যেও না। মিথ্যে কথা চাপা থাকে না।
শশাঙ্ক পাল স্ত্রীকে ধমক দিলেন। তুমি অশান্তি পাকাবে জানলে তোমাকে আমি নিয়েই আসতাম না। এই বাড়ির সাথে আমার অনেক দিনের খাতির। সেটা নষ্ট করতে আমি দেব না।
নিচুস্বরে তিনি মেয়েকে বললেন, ছোটমণি, তোর অনসূয়াদিকে বুঝিয়ে বলিস, তোর মায়ের ওপর রাগ না করে। আমরা চললাম।
ঘরের ভিতর থেকে অনসূয়া সহায়িকাকে বললেন, গোবিন্দকে বলো, ওঁদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসুক। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বয়স্ক মানুষ। কষ্ট পাবেন।
শ‍্যামলী বাবাকে প্রণাম করে বলল, বাবা, ওষুধ ঠিকমতো খেও। চেক আপ করাতে যেও। হতাশা ছড়িয়ে পড়ল শশাঙ্কের মুখে। সব কিছু দিয়ে ফেলে আমি এখন একটা বাড়তি মানুষ। কাল যদি ঘাড় ধরে ছোটখোকা বলে, অ্যাই বুড়ো, তুই সিঁড়ির তলায় গিয়ে থাক্, তো তাই থাকতে হবে। আমার আবার ওষুধ, চেক আপ!
বাসন্তীবালা চোখে আঁচল চাপা দিলেন। অনসূয়া বেরিয়ে এসে বললেন, শ‍্যামলী আপনাদের খবর রাখবে। মাসকাবারি ওষুধ পৌঁছে যাবে। তারপর  অনসূয়া শ‍্যামলীকে বললেন, যা তুই এবার নিশ্চিন্তে পড়তে বোস্।
 শশাঙ্ক পাল সস্ত্রীক বিদায় নিলে শ‍্যামলী পড়তে বসল। খানিক বাদে একটা বাটি করে সুজির মোহনভোগ এনে দিল সহায়িকা। শ‍্যামলী বলল, দিদিকে দিয়েছ?
সহায়িকা বলল, ওঁকে এইসময়   কালো কফি আর একপিস টোস্ট রুটি দেব। এখন সুজি খেতে চাইবেন না।
অঙ্কের মধ‍্যে ডুবে গেল শ‍্যামলী। এমন সময় একটা ফোন আসতে অনসূয়া রিসিভ করলেন। তারপর শ‍্যামলীর কাছে এসে বললেন, অরিন্দম আসছে। রাতে এখানে ডিনার করতে বলেছি।
তারপর বললেন, হ‍্যাঁ রে, তুই হোস্টেলের ঘরটা দেখে এসেছিস?
শ‍্যামলী বলল, না দিদি, কি করে কি হল, আমি তো বুঝতে পারছি না। যে প্রিন্সিপাল সর্বদা আমার দোষ দেখতেন, তিনি আমাকে ক্লাস থেকে ডাকিয়ে এনে হোস্টেলে সিট আর খাবারের খরচ যুগিয়ে দেবেন, আমি ভাবতেই পারছি না। আন্দাজ করেছি আপনি কিছু বলে দিয়েছেন। ম‍্যাম বলছিলেন, যে রেফারেন্স নিয়ে এসেছ তুমি! নিশ্চয়ই আপনার কথা বলছিলেন তিনি!
অনসূয়া বললেন, তুই কলেজ গেলে আমরা দুজনে মিলে ভাবলাম, কি করে হোস্টেলে রুম পাওয়া যায়। অরিন্দমের জ‍্যাঠামশায় কলেজের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। আমার বাবাও ছিলেন। আমি আর ওসব ঝক্কি রাখিনি। অরিন্দমকে ওরা মেম্বার করে নিয়েছে। অরিন্দম আমাকে বলল, তুই প্রিন্সিপালকে বল, শ‍্যামলীর জন্য রুম লাগবে।
শ‍্যামলী অবাক হয়ে শুনতে থাকে।
তারপর বলে, দিদি, সরোজনলিনী ফাণ্ডটা কি?
অনসূয়া বললেন, ওই আমাদের এক পিসিঠাকুরমা ছিলেন। ওঁরা ছিলেন জমিদার। বিয়েও হয়েছিল জমিদার বাড়িতে। ১৯৫৪ সালে জমিদারি উঠে যেতে অনেক টাকা কমপেনসেশন পেয়েছিলেন। ওঁর স্বামী মারা যেতে কলকাতার বাড়িগুলো বেচে টাকা করে নিয়েছিলেন। তারপর উনি বলেছিলেন পড়াশুনায় ভাল মেয়েরা যাতে উৎসাহ পায়, ওইটাকায় তেমন কাজ করতে হবে। তো সরোজনলিনী ফাণ্ডের যে শর্ত ছিল, তা অনেক মেয়েই পারে না।
কি শর্ত?
মাধ‍্যমিক থেকে একটানা পড়াশুনা করে যেতে হবে। ড্রপ দিলে চলবে না। মাধ‍্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক দুটোতেই ফার্স্ট ডিভিসন থাকতে হবে। আর বিয়ে হয়ে গেলে পাবে না। আর দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হতে হবে। তো এই টাকা দিনের পর দিন কলেজ খরচা করে নি। ফিক্সড ডিপোজিট রিনিউও করে নি। অরিন্দম প্রিন্সিপালকে ফোন করে বলেছিল, শ‍্যামলীর জন‍্য সরোজনলিনী ফাণ্ড ব‍্যবহার করুন। উনি গাঁইগুঁই করতে আমাকে আসরে নামতে হল।
শ‍্যামলী বলল, তার মানে আমি আপনাদের অনুগ্রহ নিয়ে বাঁচছি।
মুহূর্তে দপ্ করে জ্বলে উঠলেন অনসূয়া। কি বলছিস কি তুই! একটা বুড়ি, নিজের জীবনে পড়াশুনা করতে না পেয়ে স্বামীর টাকায় গুরুদেবের আশ্রম, মন্দির এসব কিছুতে না জড়িয়ে দেশের মেয়েদের উন্নতি চেয়ে গেল। এটাকে তুই ছোট করে দেখিস না। একটা বোমা টপকে দেওয়া বা দুটো পুলিশ খুন করার চাইতে এর মূল‍্য অনেক বেশি।
এমন সময় ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কে বলল, ভেতরে আসতে পারি?

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।