দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব -২০০)

পর্ব – ২০০

সমসময়ের লোকজন সত‍্যসাধককে ক্রুশবিদ্ধ করছে। ছুরি নিয়ে আঘাত করছে। ক্লোজ রেঞ্জে গুলি করছে। সত‍্যের সপক্ষে দাঁড়ালেই খুনের ঘটনা। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। হেঁটে চলেছে শ‍্যামলী। এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে সে। একটা চাদর পর্যন্ত গায়ে জড়ানোর কথা মনে আসে নি। গাছের পাতায় পাতায় বাতাস কি কথা কয়ে যাচ্ছে। চন্দ্রালোকিত নির্জন রাস্তায় একটিও লোক নেই। নভেম্বরের ছয় তারিখেই গড়িয়ে যাওয়া সন্ধ্যায় মফস্বল শহরটা বেশ নিঃঝুম হয়ে পড়েছে।
অন্ধ কবি হোমার একা একা গেয়ে চলেছেন তাঁর মহাগাথা। কে শুনল, না শুনল, তাঁর মাথা ব‍্যথা নেই। মিল্টন লিখে ফেলছেন অ্যারিওপ‍্যাগিটিকা। তার আর এডিশন হয় না। শতাব্দী পেরিয়ে তার আদর হবে। পরের শতাব্দীতে বিখ্যাত হয়ে যাবে। তারপরের শতাব্দীতে পৃথিবীর সেরা সেরা যুদ্ধ বিরোধী শান্তিকামী বুদ্ধিজীবীর নয়নমণি হয়ে উঠবে সেই ব‌ই। ১৯৪৪ সালে সেই ব‌ইটি প্রকাশের তিনশো বছর উপলক্ষে আন্তর্জাতিক সভা হবে। সেই জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অ্যারিওপ‍্যাগিটিকা নিয়ে ভাববেন। লিখবেন। এক মহাকবিকে আর এক মহাকবিই বোঝেন।
নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এশিয়া মহাদেশের প্রথম নোবেল প্রাপ্তি। কলকাতার ভদ্রমণ্ডলী গোটা রেলগাড়ি ভাড়া করে শান্তিনিকেতনে আসছেন। তাঁরা কবিশেখরকে সংবর্ধনা জানাবেন। কবিও প্রত‍্যভিনন্দনের আয়োজন করেছেন। সুললিত শব্দচয়ন করে তাঁর বক্তব্যের খসড়া তৈরি করে রেখেছেন। মিষ্টি মুখের বন্দোবস্ত করে রেখেছেন। কিন্তু শঙ্কা যেথায় করে না কেউ, সেইখানে হয় জাহাজ ডুবি। সামনের সারিতে যাঁরা বসেছিলেন, তাঁদের দেখে গা জ্বলে গেল মহাকবির। এই এরাই কয়েকদিন আগে তাঁর নামে কত রকম কুৎসা রটনা করেছে। তা গাল দাও। তোমার পছন্দসই না হলে গাল দিতেই পার। হংসপাখায় পাঁক লাগে না। কিন্তু, দ্বিচারিতা কেন? আজ নোবেল পুরস্কার পাওয়া গেল বলে কাল পর্যন্ত যাকে উঠতে বসতে গালমন্দ করেছ, সে লোকটা হঠাৎ করে ভাল হয়ে গেল না?
সুললিত বক্তৃতার স্ক্রিপ্ট সরিয়ে রেখে মহাকবি তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন সেইসব মুখোশধারীদের। মহৎ ব‍্যক্তি কখনো হিসাব করে, কিসে লাভ হবে, ফায়দা হবে সেই বুঝে কথা বলেন না। তাঁরা আগ্নেয়াদ্রির মতো। স্বতঃস্ফূর্ত আর দ্বিধাহীন।
 অভিমান করে বলছেন, এই বাংলায় আমাকে যেমন করে আঘাত আর অপমান করা যায়, এমনটি আর কাউকে নয়।
বিবেকানন্দের চোখ বোজার পর পর‌ই ভগিনী নিবেদিতাকে রামকৃষ্ণ পরিমণ্ডল থেকে দূর করে দিচ্ছেন বিবেকানন্দের সতীর্থরা। সেই নিবেদিতা, যাঁকে এক‌ই সাথে ভগিনী, কন‍্যা ও বন্ধু বলে সম্মান ও সমাদর করেছেন বিবেকানন্দ।
ইতিহাসের পর্দা সরিয়ে হাজির হয় আরেকটি মেয়ে। বিদূষী। প্রখর ব‍্যক্তিত্বসম্পন্ন এক গণিতজ্ঞ জ‍্যোতির্বিজ্ঞানী।
চার্চের বেদীমূলে এক অসামান্য সুন্দরী। চোখদুটিতে তীব্র মেধার স্ফূরণ। সম্পূর্ণ নিরাবরণ এক সুন্দরী। লজ্জাস্থানটুকু সামান‍্য আড়াল করেছে আলুলায়িত সোনালি কেশদাম। ১৮৮৫ সালে সেই বিদূষী মেয়েকে ঠিক এইভাবে এঁকেছেন চার্লস উইলিয়াম মিশেল। তার বত্রিশ বছর আগে চার্লস কিংসলে তাঁর উপন‍্যাসে সে মেয়ের মধ‍্যে অপূর্ব ধীশক্তি আর অলোকসামান‍্য সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠা দেখেছেন। যেন মহান প্লেটোর আত্মা, দেবী আফ্রোদিতির শরীর নিয়ে ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছেন। ১৮৫২ সালে আরেকজন চার্লস, ফরাসি কবি  চার্লস লা কোঁৎ দ‍্য লাইসল তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তার‌ও আগে বিখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক এড‌ওয়ার্ড গিবন দ‍্য হিস্ট্রি অফ দি ডিকলাইন অ্যাণ্ড ফল অফ রোমান এমপায়ার ব‌ইতে তাঁর কথা লিখেছেন।
 সে মেয়েকে স্বাধীন মনোভাব নিয়ে বিজ্ঞান ও গণিতের চর্চা করতে দেখে ধর্মধ্বজীরা তাকে ডাইনি আখ‍্যা দিয়েছে। ধর্ম মন্দিরের সিঁড়িতে ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে তাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুন করেছে। আঘাত শুরু করার আগে পোশাক ছিঁড়ে খুঁড়ে কেড়ে নিয়েছে। বিবস্ত্র করেছে। খুনের পর সে মেয়ের হাত পা অঙ্গ প্রত‍্যঙ্গগুলি টুকরো টুকরো করে শহরের প্রাচীরের বাইরে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। তারপর আগুন ধরিয়ে দিয়েছে খণ্ড বিখণ্ড থ‍্যাঁতলানো মাংসপিণ্ড গুলিতে।
 তিনি হাইপেশিয়া। মূর্তিমতী বিদ‍্যা। আলেকজান্দ্রিয়ার স্মরণীয় গণিতবিদ থিওন এর পুত্রী।
 সমসাময়িক খ্রিস্টান ইতিহাস লেখক ফিলোস্টরজিয়াস বলেছেন হাইপেশিয়া গণিতের চর্চায় তাঁর পিতা থিওনকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।
আলেকজান্দ্রিয়ার অভিধান সংকলক হেসাইকিয়াস লিখেছেন, তাঁর পিতা থিওনের মতোই তিনি একজন প্রতিভাধর জ‍্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন। থিওন ইউক্লিডের এলিমেন্টস ব‌ইটির উপর টীকা রচনা করেছিলেন। আর তাঁর কন‍্যা টলেমির আলমাজেস্ট এর টীকা লিখেছিলেন, এমনকি আলমাজেস্ট এর ভুল ত্রুটি সংশোধন করেছেন। ডায়োফানাস এর বিখ‍্যাত ব‌ই, তেরটি খণ্ডে বিন‍্যস্ত এরিথমেটিকার উপর টীকা রচনা করেছেন। জ‍্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম তৈরি ও ডিজাইন করেছেন।
হাইপেশিয়া ছিলেন গণিত ও দর্শনের শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষক তায় তিনি নিজেকে সীমিত না রেখে আরো বড়ো ও ব‍্যাপক ক্ষেত্রে বিস্তার করে চিন্তানায়ক ও পথপ্রদর্শক করে গড়ে তুলছিলেন। নারীত্বকে কামনা বাসনা দেহভোগের সরঞ্জাম হিসেবে ভাবত সমসাময়িক সমাজ। তাঁর কাছে ক্লাস করতে এসে তাঁকে প্রেম নিবেদন করে বসে এক ছাত্র। মানুষ হিসেবে হাইপেশিয়া শুধু অসামান‍্য মেধাবী সুন্দরীই ছিলেন না, তাঁর মনটি ছিল সৌজন্যবোধে ভরপুর। শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের প্রেমকে প্রথমেই রূঢ়ভাবে আঘাত না করে বীণাতন্ত্রীতে সুর তুলে ছাত্রের মনকে রুচির উচ্চলোকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন হাইপেশিয়া। শ‍্যামলীর মনে পড়ে গেল কৃষ্ণদাস কবিরাজ বিরচিত চৈতন্য চরিতামৃতের অপূর্ব শ্লোকখানি।
আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা তারে বলি কাম।
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম।।
হাইপেশিয়ার তরফে ছাত্রকে সুর সুরধুনীর স্বাদে আশ্লিষ্ট করার মেধাবী প্রচেষ্টাকে ব‍্যর্থ করে দিয়ে ছাত্র অনাবৃতভাবে কামলোলুপ হয়ে হাইপেশিয়ার অনিন্দ্যকান্তিতে হস্তাবলেপ করতে চাইল। প্রচণ্ড রাগে ঘৃণায় বিবমিষায় হাইপেশিয়া নিজের মাসিকের ন‍্যাকড়াগুলি ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারলেন কামার্ত পশ্বাধমের দিকে। বললেন, তোরা এইগুলোই চাস্। এই নে। আমার মাসিকের ন‍্যাকড়াগুলি নিয়ে  দূর হ। হাইপেশিয়ার রুদ্রাণী মূর্তি দেখে ছাত্রটি আর এগোতে সাহস পায় নি।
আকাশের তারার সংকেতে সাড়ে পনেরোশো বছর আগে মৃত হাইপেশিয়াকে হাতড়ে হাতড়ে খোঁজে শ‍্যামলিমা। একটা মেয়ে কি নিছক একটা শরীর? একটা কামনা মেটাবার যন্ত্র?

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।