রবিবারে রবি-বার – এ মৃদুল শ্রীমানী

শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা: রবীন্দ্র কাব‍্যের নিবিড়পাঠ

১৩১৪ বঙ্গাব্দের ৫ কার্তিক তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা” নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটি “কথা” কাব‍্যগ্রন্থে স্থান পেয়েছে।
কবিতার একেবারে সূচনায় বলা ছিল এর তথ‍্য অংশটি অবদান শতক থেকে নেওয়া হয়েছে। আর কবিতার একেবারে শেষে বলা আছে, অনাথপিণ্ডদ বুদ্ধের একজন প্রধান শিষ্য ছিলেন। কবিতাটির কুড়িটি স্তবকের প্রতিটিতে চারটি করে চরণ রয়েছে। প্রতিটি স্তবকের প্রথম তিনটি চরণ অন্ত‍্যমিল যুক্ত, এবং শেষ চরণটি একটিই মাত্র শব্দ এবং তা পূর্বের স্তবকের শেষ চরণের সঙ্গে অন্ত‍্যমিলে বাঁধা।
 কবিতায় দেখা যাচ্ছে ভগবান বুদ্ধের অন‍্যতম প্রধান শিষ‍্য অনাথপিণ্ডদ তাঁর প্রভুর জন‍্য ভিক্ষা করতে বেরিয়েছেন। তখনো ভোর ঠিকমতো হয়নি। কবি লিখেছেন, “সদ‍্য মেলিতেছে তরুণ তপন/ আলস‍্যে অরুণ সহাস‍্য লোচন”। বলা দরকার, এই অরুণ হলেন সূর্যের সাত ঘোড়ার রথের সারথি। সূর্য ওঠার আগে অরুণের আবির্ভাব। এই সময় শ্রাবস্তীপুরী নিদ্রিত। কবি জানিয়েছেন, রাজসভায় যাঁরা প্রভাতী সঙ্গীত ও রাজকীয় স্তুতিগাথা গেয়ে থাকেন, সেই বৈতালিকদল তখনও ঘুমিয়ে রয়েছেন, এবং শ্রাবস্তী নগরবাসীও ঘুমিয়ে রয়েছেন। ভিক্ষু অনাথপিণ্ডদ এইরকম ভোর হবার আগেই ভিক্ষা করতে বেরিয়েছেন।

তিনি ভিক্ষা করতে বেরিয়েছেন নিজের কোনো জাগতিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য নয়। তিনি বলবেন, ভিক্ষা আমার প্রভুরে দেহ গো।
আরো বলবেন, দেহ তাঁরে নিজ সর্বশ্রেষ্ঠ দান যতনে।
বলা দরকার, বুদ্ধ দীর্ঘজীবন লাভ করেছিলেন, এবং অনেক রাজা, ভূস্বামী, শ্রেষ্ঠী বণিক ইত্যাদি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। বুদ্ধকে কেন্দ্র করে তাঁর সন্ন্যাসী শিষ‍্যরা বড় বড় মঠ গড়েছিলেন। এগুলির নাম ছিল সংঘ। বৌদ্ধধর্মের দুটি প্রধান ভিত্তি – ধম্ম ও সংঘ। বুদ্ধের অনুরাগী মানুষ বুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে ধম্ম ও সংঘের শরণ নিয়েছেন। এই সংঘকে পরিচালনা করতে ভূস্বামী ও শ্রেষ্ঠীগণ যথেষ্ট অর্থ সাহায্য করেছেন। কিন্তু এই কবিতায় আমরা দেখছি, বৌদ্ধ ধর্মের অন‍্যতম প্রধান সংগঠক অনাথপিণ্ডদ ভোর হবার আগেই , যে সময় শ্রাবস্তীবাসী নিজ নিজ বাড়িতে ঘুমিয়ে রয়েছেন, তেমন সময় যাচ্ঞা করতে বেরিয়ে পড়েছেন।
অনাথপিণ্ডদ জানেন, ভোর সবে হতে চলেছে বলে, নাগরিকগণ এখনো ঘুমিয়ে। তিনি বলছেন, ওগো পুরবাসী, কে রয়েছ জাগি। অর্থাৎ তিনি জানেন, বেশিরভাগ লোকেই জেগে নেই। নগর শ্রাবস্তীপুরী যে ঘুমাচ্ছে, সে কথা সচেতনভাবে জেনে বুঝে তিনি বলছেন, ‘হে নিদ্রিত পুর/ দেহ ভিক্ষা মোরে কর নিদ্রা দূর”। আর তখন কী হচ্ছে, তাও কবি লিখেছেন। বলেছেন, তখনো পথ অন্ধকার, জানালার পাল্লা খুলে সদ‍্য ঘুমভাঙা চোখ মেলে নাগরিকরা জানতে চাইছেন, কে এলেন ভিক্ষা করতে?
অনাথপিণ্ডদ সহজ লোক নন। ভিক্ষুজীবনে আসার আগে তিনি ছিলেন অত‍্যন্ত হীন পেশায় যুক্ত। কিন্তু, গৌতম বুদ্ধ তাঁর মধ‍্যে এক অতি উচ্চকোটির মানবসত্ত্বা দেখতে পেয়েছিলেন।
 ক্রমে অনাথপিণ্ডদ হয়ে উঠলেন সারিপুত্ত মোগগলায়ণের মতো বুদ্ধের সর্বপ্রধান শিষ্য। সেই অনাথপিণ্ডদ ভোর হবার আগেই পথে বেরিয়েছেন ভিক্ষা চাইতে, এবং বলছেন, ভিক্ষুশ্রেষ্ঠ বুদ্ধ ভগবানকে নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ জিনিসটি দান করো।

বুদ্ধকে শ্রাবস্তীপুরীর সকলেই শ্রদ্ধা করেন। তাঁরা বুদ্ধের উদ্দেশে মূল্যবান জিনিস উৎসর্গ করতে পিছপা নন। কবি লিখছেন, বণিক বাড়ির ব‌উরা কেউ গলার হার, কেউ মাথার মণি, কেউ বহুমূল‍্য রত্ন আধঘুমো চোখেই জানালা দিয়ে ভিক্ষুর উদ্দেশে ছুঁড়ে দিচ্ছেন। ধনী ব‍্যক্তিরা থালাভরে সোনা আনছেন, আনছেন দামি পোশাক আর গহনা। কবি বলছেন, মূল‍্যবান দ্রব্য এত‌ই জমা হল, তা যেন পথের ধূলিকে ঢেকে দিয়েছে। কিন্তু সাধু অনাথপিণ্ডদ এসব মণি মাণিক‍্য, স্বর্ণালঙ্কার, মূল‍্যবান বসন, এগুলির দিকে চেয়েও দেখছেন না। শ্রাবস্তী নগরীর লোকেরা এতকিছু দেবার পরেও কিন্তু কবি লিখছেন, সন্ন্যাসী ফুকারে লয়ে শূন‍্য ঝুলি..। আরো লিখছেন, রাজা ফিরে যাচ্ছেন, শ্রেষ্ঠী ফিরে যাচ্ছেন, তাঁদের মূল‍্যবান উপহারকে গ্রহণের যোগ‍্য বলেই মনে করছেন না অনাথপিণ্ডদ। কবি লিখেছেন, বিশাল নগরী লাজে রহে হেঁট আননে।
তাহলে প্রভু বুদ্ধের নাম করে কী যাচ্ঞা করতে ভোররাতে বেরিয়ে পড়েছেন বৌদ্ধ সন্ন‍্যাসী?
শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা কবিতায় একেবারে সূচনাতেই রচয়িতা জানিয়ে দিয়েছেন, অনাথপিণ্ডদ ভিক্ষা নেবার ছলে শ্রাবস্তীপুরীকে একটা উচ্চতর দার্শনিক অবস্থানে নিয়ে যেতে চাইছেন। মেঘমন্দ্রস্বরে তিনি হাঁকছেন, করো নিদ্রা দূর। কিন্তু তখনো তো ভোর হয়নি, নগরবাসী শয‍্যাত‍্যাগ করে সাংসারিক কাজে প্রবৃত্ত হননি। রাস্তা তখনো অন্ধকার। এ সময়টা তো সাধারণ জিনিস চাইবার নয়। অনাথপিণ্ডদ সেটা জানেন। তাই বলছেন, ওগো পুরবাসী, কে রয়েছ জাগি.. বলছেন, করো নিদ্রা দূর… বলছেন, জাগো, ভিক্ষা দাও। আর বলছেন, বর্ষার মেঘের কথা। তুলনা করছেন সেই মেঘের সঙ্গে। মেঘ কি করে? না, নিজেকে শেষ করে দিয়ে মাটিকে জলসিঞ্চিত করে, রসে ভরে দেয়। মেঘমন্দ্রস্বরে সেই কথা আনাথপিণ্ডদ শ্রাবস্তীবাসীকে শেখাচ্ছেন। বলছেন, ওই মেঘের মতো করেই প্রভুর উদ্দেশে তোমার সবসেরাটুকু উৎসর্গ করো। আর নাগরিক ঘুম ভেঙে মূল‍্যবান জিনিস উপহার দিতে এলে তা তিনি পথে ফেলে দিচ্ছেন। তাহলে কী যাচ্ঞা করছেন অনাথপিণ্ডদ?

মহাভিক্ষুক যে আসলে কী চাইবেন, তা কবিতার প্রথমেই যত্নশীল পাঠকের নজরে আসবে। অনাথপিণ্ডদের গলায় এক অদ্ভুত সুর। সে সুর কেমন? সে সাধারণ সুললিত মিষ্ট সুর নয়। সে যেন এক গভীর মন্দ্রস্বর, সে যেন মেঘ গর্জনের মতো। কবি “অম্বুদ নিনাদ” শব্দটি ব‍্যবহার করেছেন। সেই অদ্ভুত সুর যেন কৈলাস শিখর হতে ভেসে আসা ভৈরবের মহাসংগীত। এইখানে এক অসাধারণ কল্পচিত্র আঁকলেন রবীন্দ্রনাথ। কৈলাস শিখরে ভৈরবেশ্বর মহাদেবের বাস। তিনি সর্বত‍্যাগী সাধক কৃত্তিবাস। অনাথপিণ্ডদের গলায় যে সুর তাকে সেই ভৈরবের মহাসংগীতের মতো করে ভেবেছেন কবি। সেই সুর শুনে রাজা নিজের রাজ‍্যধনকে বৃথা ভাবছেন। গৃহী নিজের গৃহকর্মের আয়োজনকে তুচ্ছ ভাবছেন, শিশুকন্যা সেই সুর শুনে কাঁদছে, কিন্তু কেন কাঁদছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। আর নগরবাসী গতরাতে শয‍্যায় যে গার্হস্থ্য সুখ উপভোগ করেছিল, তাকে বাসিফুলের মালার মতো পরিত‍্যাজ‍্য মনে হল। কিন্তু শ্রাবস্তীবাসী তাঁদের মূল‍্যবান জিনিসগুলি থরে থরে তুলে দিয়েও অনাথপিণ্ডদের কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি যুগিয়ে উঠতে পারলেন না। সন্ন্যাসী পদব্রজে চলতে চলতে বিশাল শ্রাবস্তী নগরীর পথ ফুরিয়ে এল। এতক্ষণে রৌদ্র ফুটে উঠেছে। দেশ জেগে উঠেছে।
 সন্ন‍্যাসী নগরীর পথপরিক্রমা পূর্ণ করে নগরের প্রান্তে এক উদ‍্যানে একটি সমাজ পরিত‍্যক্তা নারীকে মাটিতে শুয়ে থাকতে দেখলেন। অত‍্যন্ত দরিদ্র মেয়েটি অনাথপিণ্ডদের বক্তব্য শুনেছেন। সাধুকে দেখে তাঁর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করেছেন। তারপর?
তারপর কবি লিখছেন,
অরণ‍্য আড়ালে রহি কোনোমতে/
একমাত্র বাস নিল গাত্র হতে/
বাহুটি বাড়ায়ে ফেলি দিল পথে/
ভূতলে।
এই নারী অত‍্যন্ত দীন। একটিই মাত্র মলিন ও জীর্ণ বসন দিয়ে কোনোমতে তিনি তাঁর নারীশরীরের লজ্জাটুকু আবৃত করেছেন। নারীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিজের আব্রু, সেই আব্রুকে সম্পূর্ণ বিপন্ন করে নিজের একমাত্র আচ্ছাদনখানি সন্ন‍্যাসীর কাছে উৎসর্গ করলেন। মেয়েটি সামনে আসতে পারলেন না। একটি গাছের আড়ালে কোনোমতে দাঁড়িয়ে নিজের ছিন্ন চীরখানি হাত বাড়িয়ে পথে ফেলে দিলেন।
মহাভিক্ষুক বুঝি এই চেয়েছিলেন। তিনি দুহাত তুলে উচ্ছ্বসিত আনন্দ প্রকাশ করলেন। এতক্ষণে বুঝি তাঁর ভিক্ষাযাত্রার নগর পরিক্রমা সফল হল। কবি লিখেছেন, মহাভিক্ষুকের পুরাইলে সাধ পলকে।
কবিতাটি পড়ে পণ্ডিতের দল বিতর্ক করেছিলেন। বিষয়টি তাঁদের অশালীন ও অসামাজিক বলে মনে হয়েছিল। তাঁরা বলেছিলেন, গায়ের একমাত্র কাপড়টুকু দিয়ে দিলে সে মেয়ে দিনের আলোয় নিজেকে আড়াল করবেন কি করে?

পণ্ডিতের দল এভাবে ভাবেন। যে অনাথপিণ্ডদ বহুমূল‍্য স্বর্ণালঙ্কার রত্নহার, মূল‍্যবান বসন ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখলেন না, তিনি তো আসলে অন‍্য কিছুর খোঁজে বেরিয়েছেন। অনেকেই গার্হস্থ্য জীবন ত‍্যাগ করে সংঘজীবনে আশ্রয় নেন। কিন্তু মনের ভিতর থেকে সংঘকে, ধম্মকে অবলম্বন করতে পারেন না। সংসারের বাইরে নতুন করে আরেকটা সংসার গজিয়ে ওঠে।
 মহাজীবনের অধিকারী অনাথপিণ্ডদ, প্রকৃত ধম্ম কী, সংঘ কেন, তা বোঝানোর জন‍্য‌ই এই অদ্ভুত ভিক্ষা সংগ্রহ করলেন। তিনি কী চাইছেন, নগরবাসী রাজা ও শ্রেষ্ঠীদের তা বোধগম্য হয় নি, কিন্তু তা স্পর্শ করেছে এক অন্তেবাসীকে। তার দেওয়া ভিক্ষাটি শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করে আহ্লাদ করতে করতে মনীষী মাথায় তুলে নিয়েছেন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।