• Uncategorized
  • 0

|| পশ্চিমবঙ্গ দিবস ও বঙ্গীয় রাজ‍্যপালদের কথা || লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

পশ্চিমবঙ্গ দিবস ও বঙ্গীয় রাজ‍্যপালদের কথা

গতকাল ছিল পশ্চিমবঙ্গ দিবস। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গের জন্মদিন। আমাদের দেশ তো একটিই। সে হল ভারত। ভারতের বিশিষ্ট দিবস দুটি পনের আগস্ট আর ছাব্বিশে জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের‌ও বিশিষ্ট দিবস।
যাই হোক, আমাদের পশ্চিমবঙ্গের সম্পর্কে কিছু জানা দরকার। এটি জনসংখ্যার দিক দিয়ে ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম অঙ্গরাজ্য। আর আয়তনের দিক দিয়ে চতুর্দশতম। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রফল ৮৮,৭৫২ বর্গকিলোমিটার। আর জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১১২৯ জন। পশ্চিমবঙ্গের সাক্ষরতা হার হল ৮৭.০৮%, এবং প্রতি হাজার পুরুষ পিছু নারীর সংখ‍্যা ৯৫০।
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ক্ষেত্র ২৯৪টি, লোকসভা ক্ষেত্র ৪২টি, আর রাজ‍্যসভায় ১৬টি আসন আছে।
পশ্চিমবঙ্গের রাজ‍্যপ্রাণী উদবিড়াল বা ভোঁদড়, রাজ‍্য পাখি সাদা গলা মাছরাঙা, রাজ‍্য মাছ ইলিশ, রাজ‍্য ফুল রাতে ফোটা জুঁই, রাজ‍্য গাছ ছাতিম। পশ্চিমবঙ্গে আঠারোটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ‍্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে প্রাচীন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন‍্য। অন‍্যান‍্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ‍্যে যাদবপুর ও প্রেসিডেন্সি উল্লেখযোগ্য।
পশ্চিমবঙ্গের প্রধান হলেন রাজ‍্যপাল। তাঁর নামেই রাজ‍্য পরিচালিত হয়। দেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির দিনে রাজ‍্যপাল ছিলেন চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী। তারপর দ্বিতীয় রাজ‍্যপাল ছিলেন কৈলাসনাথ কাটজু। ক্রমান্বয়ে হরেন্দ্রকুমার মুখার্জি, ফণিভূষণ চক্রবর্তী, পদ্মজা নাইডু, ধরমবীরা, দীপনারায়ণ সিংহ, শান্তিস্বরূপ ধবন, অ্যান্টনি ল‍্যান্সেলট ডায়াস, ত্রিভুবন নারায়ণ সিং, ভৈরব দত্ত পাণ্ডে, অনন্ত প্রসাদ শর্মা, সতীশ চন্দ্র, উমাশঙ্কর দীক্ষিত, সৈয়দ নুরুল হাসান, টিভি রাজেশ্বর, সৈয়দ নুরুল হাসান, বি সত‍্যনারায়ণ রেড্ডি, কে ভি রঘুনাথ রেড্ডি, আখলাকুর রহমান কিদোয়াই, শ‍্যামল কুমার সেন, বীরেন জে শাহ্, গোপাল কৃষ্ণ গান্ধি, দেবানন্দ কোঁয়ার, এম কে নারায়ণন, ডি ওয়াই পাতিল, কেশরীনাথ ত্রিপাঠী, ও বর্তমানে রাজ‍্যপাল হলেন জগদীপ ধনখড়।
এর মধ‍্যে দীপনারায়ণ সিংহ, সতীশ চন্দ্র, ও ডি ওয়াই পাতিল ছিলেন অ্যাকটিং রাজ‍্যপাল। আর বি সত‍্যনারায়ণ রেড্ডি এবং দেবানন্দ কোঁয়ার ছিলেন অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজ‍্যপাল।
সৈয়দ নুরুল হাসান দুইবার রাজ‍্যপাল হিসেবে দায়ভার পালন করেছেন। প্রথমে পঞ্চদশতম রাজ‍্যপাল হিসেবে ১২ আগস্ট, ১৯৮৬ থেকে ২০ মার্চ, ১৯৮৯ অবধি, এবং দ্বিতীয় বার সপ্তদশতম রাজ‍্যপাল হিসেবে ০৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯০ থেকে ১২ জুলাই, ১৯৯৩ অবধি। দীর্ঘ সময় রাজ‍্যপাল ছিলেন অ্যান্টনি ল‍্যান্সেলট ডায়াস। অষ্টমবারের রাজ‍্যপাল হিসেবে ২১ আগস্ট, ১৯৭১ থেকে ০৬ নভেম্বর, ১৯৭৯ অবধি তিনি দায়ভার পালন করেছেন। বঙ্গে সবচেয়ে বেশি সময় রাজ‍্যপাল পদে বৃত ছিলেন পদ্মজা নাইডু। ০৩.১১. ১৯৫৬ থেকে ০১.০৬.১৯৬৭, এই দশ বছর সাতমাস ব‍্যাপী সময়।
আমাদের রাজ‍্যপালগণের মধ‍্যে শিক্ষা দীক্ষায় সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন সৈয়দ নুরুল হাসান। আপাদমস্তক শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষটি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ছিলেন। আগে তিনি লণ্ডনে স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যাণ্ড আফ্রিকান স্টাডিজ এর ইতিহাস বিভাগের লেকচারার ছিলেন। পরে তিনি ইণ্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হন। লণ্ডনের রয়‍্যাল হিস্টরিক‍্যাল সোসাইটি ও রয়‍্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো ছিলেন তিনি। ২৪ মার্চ, ১৯৭২ থেকে ২৪ মার্চ ১৯৭৭ অবধি তিনি ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় শিক্ষা সংস্কৃতি মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৬ অবধি তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টরিক‍্যাল রিসার্চ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর প্রেরণা ও উৎসাহে গড়ে ওঠে ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল অফ সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ, নিউদিল্লি, সেন্টার ফর উইমেন ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, নিউদিল্লি, এবং কলকাতায় মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ। এছাড়া তিনি কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যাণ্ড ইনডাসট্রিয়াল রিসার্চ সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গের তৃতীয় রাজ‍্যপাল হরেন্দ্রকুমার মুখার্জিও ছিলেন একজন শিক্ষাদরদী সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ। তিনি ছিলেন এম‌এ, পিএইচডি, ডি লিট। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনিই প্রথম দর্শন শাস্ত্রে ডি ফিল করেন। তাঁর ডক্টরাল রিসার্চ ইংরেজি সাহিত‍্য নিয়ে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ‍্যাপনাও করেছেন।
ধরমবীরা ছিলেন ষষ্ঠ রাজ‍্যপাল। তাঁর কার্যকাল ছিল ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯। পরে তিনি পদ্মবিভূষণ সম্মান পেয়েছিলেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ অবধি তিনি ভারত স্কাউটস অ্যাণ্ড গাইডস এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
বিতর্কিত রাজ‍্যপাল হিসেবে পরিচিত ছিলেন গোপালকৃষ্ণ গান্ধি। তিনি ছিলেন তেইশতম রাজ‍্যপাল। ২০০৪ থেকে ২০০৯ অবধি কার্যকালে তিনি রাজনৈতিক বিষয়ে মন্তব্য করে শাসক দলের বিরাগভাজন হন। নন্দীগ্রাম কাণ্ডে তিনি “হাড়হিম” মন্তব্য করার জন‍্য বিখ্যাত। এর আগে কোনো রাজ‍্যপালকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে এত বিতর্ক সৃষ্টি হয় নি। গোপালকৃষ্ণ গান্ধি ছিলেন মহাত্মা গান্ধির পৌত্র, এবং চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারীর দৌহিত্র। বিখ্যাত দুই রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরাধিকারী এই মানুষটি স্পষ্টভাষণের জন‍্য নিন্দিত হন। তিনি অশোক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অধ‍্যাপনা করেছেন।
পদ্মজা নাইডু (১৭.১১.১৯০০ – ০২.০৫.১৯৭৫) ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চম রাজ‍্যপাল। আর এখনো পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র মহিলা রাজ‍্যপাল। ০৩.১১. ১৯৫৬ – ০১.০৬.১৯৬৭,  দশ বৎসর সাত মাস, এই দীর্ঘদিন ধরে তিনি রাজ‍্যপাল হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন। তিনি এক গুণী কবি মায়ের মেয়ে ছিলেন। সরোজিনী নাইডু ছিলেন তাঁর মা। পিতার নাম ছিল মুথিয়ালা গোবিন্দরাজুলু নাইডু। সরোজিনী নাইডু ছিলেন বিখ্যাত গান্ধিঘনিষ্ঠ  স্বাধীনতা সংগ্রামী। দেশ স্বাধীন হবার পর সরোজিনী নাইডু উত্তরপ্রদেশের রাজ‍্যপাল হল। তিনিই ভারতের প্রথম মহিলা রাজ‍্যপাল। পদ্মজা নাইডু নেহরু পরিবারের অত‍্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী জ‌ওহরলাল নেহরুর সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে একসাথে বসবাস করতেন। লোকে বলে তনয়া ইন্দিরার কঠোর, কঠিন ও তীক্ষ্ণ তর্জনী শাসনে বিপত্নীক নেহরু পদ্মজাকে ঘরণী করেন নি। তবে আমৃত্যু পদ্মজা নেহরুর তিনমূর্তি ভবনে বসবাস করেছেন। পদ্মজা ভারতীয় রেডক্রসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ – ১৯৭২, এই সময়টুকুতে তিনি রেডক্রসের চেয়ারপারসন ছিলেন। দার্জিলিং শহরের  হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক পদ্মজা নাইডুর নামাঙ্কিত। একুশতম রাজ‍্যপাল ছিলেন শ‍্যামলকুমার সেন। পশ্চিমবঙ্গের হাতে গোণা বাঙালি রাজ‍্যপালদের অন‍্যতম তিনি। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ও এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসাবে দায়ভার পালন করেছিলেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ‍্যে এতসব গুণী রাজ‍্যপালের ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন থাকুক।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।