গদ্য বোলো না -তে মৃদুল শ্রীমানী

এমিল জোলা আর তাঁর শিকল পরা ছল

সালটা ১৮৯৮। আজ থেকে ঠিক ১২৩ বছর আগে এইরকম তেইশ ফেব্রুয়ারি তারিখে এমিল জোলা গেলেন জেলে। না, বেড়াতে নয়। জেলবন্দিদের নিয়ে গপ্পো ফাঁদবেন বলেও নয়। স্রেফ কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে জেল খাটতে গেলেন বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি লেখক এমিল জোলা ( ০২.০৪.১৮৪০ – ২৯.০৯.১৯০২)।
রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের ইহুদি বিদ্বেষী মনোভাবকে তীব্র ধিক্কার দিয়ে কলম ধরেছিলেন তিনি। সরকারি তরফে অন‍্যায়ভাবে ক‍্যাপটেন আলফ্রেড ড্রেইফুসকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করার বিরুদ্ধে ‘জে অ্যাকিউজ় – আমি প্রতিবাদ করছি’ শিরোনামে কলম ধরেছিলেন এমিল এদুয়ার্দ চার্লস আঁতোয়াঁ জোলা।
“আমি প্রতিবাদ করছি”, এই ভাবে লিখতে শুরু করলেন একটা খোলা চিঠি। সেখানে আটান্ন বৎসর বয়সী প্রবীণ লেখক ফরাসি রাষ্ট্রীয় সমর কর্তৃপক্ষকে তাঁদের অপকর্মের বিরুদ্ধে তুলোধোনা করলেন। সে চিঠি প্রথম পৃষ্ঠায় ছেপে বের করল লা অরোরা কাগজ। ছাপার তারিখ জানুয়ারি ১৩, ১৮৯৮।
এমিল জোলা ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত লেখক। তাঁর সব সেরা সৃষ্টি জার্মিনাল (১৮৮৫) লেখা হয়েছিল কয়লাখনি এলাকার বাস্তবতার প্রেক্ষিতে। কয়লাখনিটাই যেন এক সর্বগ্রাসী দৈত্য। এই রকম একটা আবহ তৈরি করে বুর্জোয়া আর শ্রমিকদের মধ‍্যে দ্বন্দ্বকে তিনি তুলে ধরলেন। কয়লাখনি এলাকার শ্রমিকদের ধর্মঘট নিয়ে তিনি লিখেছেন। গুণীজনের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল জার্মিনাল। বিশ্ববন্দিত চিত্রকর ভ‍্যান গঘ এই জার্মিনাল পড়ে আপ্লুত হয়েছিলেন। জার্মিনালের প্রভাবে গঘের তুলিতে জন্ম নিয়েছিল দুটি অসামান্য চিত্রকর্ম, উ‌ইভার্স আর দি পটেটো ইটার্স।
জোলার আরেকটি বিখ‍্যাত সৃষ্টি নানা (১৮৮০)।
উপরতলার বড়লোক মানুষের উদগ্র যৌনক্ষুধা আর যৌনবিকৃতি আর কদাচার নিয়ে কলম ধরেছেন জোলা।
১৮৯২ তে জোলা লিখেছেন লা ডিবাকল। ১৮৭০ – ৭১ সালে ফরাসি জার্মান যুদ্ধে তিনি ফরাসি রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ও সৈন‍্যবাহিনীর কাজকর্ম নিয়ে খোলাখুলি ভাবে সমালোচনা করেছেন। কিন্তু মুশকিল হল, জোলার এই ডিবাকল উপন‍্যাসটি শুধু ফরাসি সরকারের‌ই বিরক্তি উৎপাদন করে নি, সমভাবে জার্মান কর্তৃপক্ষও জোলার এই উপন‍্যাসের প্রতি শত্রুতার দৃষ্টি নিয়েছিল।
ততদিনে জোলা সারা বিশ্বে অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখক ঔপন্যাসিক হিসেবে গণ‍্য হলেও ফরাসি সাহিত্য আকাদমিতে তাঁর মনোনয়ন জোটেনি। যদিও অন্ততঃপক্ষে ঊনিশবার জোলার সপক্ষে নমিনেশন জমা পড়েছিল।
জোলা ছিলেন সেই বিরল ধরনের লেখক যিনি রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের অন‍্যায়টাকে অন‍্যায় বলতে জানতেন, আর খোলামেলা সমালোচনা করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। ক্ষমতাসীনদের অন‍্যায় অবিচারের মুখোশ নিয়ে টানাহেঁচড়া করতে তাঁর ক্লান্তি ছিল না। তিনি ছিলেন গরিব মানুষের বাঁচার অধিকারের পক্ষে এবং সামাজিক ন‍্যায়বিচারের উপাসক।
কাজেই এমন বিপজ্জনক লেখককে আটান্ন বছর বয়সেও স্রেফ কলমচালনার দায়ে প্রতিপক্ষ ঠাউরে জেলে ঠেলতে দ্বিধা করেন নি ফরাসি প্রশাসন।
এরপর জোলা বেশিদিন বাঁচেন নি। ১৯০২ সালে সাড়ে বাষট্টি বছর বয়সে সেপ্টেম্বরের ২৯ তারিখে বিষাক্ত গ‍্যাসে শ্বাসরোধ হয়ে জোলার মৃত্যু। ফরাসি সরকার বলেছিল দুর্ঘটনা। আর কেউ কেউ আজো সন্দেহ করে, জোলা প্রশাসনের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন।
মৃত্যু হলে, কফিনবন্দী হয়ে তাঁর মরদেহ যখন পথে নেমেছে, ফ্রান্সের আপামর জনসাধারণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে চোখ মুছেছে, শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। ১৯০৮ সালে সেই মরদেহ ফ্রান্সের সর্বাগ্রগণ‍্য মহান সন্তান ভলতেয়ার, জাঁ জাক রুশো, ভিকটর উগ‍্যো, এই মাপের মনীষীদের পাশে স্থান পায়।
এমিল জোলা ছিলেন সত‍্যসাধক। যারা বঞ্চিত, যারা নিপীড়নের শিকার, জোলা তাঁদের হয়ে কথা বলেছেন। আজীবন সত‍্যসন্ধানী এই মানুষকে প্রবীণ বয়সে আজকের দিনে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। কবরের ভিতর জোলা হাসছেন। বলছেন, সত‍্যকে ঠুসে মারো, তাকে কফিনবন্দী করে চাপা দাও। তবু দেখবে, সত‍্য বিকশিত হয়ে চলেছে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।