• Uncategorized
  • 0

|| ভাষাতে বাংলা, ভাসাতে বাংলা || সংখ্যায় মৃদুল শ্রীমানী

দেহি পদপল্লব মুদারম্

(মাতৃভাষার বন্দনা গাথা)

আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। যেখানে যেটি যাঁর মাতৃভাষা, আজ সেটির স্মরণদিবস। মুশকিল হল, পৃথিবীটা ভারি পরিবর্তনশীল। শাসকেরা এটা বুঝতে চায় না। আর স্তাবকেরাও এটা বুঝতে পারে না। কিন্তু যাঁরই একটু অন্তর্দৃষ্টি আছে, গভীর ভাবে ভাবার মানসিক সামর্থ্য আছে, তিনিই জানেন, পরিবর্তন অবশ‍্যম্ভাবী। পরিবর্তনই জগৎ জীবনের চালিকাশক্তি। সেই নিয়ম ভাষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ভাষাও গড়ে ওঠে, সে ভোল বদলায়, বদলাতে বদলাতে এমন চেহারা নেয়, তখন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মত যুগন্ধর ভাষাবিজ্ঞানী ছাড়া তার আসল চেহারা বের করে দেখায় কার সাধ‍্য!
তো ভাষা গড়ে ওঠে, এক ভাষার সাথে অন‍্য ভাষা মেলে মেশে, ভাষা বদলায়, আর ভাষা একদিন পালটাতে পালটাতে সম্পূর্ণ অন‍্য চেহারা নেয়। যে ভাষায় মানুষ কথা বলে, স্থানভেদে সেই ভাষার মধ‍্যে উপভাষা থাকে। ভাষাবিজ্ঞানী তাকে স্বীকার করেন। শব্দের উচ্চারণ, শব্দের অর্থ, শব্দের ব‍্যঞ্জনা, বাচ‍্যার্থ ব‍্যঙ্গ‍্যার্থ, সব ভৌগোলিক বৈচিত্র্যকে নতমস্তকে স্বীকার করে বহুরূপে প্রকাশিত হয়।
তাই একই বাংলা ভাষার চট্টগ্রামের উপভাষা শুনে কলকাতার বাঙালি সহজে বুঝতে পারে না। এক অখণ্ড বাংলাদেশে শ্রীহট্টে, রঙপুরে, ময়মনসিংহে, ঢাকায়, যশোর, নোয়াখালি, পাবনায় কতো বাগবৈচিত্র‍্য। কুচবিহার, ইসলামপুর, বালুরঘাট, সিউড়ি, আসানসোল, রাণাঘাট, মানভূম, তমলুক, ক‍্যানিঙের মৌখিক বাংলায় সুপ্রচুর প্রভেদ লক্ষ্য করা যায়। এক হুগলি জেলার আরামবাগে যে বাংলা শুনেছি, তার চন্দননগরে সে ভাষা যায় বদলে। বিভিন্ন পেশার মানুষ নিজের নিজের পেশাগত জীবনযাত্রার ছাপ ফেলে ভাষায়। শাসকের ভাষাকে আত্মস্থ করার তীব্র চেষ্টা চলে। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র বঙ্গের মুসলমান শাসকের ভাষাকে তদানীন্তন এলিট সমাজের কাছে সাদরে গ্রহণযোগ্য হতে দেখে লিখেছেন: অতএব লিখি ভাষা যাবনী মিশাল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতায় নব‍্যবঙ্গীয় যুবক অমিত রায় আপন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে অমিট্রায়ে। তার বোন সিসি, লিসি, বন্ধু কেটি, যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক বাঙালিয়ানা ভুলে বিজাতীয় সাজতে চেয়েছে। গোরা উপন্যাসের ভদ্র শিক্ষিত বিত্তশালী পরিবারের মেয়েরা ইংরেজ কবি মূর এর কবিতার অনুলিপি প্রস্তুত করে তীব্র আত্মপ্রসাদ লাভ করেছে। ভদ্র মার্জিত অতিথি এলে তাদের বালিকা কন‍্যা হড়বড় করে না বুঝে ইংরেজি রাইম আউড়ে গিয়েছে। বিদেশি শাসকের প্রতিভূ ম‍্যাজিস্ট্রেটের তুষ্টিসাধন করতে ইংরেজিতে নাটক করেছে। ভদ্র বাঙালির ছেলের সবচাইতে মানহানি হয় ইংরেজি জানে না বলে দুয়ো দিলে।
জসীম উদ্দীন, বন্দেআলি মিঞা, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সহজ স্বাভাবিক বাংলা ভাষায় অসাধারণ সব কবিতা লিখলেও আগ্রাসী হিন্দু সাম্প্রদায়িক দাপটের কাছে কোণঠাসা হয়ে স্বল্প শিক্ষিত মুসলমান জোর করে আরবি ফারসি ভাষার শব্দ ব‍্যবহার করে আইডেনটিটি পলিটিকসে সামিল হয়েছে। গড়ে তুলতে চেয়েছে ইসলামী বা এছলামী বাংলা।
কবিতায় আরবি ফারসি শব্দ কাজী নজরুল ইসলাম কম ব‍্যবহার করেন নি। ঐশ্লামিক পুরাণকথা কম টেনে আনেন নি। কিন্তু তিনি ছিলেন প্রকৃত কবি। সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি দেবার কোনো বরাত তাঁকে দেওয়া ছিল না। তিনি অন্তরের আকুতিতে যা লিখেছেন, তা বাংলা ভাষার মূল‍্যবান সম্পদ হয়ে উঠেছে। আর অল্পশিক্ষিতের আইডেনটিটি পলিটিকস নিজের দুর্বুদ্ধিতে ভাষাকে করে তুলেছে জঞ্জাল।
কলকাতায় দেখেছি পূর্ববঙ্গ থেকে আগত ভদ্রলোক বাঙালি, যাঁরা দেশভাগ আঁচ করে আগেভাগেই ওপার বাংলার পারিবারিক জমিজায়গার বিলি বন্দোবস্ত করে, এপারে এসে চাকরি জুটিয়ে স্থিতু হয়েছেন, তাঁরা বাড়ির বাইরে একধরনের বাংলা উপভাষায় কথা বলেছেন, আর ঘরে ফিরে পোশাক বদলাতে বদলাতে নিজেকে ঢুকিয়ে ফেলেছেন আজন্মের ভাষিক অভ‍্যাসে।
রাজবংশী, যাকে কোনোভাবেই বাংলা ভাষার একটি উজ্জ্বল উপভাষা ছাড়া আর কোনো কিছুই ভাবতে পারিনি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি সেই উপভাষায় অনুবাদ করে আত্মপ্রসাদ লভেছেন কেউ কেউ। কুড়মালি ভাষায় রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনেছি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে। ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে। সমস্যা হল, অনেক উপভাষার মধ‍্যে যেটি সবচেয়ে সুপুষ্ট ও সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে, সেটিই প্রাধান্য লাভ করে। তার শব্দসম্পদ, তার গভীরতা এত বিপুল হয়ে ওঠে যে, সেই হয়ে ওঠে আলোচ‍্য ভাষার মুখ‍্য চেহারা। স্বচ্ছ সলিলা বহতা নদীতে অবগাহন স্নান করে কেউই পল্লীগ্রামের পঙ্কশেষ পুকুরে ডুব দিতে যায় না। সেটা আঞ্চলিক স্বার্থের বিরোধিতা নয়, সেটা বুদ্ধির সহজ স্বাভাবিকতা।
ভারতীয় পলিটিকসে ভাষার ভিত্তিতে রাজ‍্যগঠন ও রক্তপাত ও নিজদেহে অগ্নিসংযোগ করার মতো ঘটনাক্রম, ও বিনিময়ে রাজনৈতিক ক্ষমতালাভ লক্ষ্য করে কেউ কেউ উপভাষাকে জোর করে ভাষা বলে চালাতে চেয়েছেন। ভিতরে ঢুকে আছে রাজ‍্য হাসিল করে মন্ত্রী অমাত‍্য পাত্র মিত্র হবার গদগদে আগ্রহ। এই হল আইডেনটিটি পলিটিকস। এই ধারায় একদিন মহকুমায় মহকুমায় আলাদা আলাদা রাজ‍্যের দাবি না ওঠে!
কর্মক্ষেত্রে দেখেছি ওঁরাও ছেলেটি নিজের ভাষায় কথা বলতে চায় না। গ্রামীণ মুসলিম ছেলেটি ঘরে ঠিক কিভাবে কথা বলে, জানতে চাইলে সংকীর্ণ হয়ে ওঠে। নিজের মুখের ভাষা নিয়ে তারা মরমে মরে আছে। কিন্তু মরমে মরে থেকে তো কোনো গঠনমূলক কাজ হয় না। ঘরে দরজা জানালা লাগায় বুদ্ধিমান লোকে। তারা জানে সুস্থ থাকতে আলো বাতাসের স্বচ্ছল স্বচ্ছন্দ চলাচল প্রয়োজন। ভিতু লোকেরা চোর ডাকাতের ভয়ে জানালার বালাই দিয়েছে ঘুচিয়ে। দরজা করেছে বিশেষ করে সংকীর্ণ। দ্বার বন্ধ করে যে মানুষ ভ্রম রুখতে চেয়েছে, সে সত‍্যবস্তু অর্জন করতে পারে নি। ডুবে যাবার ভয়ে যে হাঁটু জলের বেশি নামতে চায় নি, অবগাহন স্নানের আনন্দ থেকে নিজেকে সে বঞ্চিত করেছে।
গৌতম বুদ্ধ পালি ভাষায় কথা বলতেন। যিশু আরামাইক ভাষায় কথা বলতেন। সে সব ভাষা আজ আর প্রধান ভাষার তালিকায় নেই। শ্রীরামকৃষ্ণ যে ধরনের শব্দচয়নে, শব্দবয়নে কথা কইতেন, রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমিক সাধুরা ঠিক সেই দৃষ্টান্ত পালন করেন না। মহামানবদের জীবনযাপনে একটা আশ্চর্য জোর থাকে। মোজেস একটি পাথর নিয়ে দাঁড়ালেন। অলৌকিক ভাবে তাতে লেখা হয়ে উঠল টেন কম‍্যাণ্ডমেন্টস। কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে শ্রীভগবান ভারতকে উপদেশ দিলেন। কী ভাষায় দিলেন কে জানে! শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় তা সংস্কৃতভাষায় দেখি। তারই কর্মেণ‍্যবাধিকরস্তে কণ্ঠে নিয়ে বালক কিশোর স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ দিতে ভয় পায়নি। হেরা গুহায় বসে হজরত মহম্মদ কোরানের বার্তা পেয়েছেন। ক্রৌঞ্চ মিথুনের একটির অপঘাত মৃত‍্যুতে শোকে উদ্বেল হয়ে বাল্মীকি রত্নাকর নিষাদকে তীব্র ধিক্কার দিয়ে অনুষ্টুভ্ ছন্দে বলে উঠেছেন, মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগম শাশ্বতীসমাঃ। যৎক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমধি কামমোহিতম্।। বলেই রত্নাকর হতবুদ্ধি। এসব কী বলছেন তিনি! দেবী সরস্বতী স্বয়ং আবির্ভূতা হয়ে বললেন, এই হল শ্লোক। এ তোমার শোক থেকে উৎসারিত। তুমি কবি। এবার তুমি রামায়ণীকথা লেখো। সরস্বতী এসব কোন্ ভাষায় বললেন, কে জানে!
চৈতন‍্যদেব নিজের ভাষায় তেমন কিছুই না লিখে, শুধুমাত্র নিজের পাবনী জীবনযাত্রার মাধ‍্যমে একটা ভাষা সংস্কৃতির অভিমুখ বদলে দিলেন। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন এর ভাষারুচির সাথে জ্ঞানদাস গোবিন্দদাসের পদের ভাষা, মননের পার্থক্য অগাধ। চৈতন‍্যপার্ষদ ব‍্যক্তিত্বগণ নতুন করে সংস্কৃতভাষা চর্চা করলেন। রূপ, সনাতন প্রমুখ ষড়গোস্বামী নিজেদের মনীষার জোরে সংস্কৃত ভাষার সহযোগে বাংলা ভাষার একটি নবজাগরণ সম্পন্ন করেন। অথচ সংস্কৃত ছিল একটি কৃত্রিম ভাষা। মূলে যা ছিল বৈদিক বা ছান্দস, তাই লোকমুখে বহু ব‍্যবহারে অমোঘ ভাবে পরিবর্তিত হয়ে চলেছিল। জন্ম নিয়েছিল প্রাকৃত ভাষা। সংস্কৃত নাটকে মাহারাষ্ট্রী প্রাকৃত ভাষায় কথা বলতেন রাজসভার সাথে যুক্ত গুরুত্বপূর্ণ ব‍্যক্তিত্ববর্গ। রাজা বা মুনি ঋষিরা হয়তো সংস্কৃতেই বাক‍্যালাপ করতেন। রাজবধূ রাজবালা রাজনন্দিনীরা শৌরসেনী প্রাকৃতে কথা বলতেন। রবিঠাকুরের কবিতায়, কইত কথা শৌরসেনী, হলা পিয় সহি। সংস্কৃত নাটকের ইতর চরিত্রগুলি মাগধী প্রাকৃতে কথা বলত।
ভাষার যে বদল ছিল স্বাভাবিক, যা বৈদিক বা ছান্দস থেকে প্রাকৃত হয়ে অপভ্রংশ, অপভ্রষ্ট, অবিহটঠ হয়ে নব‍্য ভারতীয় ভাষার জন্ম দেবে, ভাষানদীর সেই পরিবর্তনকে বাঁধতে চেষ্টা করলেন যাজ্ঞবল্ক‍্য, পাণিনি প্রমুখ। ওঁদের বিপুল চেষ্টায় কৃত্রিম ভাষা সংস্কৃত তৈরি হয়। ওঁদের মেধা ও মনীষার কিছুমাত্র ঘাটতি ছিল না। যেটুকু ঘাটতি ছিল, তা হল বাস্তববোধের। ভাষা বদলাবেই। বদলই জগৎজীবনের সবচেয়ে সত‍্যবস্তু। তাকে এড়ানো অসম্ভব। অবান্তর। সাবধানীরা বাঁধ বাঁধে সব, আমরা ভাঙি কূল। প্রাচীন সংস্কৃতের সঙ্গে অর্বাচীন সংস্কৃতের রুচি ও গঠনের মৌলিক পার্থক্য স্বামী বিবেকানন্দের চোখ এড়িয়ে যায় নি।
আগেই বলেছি যিশু আরামাইক ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু মধ‍্যযুগের ইউরোপে ল‍্যাটিন হয়ে উঠল পণ্ডিত সমাজের ভাষা। কোপার্নিকাসের অরবিয়াম, নিউটনের প্রিন্সিপিয়া, সব ল‍্যাটিন ভাষায়। ১৬৮৭সালের জুলাই মাসে নিউটন তাঁর প্রিন্সিপিয়া প্রকাশ করেছিলেন। কোপার্নিকাস এর অরবিয়াম বেরিয়েছিল ১৫৪৩ সালে।
কিন্তু জন্মসূত্রে জার্মান, বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে তাঁর সেরা প্রবন্ধগুলি জার্মান ভাষার বিজ্ঞান পত্রিকা অ্যানালেন ডার ফিজিক এ প্রকাশ করালেন। নাৎসি শয়তানদের উপদ্রবে আইনস্টাইন দেশছাড়া হয়ে আমেরিকায় বসবাস করার আগে অবধি ইংরেজি ভাষায় লেখেননি। জার্মান ভাষায় প্রকাশিত আইনস্টাইনের মূল গবেষণাপত্র পাঠ করে আত্মস্থ করবেন, এই আশায় বাঙালি বিজ্ঞানী সত‍্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহা জার্মান ভাষা আয়ত্ত করেছেন। তারপর আইনস্টাইনের লেখা ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেছেন। একটি সদ‍্যোতরুণীকে জানি বায়োটেকনোলজি নিয়ে অনেকখানি পড়বেন বলে নিজেকে নিজে ফরাসি ভাষা শেখাচ্ছেন।
সেকালের বাংলায় পণ্ডিত ব‍্যক্তিদের কাছে বাংলা ভাষার খুব আদর ছিল না। তাঁদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা বা পছন্দের ভাষা ছিল সংস্কৃত। চোখ বুজলেই শুনতে পাই বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা উপন‍্যাসে পথভ্রষ্ট দিগভ্রষ্ট নবকুমারকে কাপালিক বলছে, মামনুসর। অস‍্যার্থ, আমাকে অনুসরণ করো। এই কপালকুণ্ডলা উপন‍্যাসেই আমার প্রথম সংস্কৃত সাহিত‍্য আস্বাদন, দূরাদয়শ্চক্রনিভস‍্যতন্বীতমালতালবনরাজিনীলা আভাতিবেলালবণাম্বুরাশের্ধারানিবদ্ধেব কলঙ্করেখা।
আমাদের জাতীয় সঙ্গীত বন্দে মাতরম আমার কণ্ঠস্থ। সে গানে সংস্কৃত পদঝঙ্কার সাহিত‍্যিক নান্দনিক সংস্কৃত ভাষায় বঙ্কিমচন্দ্রের অপূর্ব অধিকারের পরিচায়ক। আজ যে গান জাতীয় গাথা হিসেবে পছন্দ করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছেন, সেই জনগণ‌মনঅধিনায়ক গানেও সংস্কৃত পদঝঙ্কার লক্ষ‍্যণীয়। ১৩১৮ বঙ্গাব্দে রচিত পাঁচটি স্তবকসম্পন্ন গানটির রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রদত্ত নাম ভারতবিধাতা। এর শুধুমাত্র প্রথম স্তবকটি জাতীয় গাথা বা ন‍্যাশনাল অ্যানথেম হিসেবে মান‍্য। গানটির এই অংশ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাহান্ন সেকেন্ড সময়সীমা মেনে গাইতে হয়। বাকি চারটি স্তবকও গভীর সম্মানে পড়ে দেখেছি সংস্কৃত পদঝঙ্কার ওই গাথার অন‍্যতম বৈশিষ্ট্য। ওই শব্দসম্পদ না থাকলে, প্রাকৃত মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নিত‍্যব‍্যবহার্য শব্দ দিয়ে তৈরি করা হলে সে রকম গান ওই অসামান্য উচ্চতা ও গ্রহণযোগ্যতা পেত না। কাশ্মীর থেকে কন‍্যাকুমারী ঘুরে দেখেছি, সংস্কৃতিবান লোকে এই গাথাটিকে যথার্থ শ্রদ্ধা করেন।
চৈতন‍্য ভাবান্দোলনের সূত্রে সংস্কৃত ভাষার চর্চা বাংলাকে পরিপুষ্ট করেছে। তদ্ভব ও দেশি এবং অনার্য উৎস থেকে প্রাপ্ত শব্দের বিপরীতে সংস্কৃত ভাষাচর্চা বাংলাকে একটা সবল কাঠামো, একটা ধীরোদাত্ত মেজাজ দিয়েছে। সংস্কৃত পাঠে অধিকার ছিল বলেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগর সীতার বনবাস ও শকুন্তলা লিখতে পেরেছেন। পাশাপাশি তাঁর বাস্তব চেতনা তাঁকে হিন্দি উৎস বৈতাল পচ্চিসী বাংলাভূমির সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে উদ্বুদ্ধ করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ না পাওয়া সেদিনের মেয়েদের কাছে বিদ‍্যাসাগর মহাশয়ের বেতাল সহজবোধ‍্য হয়েছিল। বাঙালি পাঠক কানে জয়দেবের গীত গোবিন্দের মধুর স্বর শুনে সংস্কৃত কবিতাকে বাংলা ভেবে নিয়েছে। মৈথিল কোকিল বিদ‍্যাপতিকে পরমাত্মীয় ভেবেছে। ব্রজবুলি, যা সম্পূর্ণ ভাবে কৃত্রিম সাহিত‍্যিক ভাষা, তাতে পদ লিখেছে। কিশোর কালে ভানুসিংহ নাম নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন মরণ রে, তুঁহু মম শ‍্যামসমান।
জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির বড়কর্তা দেবেন ঠাকুর পঞ্জাবে গিয়েছিলেন। সেখানে উপনিষদের মন্ত্র তাঁকে জীবনের একটি দিগন্ত উন্মোচন করে। ঈশাবাস‍্যমিদং সর্ব যৎকিঞ্চ জগত‍্যাং জগৎ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিলাসী উদ‍্যমী শিল্পোদ‍্যোগী দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র থেকে মহর্ষি পরিচয়ে উত্তীর্ণ করে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংস্কৃতপাঠে পিতার ভূমিকা বড় কম ছিল না।
অথচ মধ‍্যবয়সে রবীন্দ্রনাথ অনুভব করলেন তাঁর লেখা ইংরেজি ভাষার পথ ধরে বৈশ্বিক পাঠকের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। সে অনুভব ভ্রান্তিপূর্ণ ছিল না। সঙ অফারিংস যে শুধুমাত্র গীতাঞ্জলির অনুবাদ নয়, তা রবীন্দ্রমনস্ক পাঠক জানেন। গীতাখ‍্য কাব‍্যগ্রন্থগুলি তো বটেই, খেয়া নৈবেদ্য থেকেও সঙ অফারিংস এর কবিতা চয়ন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। গীতাঞ্জলি ছাড়াও গীতিমাল‍্য, নৈবেদ্য, খেয়া, শিশু, স্মরণ, কল্পনা, চৈতালি, উৎসর্গ, এই কাব‍্যগ্রন্থ ও অচলায়তন নাটক, সব মিলিয়ে দশটি উৎস থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সযত্ন চয়নের স্বকৃত অনুবাদ হল সঙ অফারিংস।
সঙ অফারিংস নোবেল সম্মান পাওয়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখালেখি আন্তর্জাতিক মহলে পৌঁছে গেল। জার্মান, স্প‍্যানিশ, ফরাসি ভাষার পাঠকের কাছে রবীন্দ্র সাহিত্য পৌঁছে যেতে সুবিধা হল।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় বিদেশী ফুলের কথা বলেছেন। সেই বিদেশী ফুলের একজন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। ওকাম্পো ১৮৯০ সালে জন্মানো মেয়ে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ে তাঁর বয়স চৌত্রিশ। বাইশ বছর বয়সে মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল, সেটা ১৯১২ সাল, কিন্তু স্বামীর প্রাচীনপন্থী রুচির সাথে তাঁর মেলবন্ধন হয় নি। মধুচন্দ্রিমার সময়েই তাঁদের দাম্পত্যে বেসুর বাজে। এক সম্পর্কিত দেবরের সাথে ভিক্টোরিয়ার অনুরাগের পালা শুরু হয়। গোপন সম্পর্ক চলতে থাকে। অসুখী বিবাহ ও গোপন প্রেমের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত ভিক্টোরিয়ার কাছে এসে পৌঁছায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি, আঁদ্রে জিদ এর ফরাসি অনুবাদে। সেটা ১৯১৪। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কবি। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। সে মেয়ের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার পর রবীন্দ্রনাথ তার নাম দিলেন বিজয়া। রবিঠাকুরের সৃষ্টি ইংরেজি ভাষার হাত ধরে বহুধাবিস্তৃত জগতে না পৌঁছলে এই অসামান্য সম্পর্ক গড়ে উঠত না।
বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত‍্যসম্ভারও তাঁর জীবৎকালে বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এমনকি সুইডিশ ভাষাতেও। বঙ্কিম ও শরৎচন্দ্রের সাহিত্য প্রবলভাবে হিন্দি ভাষার অঙ্গনে জায়গা করে নিয়েছে। দেবদাস কথাটি হিন্দি লব্জ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। হিন্দি ভাষায় রবীন্দ্রসঙ্গীত যথেষ্ট মার্জিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। হিন্দি ভাষার অগ্রগণ‍্য লেখক ধনপত রাই শ্রীবাস্তব প্রেমচন্দ হয়ে উঠলেন শরৎসাহিত‍্যের অন্তর্বস্তুর টানে। হিন্দিভাষায় তৈরি বহু ফিল্মের গল্প বাংলা উৎস থেকে নেওয়া। যাঁরা হিন্দির সঙ্গে বাংলার বিরোধ কল্পনা করে আস্তিন গোটাতে পছন্দ করেন, তাঁরা এ তথ্যগুলি মনে রাখলে ভাল করবেন।
বাংলাভাষার কাব‍্যতাত্ত্বিকেরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আধুনিক কবিদের তালিকা থেকে সযত্নে বাদ দিয়েছেন। আধুনিক বাংলা কবিতার সর্বাগ্রগণ‍্য ব‍্যক্তিত্ব জীবনানন্দ দাশ ছিলেন ইংরেজি ভাষার অধ‍্যাপক। তারপরেই যাঁদের নাম করতে হয়, সেই বুদ্ধদেব বসু ও বিষ্ণু দে, এই দুজনেও ইংরেজি ভাষার অধ‍্যাপনা করে জীবিকার্জন করেছেন। ইংরেজি ভাষায় কৃতবিদ‍্য ছিলেন সমর সেন, অমিয় চট্টোপাধ্যায় ও আরো অনেকেই। ফরাসি কবিতার চর্চা করেছেন সবুজ পত্রের প্রমথ চৌধুরী ও ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী। পাবলো নেরুদার কবিতা, নাজিম হিকমতের কবিতা বাঙালি পাঠক পেয়েছে সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর প্রচেষ্টায়। বাংলায় আধুনিক উপন্যাসের জনক বঙ্কিমচন্দ্রের উপন‍্যাসের পরিচ্ছেদের সূচনায় ইংরেজি সাহিত্যের স্বীকরণ আছে। বিদ‍্যাসাগর উইলিয়াম শেকসপীয়রের কমেডি অফ এররস নাটকের কাহিনীকে ভ্রান্তিবিলাস নামে উপন‍্যাসের আকারে পেশ করেছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রথম রচনা ক‍্যাপটিভ লেডি ইংরেজি ভাষায়। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস রাজমোহনস ওয়াইফ ইংরেজি ভাষায়। ইংরেজি গ্রীক ল‍্যাটিন হিব্রুভাষায় গভীর পাঠাভ‍্যাস না থাকলে মধুকবি হয়ে ওঠা শক্ত ছিল। আধুনিক বাংলা কবিতা গড়ে উঠতে ইংরেজি সাহিত্যের টি এস এলিয়ট, এজরা পাউন্ড, ফরাসি সাহিত্যের বোদলেয়র, মালার্মে , এঁদের কলমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে শুধুই ভারতীয় মার্গসঙ্গীত, আর লোকায়ত বাউল, কীর্তন গানের ভূমিকা ছিল না, আইরিশ সুরকেও সযত্নে আপন করেছেন তিনি। বাংলা নাটক হয়ে উঠতে মেটারলিঙ্ক, ইবসেন, ব্রেখটের অবদান রয়েছে। বাঙালি ইংরেজের শাসনের যাঁতাকল থেকে মুক্তি পেতে চেয়ে, আন্দোলন গড়তে চেয়ে ইংরেজি ভাষার কাছে হাত পেতেছে। দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ শাসকের হুকুমে নিষিদ্ধ হলে সৃষ্টি করেছে ইণ্ডিগো মিরর। পাদরি সাহেব জেমস লঙ কারাবরণ করেছেন। কালীপ্রসন্ন সিংহ ওরফে হুতোম পেঁচা জরিমানার টাকা মিটিয়ে দিয়েছেন। নামগোপন করে রাতারাতি নাটকটি অনুবাদ করে দিয়েছেন নাকি শ্রীমধুসূদন। ইংরেজের হুমকির কাছে মাথা নত না করে ইংরেজি ভাষায় বলীয়ান বাঙালি ভার্নাকুলার অ্যাক্টের নাগপাশ এড়াতে রাতারাতি বাংলা সংবাদপত্রকে ইংরেজি ভাষার কাগজে রূপান্তরিত করেছে। অমৃতবাজার পত্রিকা হয়ে উঠেছে স্বাধীনতাপিপাসু মানুষের নয়নমণি। নেতৃত্ব দিয়েছেন মহাত্মা শিশিরকুমার ঘোষ। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের লেখনীও ইংরেজি ভাষায় জাতীয় জাগরণ ঘটিয়েছে। তাঁর সাবিত্রী কাব‍্যও ইংরেজি ভাষায়। দেশীয় পালকিবাহকের দুঃখ বেদনার আধারে স্বদেশচেতন মানুষের আকুতিকে ধরতে চেয়েছেন অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কন‍্যা সরোজিনী নাইডু। ইংরেজি ভাষা হয়ে উঠেছিল সারা ভারতের স্বাধীনতাপিপাসু মানুষের মানসিক যোগাযোগের ভাষা।
বিদ‍্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণপরিচয়ে রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পান সংস্কৃত সাহিত‍্যের মেঘদূত। সংস্কৃত রামায়ণ মহাভারতকে বারবার আত্মস্থ করে লেখেন কর্ণকুন্তী সংবাদ, গান্ধারীর আবেদন। রক্তকরবীতে রামায়ণ কাহিনীর নব রূপায়ণ ভাবেন। সংস্কৃতের কাছে বারে বারেই বাংলা সশ্রদ্ধভাবে হাত পেতেছে। বলেছে, দেহি পদপল্লব মুদারম।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।