জন্মদিবসে মনীষী স্মরণ || জর্জ বার্নার্ড শ ( ১৮৫৬ – ১৯৫০) || লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো তিনিও বলতে পারতেন অলীক কুনাট‍্য রঙ্গে মজে লোক…. নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়। কুড়িবছর বয়সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন, শুধুই লেখালেখি করে জীবন কাটাবেন। আর ১৮৭৯ সালে লিখে ফেললেন জীবনের প্রথম উপন‍্যাসটি। নাম তার ইমম‍্যাচুরিটি। যেমন নাম, তেমনই আদর জুটল উপন্যাসটির। একজন প্রকাশকও রাজি হলেন না ইমম‍্যাচুরিটি ছাপতে। পর পর উপন‍্যাস লিখলেন। একের পর এক ব‍্যবসায়িক ব‍্যর্থতা। ব‍্যর্থতা যেন তাঁর পিছু ছাড়ে না। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যান আইরিশ যুবকটি।
ভদ্রলোকের ছেলেই ছিলেন। যদি অবশ‍্য সরকারি কর্মচারীদের ভদ্রলোকের কোঠায় ফেলা যায়। পিতা জর্জ কার শ ছিলেন সরকারি কর্মচারী। তবু ঠিকমতো গুছিয়ে পড়াশুনা করে উঠতে পারলেন না। মা লুসিণ্ডা এলিজাবেথ শ ছিলেন অঘটনঘটনপটীয়সী মহিলা। বাপের বাড়ির জবরদস্তি থেকে বাঁচবেন বলেই একজনের গলায় মালা পরিয়ে দিলেন। জর্জ কার শ এর সাথে বিয়েটা আদৌ সুখের ছিল না। দুই দিদির কোলে তিনি একটি মোটে ভাই। মায়ের ছিল গানের নেশা। যুবকটি যখন মাত্র দশ এগারো বছর বয়সের বালক, তখন থেকেই বাড়িতে মায়ের গানের শিক্ষক জর্জ জন লী থাকতেন। তাঁর কাছে মা তালিম নিতেন। সেটা ১৮৬৬ সাল। তারপর সঙ্গীত শিক্ষকের হাত ধরে মদো মাতাল স্বামীকে ফেলে মা  ঘর ছেড়ে পালালেন। লণ্ডনে। সঙ্গে দিদিরাও। সেটা ১৮৭২ সাল।  বালকটি পড়ে রইল বাড়িতে।
পরে সেও গিয়ে জুটল মায়ের কাছে। সেটা ১৮৭৬ সাল। মায়ের রোজগার বলতে অনিচ্ছুক স্বামীর হাত থেকে যৎসামান্য খোরপোষ, আর গানের টিউশনি করে একটু আধটু। ওই ১৮৭৬ সালে কুড়ি বছরের যুবক, যাঁর খুব একটা গুছিয়ে পড়াশুনা করা হয় নি, তিনি স্থির করে ফেললেন, লেখকই হবেন। গোটা দুপুর আর বিকেল জুড়ে ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে বই টেনে নিয়ে এতোলবেতোল পড়া। রীতিমতো বামাচারী সাধনা। মায়ের কাছে থাকতে থাকতে সঙ্গীত নাটক ইত‍্যাদি নিয়ে আগ্রহ জন্মায়। তারপর সঙ্গীত ও নাটকের সমালোচনা করতে শুরু করলেন। প্রথমে মায়ের সঙ্গী জর্জ জন লী এর হয়ে হরনেট নামে কাগজে লিখতে হত। লী লণ্ডনে গিয়ে বদলে গেলেন। যে ভরসায় ঘর ছেড়েছিলেন লুসিণ্ডা এলিজাবেথ, তা অনেকটাই ভুল প্রমাণিত হল। এই অবস্থায় জর্জ নামটার প্রতিই ঘেন্না ধরে গেল কিশোরের। লীএর হয়ে লেখাতেও গ্লানি বোধ হচ্ছিল।  পরে আস্তে আস্তে পরিচিতি আর যোগাযোগ তৈরি হতে প্রথমে ১৮৮৮তে স্টার কাগজে, ১৮৯০তে ওয়ার্ল্ড কাগজে, ১৮৯৫তে স‍্যাটারডে রিভিউ তে লিখতেন ।
এর মধ‍্যে উপন্যাস লেখা চলছে। ১৮৮০ তে দ‍্য ইরর‍্যাশনাল নট, ১৮৮১তে লাভ অ্যামঙ দ‍্য আর্টিস্টস, ১৮৮২ তে ক‍্যাশেল বায়রণ’স প্রফেশন, ১৮৮৩তে অ্যান আনসোশ‍্যাল সোশিয়ালিস্ট,
সবগুলোই ছেপে বেরোতে সময় লেগেছিল অনেক। এই সময়েই কার্ল মার্কসের লেখালেখির সঙ্গে পরিচয় ঘটে যুবকটির। দাস ক‍্যাপিটাল পড়েন। কিন্তু রক্তপাত করে মুক্তি তাঁর ভাল লাগে নি। শুভবুদ্ধির বিকাশ ও সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সুস্থ দৃষ্টিভঙ্গির প্রচারের মাধ‍্যমে দিনবদলের স্বপ্ন দেখতেন। যুক্ত হলেন ফেবিয়ান সোশিয়ালিস্টদের সঙ্গে। তাদের হয়ে লেখালেখি, বক্তৃতা করে সময় কাটত অনেক। এই রকম বক্তৃতা করতে করতে কিভাবে কথার পিঠে কথা সাজিয়ে তুলতে হয় নিজেকে নিজে শিখিয়ে নিলেন। এই সমাজতন্ত্রীদের একটি কাগজ আওয়ার কর্ণারএ  কিস্তিতে কিস্তিতে ছেপে বেরিয়েছে তাঁর প্রথম দিকের উপন‍্যাসগুলি।
তাঁকে কিছুটা পয়সার মুখ দেখাল আর্মস অ্যাণ্ড দ‍্য ম‍্যান। সমালোচকরা নাক সিঁটকালেও দর্শকের মন কেড়ে নিয়েছিল নাটকটি। এর পরে তিনি আনলেন কাঁদিদা। এটা কিন্তু মঞ্চ কাঁপাতে পারল না। সেটা করল দি ডেভিলস অ্যাণ্ড ডিসাইপল। বেশ একটু রোজগার হতে লাগল লেখকের।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পিছনে স্বার্থের কালো ছায়া আর পুঁজির হিসাব নিকাশ টের পেয়েছিলেন তিনি। যুদ্ধ করে গরিবের কিছু মাত্র উপকার হয় না,  এই ছিল তাঁর বিশ্বাস। এই থেকেই যুদ্ধ বেধে যাবার আগে একটা গদ‍্য লিখলেন, কমন সেন্স অ্যাবাউট দ‍্য ওয়ার। জনমত লেখকের বিরুদ্ধে গেল। লেখক ভয় পেলেন না। যুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধবাজ শক্তিকে ধিক্কার জানিয়ে, সমসময়ের তিক্ততা ও হতাশাকে ভাষা দিয়ে লিখলেন হার্ট ব্রেক হাউস। এটিও জনমনোরঞ্জনে অক্ষম হল। ততদিনে স্থির বুঝে গেছেন বড় লেখকের কাজ নিজের কথাটুকু লিখে ফেলা। কোনো আপস নয়।
১৯২৫ সালে সাহিত্য বিষয়ে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জর্জ বার্ণার্ড শ। আইরিশ নাট‍্যকার শ ছিলেন সুরসিক। ১৯২৬ সালে আঠারো নভেম্বর তারিখে, বার্ণার্ড শ নোবেল সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণ করতে গিয়ে পুরস্কারের অর্থমূল্য প্রত‍্যাখ‍্যান করেন। এই বিপুল অঙ্কের টাকা প্রত‍্যাখ‍্যান করে  শ বলেন, “I can forgive Alfred Nobel for inventing dynamite but only a fiend in human form could have invented the Nobel prize.”
তাঁর বিখ্যাত কয়েকটি সৃষ্টি হল ম‍্যান অ্যাণ্ড সুপার ম‍্যান (১৯০২), পিগম‍্যালিয়ন (১৯১২) আর সেন্ট জোয়ান (১৯২৩)। এরমধ্যে পিগম‍্যালিয়ন এর চিত্রনাট‍্য লেখার জন্য তিনি ১৯৩৮ সালে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড বা অস্কার পেয়েছেন। তিনিই একমাত্র ব‍্যক্তিত্ব যিনি একই সঙ্গে নোবেল জয়ী ও অ্যাকাডেমি প্রাপক। এই মহান সাহিত্যিক ১৮৫৬ সালে ২৬ জুলাই আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরে জন্মেছিলেন। আর প্রয়াত হন চুরানব্বই বছর বয়সে গাছের ডালপালা ছাঁটতে গিয়ে মই ফসকে পড়ে গিয়ে, ১৯৫০ সালে নভেম্বর মাসের দুই তারিখে। জন্মেছিলেন ছাব্বিশ জুলাই, ১৮৫৬ সালের আজকের দিনে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।