প্রয়াণ দিবসে জীবনানন্দ দাশ – লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

দেশভাগ, দাঙ্গা, মহামারী, তীব্র বেকারত্ব, কালোবাজারি, রাজনৈতিক ধান্দাবাজি, আর এই সমস্তের উপরে দু দুটি বিশ্বযুদ্ধ একজন সংবেদনশীল কবিহৃদয়ে গভীর ছায়াপাত করলে যা হয়, তা জীবনানন্দকে ভাবিয়েছে। এগুলির চাইতে বেশি করে ভাবিয়েছে গোটা পৃথিবীতে সভ‍্যতার ইতিহাসের বাঁকবদলগুলি, বিপ্লব, উত্তরণ, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, এবং পশ্চাদপসরণ। সমস্ত পৃথিবীর মানব সভ‍্যতার গড়ে ওঠা, বিবর্তন, যন্ত্রণা এবং বিশ্বাসভঙ্গকে পলকাটা হীরের মতো দেখেও তার ভিতর থেকে আলোর ঝলকানি দেখতে তিনি ভুলে যান নি। অজস্র সীমাবদ্ধতা, অস্পষ্টতা, বিকৃতি পেরিয়ে তিনি সভ‍্যতার ইতিবাচক উত্তরণে আস্থাবান থেকে গিয়েছিলেন।
১৮৯৯ সালে জন্ম তাঁর। ফাল্গুনের দিনে। আর ১৯৫৪ তে মৃত্যু। কার্তিকে। অক্টোবরে। ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের অধ‍্যাপনা করতে এসে সাহিত্যের পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন, এবং পুরাণ নিয়ে একটি সংবেদী মন জীবনানন্দ অর্জন করেছিলেন।সেই সঙ্গে কিছু অস্থিরতা। যে মানুষ গোটা সভ‍্যতার সারাৎসারকে এক গণ্ডূষে পাঁজরে পুরে নিতে পেরেছেন, তাঁর পক্ষে খুব শান্ত, হিসেবি জীবন কাটানো শক্ত।
 একটা দুর্দান্ত বিস্ফোরণ যার ভিতরে ঘটে, ঝলকে ঝলকে যা লেলিহান বোধ উদ্গিরণ করে, তাকে শান্ত সমাহিত ভাবব কেন?
 কলকাতার সিটি কলেজ (১৯২২ – ২৮), রামযশ কলেজ, দিল্লি (১৯৩০ – ৩১), ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল (১৯৩৫ -৪৮), খড়্গপুর কলেজ, খড়্গপুর (১৯৫১ – ৫২), বড়িশা কলেজ (১৯৫৩), হাওড়া গার্লস কলেজ (১৯৫৩- ১৯৫৪); এই তালিকাটি দেখলেই কতকগুলো ফাঁক চোখে পড়ে। সময়ের ফাঁক। কেন এই রকম ফাঁক? তিনি কি হিসেবি হতে জানতেন না? তাঁকে কি কেউ হিসেবি হতে বলে নি?
জন্ম তাঁর বরিশালে, পূর্ববঙ্গে। এখনকার বাংলাদেশে। ব্রাহ্ম আদর্শসমৃদ্ধ ভদ্র মধ‍্যবিত্ত পরিবারে জীবনানন্দের জন্ম। মা ছিলেন কবি। কথায় বড় না হয়ে, কাজের ক্ষেত্রে বড় হতে শিক্ষা দিতেন তিনি। মুখে শুধু বলা নয়, দায়ে বিপদে প্রতিবেশীর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন তিনি নিজে। বাবা ভোরবেলা উঠে উপনিষদ পড়ছেন। সূর্যের আলোকে, নদীর ধারাকে, বাতাসের বেগকে, আকাশের বিস্তারকে অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন। মা গাইছেন গান। এমন একটা পরিবেশ ছোটবেলায় বরিশালে পেয়েছিলেন তিনি।
সেখানেই ব্রজমোহন স্কুল, সেখানেই ব্রজমোহন কলেজে পড়াশুনা। পরে প্রেসিডেন্সী কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। এই বরিশালেই আবার ফিরে এসেছেন তিনি ১৯৩৫ সালে।
তখন ছত্রিশ সাঁইত্রিশ বছর বয়স। জীবনে থিতু হবার বয়স। হিসেবি ও সংসারী হবার বয়স। পরিবারকে গাঢ় করে আগলে রাখার বয়স। জীবনানন্দ দাশ বরিশালে ফিরে নিজে যে কলেজে ছাত্র ছিলেন, সেই ব্রজমোহন কলেজে পড়ানো শুরু করলেন। ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৮ অবধি। চৌদ্দ বছর ব্রজমোহন কলেজে পড়ানো। ১৯৪৭ এ খণ্ডিত স্বাধীনতা ও দেশভাগ। পূর্ব পাকিস্তানে থাকতে পারলেন না তিনি। নিজের চিরপরিচিত বরিশাল থেকে কেমন যেন ছন্নছাড়ার মতো বেরিয়ে পড়লেন তিনি। এরপর শিক্ষকতাই করেছেন কলেজে কলেজে। কোথাও একবছর, কোথাও দেড় বছর।
স্বাধীনতার যখন সাত বছর বয়স, সেই ১৯৫৪ সালে তাঁর যেন ঘুম ভেঙে গেল। অথবা হয় নি ঘুম এর আগে। এবার যেন ভাল করে ঘুমাবেন। অক্টোবরের ১৪ তারিখে বালিগঞ্জে ট্রাম দুর্ঘটনায় আঘাত পান কবি। পাঁজর ভাঙে। সাতদিন ভুগে বাইশে অক্টোবর রাত্রি এগারোটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে চিরঘুম।
অশান্ত হৃদয়ে কেন যেন কলকাতার পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন। আর নিজেকে প্রশ্ন করতেন অন্ধকার নিয়ে। বলতেন, অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ…। বলতেন, এ যুগে এখন ঢের কম আলো সবদিকে, তবে। নিজের সাথে নিজের সাথে নিজে আলাপ করতেন। বলতেন, সৃষ্টির মনের কথা মনে হয় – দ্বেষ। বলতেন, মানুষের ভাষা তবু অনুভূতি দেশ থেকে আলো না পেলে নিছক ক্রিয়া; বিশেষণ; এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল জ্ঞানের নিকট থেকে ঢের দূরে থাকে। কিন্তু তার ভিতর থেকে আলো দেখতে পান জীবনানন্দ।রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে বলেন, দেখেছি রাত্রির রঙে বিভাসিত হয়ে থেকে আপনার প্রাণের প্রতিভা বিচ্ছুরিত করে দেয় সংগীতের মতো কণ্ঠস্বরে‌। ভিতরে পিতার কাছে শোনা উপনিষদ নিষ্কম্প দীপশিখা হয়ে বলে
এ অঙ্গার অগ্নি হোক, এই অগ্নি ধ‍্যানালোক হোক;
জ্ঞান হোক প্রেম, প্রেম শোকাবহ জ্ঞান
হৃদয়ে ধারণ ক’রে সমাজের প্রাণ
অধিক উজ্জ্বল অর্থে করে নিক অশোক আলোক
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।