শ্যামলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হিটলার! ১৯৩৬ সালে পঁচিশে অক্টোবর তারিখে জার্মানির অ্যাডলফ হিটলার আর ইটালির বেনিতো মুসোলিনি চুক্তি স্বাক্ষর করে অক্ষশক্তি গড়ে তোলেন। এর ভয়াবহ পরিণতি হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘনিয়ে ওঠে। হিটলার। এই সাংঘাতিক স্বৈরতন্ত্রী ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর তারিখে পোল্যাণ্ড আক্রমণ করে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করেন। অথচ লক্ষ্য করার বিষয় যে
হিটলার বা মুসোলিনি একলা পারেন নি। হিটলারের সাথে ছিল হিমলার। ছিল গোয়েরিং। গোয়েবলস্। সাথে ছিল ব্রাউন শার্ট, এস এস বাহিনী। আর ছিল তথাকথিত আর্যামির স্লোগান। জাতিবিদ্বেষ খুঁচিয়ে তোলার কৌশল। দেশপ্রেমের মিথ্যে চটক। বিরোধী শিবির ছিল ছন্নছাড়া। সোশিয়ালিস্ট আর কমিউনিস্ট, দুইপক্ষ একে অপরকে গাল দিতে ব্যস্ত। দুই পক্ষের সতীপনার লড়াইয়ে ফাঁকতালে নাৎসিপার্টি ক্ষমতা দখল করে নিল। ১৯৩৩ সালের জানুয়ারিতে হিটলার কে চ্যান্সেলর করে দিলেন প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবুর্গ। তারপর হিটলার ক্রমে হয়ে গেলেন ফুয়েরার।
একটা দেশের একটা বিরাট সংখ্যক মানুষকে জাতিগত পরিচয়ের কারণে তাড়িয়ে দেওয়া, যাকে বলে এথনিক ক্লিনজিং, সেটা একটা সাংঘাতিক ব্যাপার। শুধুমাত্র ইহুদি বলেই তাদের বিরুদ্ধে জাতিঘৃণা ছড়িয়ে ছিলেন হিটলার। নিজের জাতের মনগড়া শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারে হিটলারের দলবলের কোনো ক্লান্তি ছিল না। রক্তের বিশুদ্ধতা নিয়ে আগডুম বাগডুম বকতে বকতে লক্ষ লক্ষ ইহুদি নারী ও শিশুকে গ্যাস চেম্বারে ঠেলে দিতে তাদের বাধে নি। এই যে জাতি বিদ্বেষ, এটা সাংঘাতিক। সাংঘাতিক জাতিবিদ্বেষ আর উগ্র জাতীয়তাবাদে ভর করে হিটলার ইহুদিদের উপর ভয়ঙ্কর আক্রমণ নামিয়ে আনেন। বহুসংখ্যক ইহুদিকে পাঠানো হয় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। তাদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হত। তাদের উপর নানা বিকৃত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে শেষ অবধি গ্যাসচেম্বারে ঢুকিয়ে ইহুদি নিধন হত। অথচ এসব লুকোনো ছিল। তেমন কেউ জানতই না। ১৯৪২ সালে জুন মাসের প্রথম দিনে পোল্যান্ডের ওয়ারশ এর একটি ছোট কাগজ “লিবার্টি ব্রিগেড” হিটলারের এই সমস্ত কুকীর্তি ফাঁস করে দেয়। সারা পৃথিবীর শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিটলারকে মানবতার চরম শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন। একটি ছোট কাগজ হয়েও লিবার্টি ব্রিগেড দেখিয়ে দিয়েছিল সভ্যতা বাঁচানোর দায়িত্ব পালনে তারা সমর্থ। আমাদের দেশেও এলাহাবাদ হাইকোর্ট আর তারপর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ভি আর কৃষ্ণ আয়ার “নির্বাচনী নোংরামিতে ইন্দিরার হাত ময়লা” বলতে দ্বিধা করেননি।
হিটলার শেষ পর্যন্ত জেতে না। হিটলারির অবসান হয়। সাধারণ মানুষ যুক্তিসঙ্গত পথে ঐক্যবদ্ধ হলে হিটলারির অবসান ঘটে।হিটলারি জমানার সেই জাতিঘৃণা জার্মানিতে আজ পরাজিত। কিন্তু দেশে দেশে জাতিঘৃণা, জাতি অহমিকার কারবারি হিটলারি মানসিকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ জারি রাখতে হবে। অরিন্দমবাবু, আমি স্পষ্ট ভাবেই ইন্দিরার মৃত্যুর আবহাওয়ায় কংগ্রেসী গুণ্ডাদের শিখনিধনের প্রসঙ্গ টানছি। “ইন্দিরার হত্যাকারী একজন শিখ”, এমন ন্যক্কারজনক ভাষায় হেডলাইন করে হিটলারের জাতিঘৃণা ছড়িয়ে দিল একটা বড় বাজারী বাংলা সংবাদপত্র। কারোর ঠিকঠাক চোখ থাকলে হিটলারি কায়দার সাথে বাজারী বাংলা কাগজটার এই অপকীর্তির মিল চোখে পড়বেই।
শেষ অবধি জার্মানির বুকে হিটলারকে বাঙ্কারে ঢুকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়েছিল।
একটি সভ্যদেশে মানুষ নিজের কথা ভদ্রভাবে অন্যকে শোনাবে আর যুক্তিসঙ্গত সহমর্মিতার সাথে তার কথাটাও শুনবে – এই পরিসর বজায় রাখা সকলের দায়িত্ব।
অস্ত্রের হুঙ্কার নেহাতই অযৌক্তিক । অস্ত্র শেষ কথা বলে না। শেষ কথা বলে যুক্তি আর নৈতিকতা । বাংলা নাকি সারা দেশকে পথ দেখায়, আর বাংলার বিধান রায়ের মুখ্যমন্ত্রিত্ব কালে মেয়েদের প্রতিবাদ মিছিলে গুলি চলল। চারজন মেয়ে কলকাতার রাস্তায় গুলি বুকে নিয়ে শহীদ হলেন। সিদ্ধার্থশঙ্কর তো আরো জঘন্য। মুখ্যমন্ত্রী সেজে রুনু গুহনিয়োগীর মতো নোংরা পুলিশকে তোল্লাই দিয়ে গেছেন। ভয়ের কথা জ্যোতি বসুও ওই রুচির বাইরে পা ফেলতে চাইছেন না। এ যেন সেই বিক্রমাদিত্যের বত্রিশ পুতুল ওয়ালা সিংহাসন। গদিতে বসলেই স্লোগান চেঞ্জ, সুর চেঞ্জ। তবু বলব, শুভবোধে প্রগাঢ় আস্থা নিয়ে একটা সভ্যদেশের মানুষেরা কথা বলুক। মনে রাখুক অত্যাচারী শেষ কথা বলে নি কোনোকাল। শেষ কথা বলেছে মানুষের অন্তহীন শুভবোধ। হিটলারির জয়, শেষ অবধি নয়।
অনসূয়া বললেন, দ্যাখো, হিটলারের বদমাইশির সাথে কিন্তু মনে রাখতে হবে ভার্সাই চুক্তির কথা। একেবারে একতরফা কোনো কিছু হয় না।
অরিন্দম বললেন, প্যালেস্টাইন ক্রাইসিসের কথাও বলো।
অনসূয়া বললেন, আগেরটা আগে হোক! ভার্সাই চুক্তি না হলে হিটলারি আসতে পারে না। আর হিটলারের ইহুদি বিতাড়নের জন্য প্যালেস্টাইন ক্রাইসিস। মনে করে দ্যাখো, আর্চ ডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দকে খুন করা হল। ফার্দিনান্দ অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরির রাজ মুকুটের উত্তরাধিকারী। সার্বিয়ার একটা খুনে গুণ্ডা সেই রাজপুরুষ ফার্দিনান্দকে খুন করে বসল। তারও মাথায় চেপেছিল উগ্র জাতীয়তাবাদের ভূত। তারিখটা ১৯১৪ সালের আঠাশে জুন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সেই শুরু। আর গুণে গুণে তার ঠিক পাঁচ বছর পর জার্মানি আর মিত্রশক্তির মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হচ্ছে ভার্সাই প্রাসাদে। ফ্রান্সে। যদিও বাস্তবে যুদ্ধ বিরতি হয়েছিল ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বরে, তবু, শান্তি চুক্তির খসড়া তৈরি করতে ছটা মাস সময় গেল। জুনের শেষের দিকে ভার্সাই চুক্তি সই হবার পর, লীগ অফ নেশনস, তখনো ইউনাইটেড নেশনস অর্গানাইজেশন জন্মায় নি, তিনি জন্মাবেন ১৯৪৫ সালে, অক্টোবরের চব্বিশ তারিখে।
অরিন্দম অনসূয়াকে শুধরে দিতে চেয়ে বললেন, ১৯১৯ সালে অবশ্য লীগ অফ নেশনসও জন্মান নি। ১৯২০ সালের জানুয়ারির দশ তারিখে লীগ অফ নেশনস প্রতিষ্ঠা হয়। আর ১৯৪৬ সালের ওই জানুয়ারি মাসে তার খেল খতম। তারিখটা ছিল বিশে জানুয়ারি। ১৯১৯ সালে পারী পিস কনফারেন্সই কাজ করছে। পরে ওটাই হয়ে উঠল লীগ অফ নেশনস। হেড কোয়ার্টার হল জেনেভায়।
অনসূয়া বললেন, যাই হোক, তোর কথাই রইল। পারী পিস কনফারেন্সই সই। তো সেখানকার সচিবালয়ে চুক্তিপত্রটি রেজিস্টার্ড হল অক্টোবরের একুশে। চুক্তির আসল বিষয়টা ছিল জার্মানি আর তার দলবলের ওপর যুদ্ধের পুরো দায়ভারটা চাপানো। আর বিতর্কও উঠল ওই নিয়েই। ওই যে সব দোষ জার্মানির ঘাড়ে চাপানো, ওয়র গিল্ট কজ, ভার্সাই চুক্তিপত্রের আর্টিকেল ২৩১ এ ওটা আছে। জার্মানিকে তো নিরস্ত করতে নিরস্ত্র করা হল, তার উপরে অনেকটা জমি ছাড়তে বাধ্য করা হল, আর যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির বাবদে গুণাগার দিতে বলা হল। কম টাকা নয়, তখনকার দিনে ১৩২ বিলিয়ন গোল্ড মার্ক। তখনই ডলারের হিসেবে ওটা ছিল ৩১.৪ বিলিয়ন ডলারের মতো। আর স্টার্লিং পাউণ্ডের হিসেবে ৬.৬ বিলিয়ন।
অনসূয়া বললেন, এই মাপের শাস্তি দেওয়াটাকে বলে কার্থেজিনিয়ান পিস। রোম যেভাবে দমন করেছিল কার্থেজকে। সেটা ২০১ খ্রীস্ট পূর্বাব্দের কথা। মানে শত্রুর একেবারে মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে উল্টো গাধায় চাপিয়ে দূর করে দেওয়া। নাকালের একশেষ করা। ভার্সাই চুক্তি জার্মানিকে তাই করতে চাইল। অথচ চুক্তির রকম সকম দেখে কেইনস্ তখনই বলেছিলেন “হয়ে গেল!” ভার্সাই চুক্তিতে জার্মানিকে শাস্তি দেবার সূত্রে ওই কার্থেজিনিয়ান পিস কথাটা ওঁরই কয়েনেজ।
অরিন্দম বললেন, কেইনস্। জন মেনার্ড কেইনস্। খুব বড় মাপের অর্থনীতিবিদ। উনি ভার্সাই চুক্তির খসড়া তৈরির সময় ব্রিটিশ সরকারের অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন।
অনসূয়া বললেন, জানিস তো শ্যামলী, রাবণের চিতা বলে বাংলায় একটা কথা আছে। ও চিতা হু হু করে সর্বদা জ্বলে। ওর আগুন কখনো নেবে না। ওইজন্যে রাবণের রাণী মন্দোদরীরও সিঁথির সিঁদুর মোছে না। হিন্দু পুরুষের চিতার আগুন না নিভলে, তা বৌকে বিধবা বলে ঘোষণা করার প্রথা নেই। ভার্সাই চুক্তির ফলে জার্মানির হল তাই। রাম শূর্পনখার নাক কান কেটে নিতে কর্বুরদলের যা হয়েছিল।
অরিন্দম শ্যামলীকে বললেন, কর্বুরদল মানে রাক্ষসদল। মেঘনাদবধ কাব্যে মধুসূদন দত্ত লিখেছেন।
অনসূয়া বললেন, তা শোনো, ভার্সাই চুক্তির অপমানে আর লাঞ্ছনায় হু করে জ্বলে উঠল জার্মান জাত্যাভিমান। আহত নাগিনীর মতো ফুঁসে উঠল সুতীব্র হলাহল নিয়ে। ১৯২০ সালে জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এল নাৎসি বাহিনী। বীণ বাজিয়ে সাপ খেলাবেন ভেবেছিলেন আন্তন ড্রেক্সলার। তিনি পেশায় ছিলেন চাবিওয়ালা। তো চাবিওলার চাবি ছিনতাই হয়ে গেল হিটলারের হাতে। ন্যাশনাল সোশিয়ালিস্ট শব্দ হতে নাৎসি কথাটা উঁকি মারল। ওটাই পরিচিতি পেয়ে গেল। ঊনিশ শো একুশ সালের পার্টি কংগ্রেসে ৫৩৩ ইস্টু এক ভোটে ড্রেক্সলারকে গোহারান হারিয়ে হিটলার হলেন এনএসডিএপির চেয়ারম্যান। ওই একুশেই তৈরি হয়ে গেল ব্রাউন শার্ট বাহিনী। বিরোধীদের নৃশংস ভাবে খুন করতে যাদের চোখের পলক পড়ত না। ভেবে দ্যাখো, বাইশ সালের একত্রিশে অক্টোবর বেনিতো মুসোলিনি ইতালিতে ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি বানিয়ে ফেললেন। আর তেত্রিশের জানুয়ারি র শেষে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবুর্গ কে তুতিয়ে পাতিয়ে জার্মানির চ্যান্সেলর হলেন হিটলার। হয়েই রাইখস্ট্যাগে আগুন লাগানোর ছুতোয় বিরোধী নেতাদের ধরপাকড় শুরু।
শ্যামলী বলল, ঠিক যেন ইন্দিরা গান্ধী রেলমন্ত্রী খুনের শোকে জরুরি অবস্থা জারি করার অজুহাত পেয়ে গেলেন।
অনসূয়া বললেন, আমায় বলতে দে! জার্মানিতে একটা ইহুদি বিদ্বেষ ছিলই। শুধুমাত্র জার্মানি কেন, গোটা ইউরোপের সবখানেই কম বেশি ফল্গুধারার মতো ইহুদি বিদ্বেষ ছিল। সেটাকেই খুঁচিয়ে তুলল হিটলার। তার সাথে ভার্সাই চুক্তির অপমান মিশিয়ে কড়া চোলাই বানাল তারা। বিশ বছর যেতে না যেতেই হিটলার সেই আহত উগ্র জাতীয়তাবাদী অভিমানকে পুঁজি করে আবার যুদ্ধ বাধিয়ে দিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধল পয়লা সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯।
শ্যামলী বলল, আমাদের দেশেও একটা ফুরিয়ে যাওয়া, রাজনৈতিক ভাবে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া দলকে আবার ক্ষমতায় রাখার জন্য ইন্দিরার হত্যা ঘটানো হল। যেভাবে ইন্দিরার পর তার ছেলেকে কোথা থেকে উড়িয়ে এনে গদিতে বসিয়ে দেওয়া হল, ভয় হয়, এর পরিণতি কি! দূরদর্শনে যেভাবে ইন্দিরার অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠানকে হাইলাইট করা হল, তা রীতিমতো দুশ্চিন্তার ব্যাপার। দেশের গোয়েন্দাব্যবস্থাটি যদি এতই মজবুত, তাহলে খোদ শীর্ষনেতার বাড়ির প্রহরীরা মনে মনে কি ভাবনা পোষণ করছে জানার কথা আগেভাগে মনে এল না কারো?
অরিন্দম বললেন, চুপ, চুপ, আমাদের সামনে বলছ ঠিক আছে। এটা বাইরে বললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
শ্যামলী হতাশ স্বরে বলল, ওই তো, আমাদের মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার জিনিসটা অমনই ঠুনকো। সাজিয়ে তোলা কথার মালা।
এমন সময় ঝনঝন করে ফোনটা বেজে উঠল।
অরিন্দম ভ্রূ কুঁচকে বলল, এত রাতে কার ফোন?
অনসূয়া ধরতে যেতেই অরিন্দম বাধা দিলেন, এত রাতে কার না কার ফোন, দাঁড়া, আমি ধরছি। অনসূয়া তাঁকে জিব ভেঙিয়ে বললেন, রক্ষে করুন মশায়, একা মেয়েছেলে ঝি চাকর নিয়ে থাকি। সাথে আপনি আছেন, বাইরের লোক জানলে কেলেঙ্কারির একশেষ হবে।
অরিন্দম গম্ভীর মুখে বসে রইলেন।
ফোনের রিসিভারে করতল চাপা দিয়ে অনসূয়া শ্যামলীর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, রমানাথ ফোন করেছেন। কি বলব?
শ্যামলী হাত নেড়ে আপত্তি জানালো। এত রাতে কথা বলব না।
অনসূয়া ফোনে রমানাথের উদ্দেশে বললেন, শ্যামলী লাইব্রেরি ঘরে পড়ছে। সামনে পরীক্ষা।
অরিন্দম শ্যামলীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, প্রয়োজনে সব্যসাচী সত্য সৃষ্টি করছেন। পথের দাবীতে পড়েছ না?
শ্যামলীর ভাবান্তর হল না। মুখে একটা রাগতভাব ঝুলে আছে।
অনসূয়া আবার রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে শ্যামলীকে বললেন, একটা মিনিট কথা বলতে চান। লক্ষ্মীটি, একটু কথা বলে নে।
শ্যামলী ফোন ধরতে উঠে যায়। অরিন্দমের চোখে পড়ে রাতপোশাকের নিচে তার নারীত্ব জাগ্রত। রক্তকরবীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বড়ো আর্টিস্টিক করে বলেছিলেন চলার ছন্দে ছন্দে নন্দিনীর ধানী রঙের শাড়ি লহর তুলতে থাকে।
অনসূয়া অরিন্দমের দিকে চোখ টিপে বলেন, এই যে মিস্টার, ওঁদের মধ্যে কি কথা হচ্ছে, আপনি কিন্তু কানে নেবেন না। শ্যামলী দেবীর প্রাইভেসি বোধ খুব শার্প।
শ্যামলী খুব নিচু স্বরে বলল, আমি হোস্টেলে জায়গা পেয়েছি। আগামীকাল সকালে শিফট করব। আজ রাতের জন্য এখানে আশ্রয় পেয়েছি।
ওপার থেকে কোনো প্রস্তাব এল। শ্যামলী বলল, এখন সামনে পরীক্ষা। এখন না। এখন না।
অনসূয়া উঠে গেলেন। শ্যামলীর থেকে রিসিভার চেয়ে নিয়ে বললেন, রমানাথ বাবু, কাল আর্লি মর্ণিঙে আমাদের গরিবখানায় আপনার চায়ের নেমন্তন্ন। প্লিজ আসুন। দেখা আর গল্প সব করিয়ে দেব।
ফোন রেখে অনসূয়া ফিরে আসতে শ্যামলী বলল, এটা কি করলেন দিদি? কাল সকালে আসতে বলে দিলেন? কাল যে আমার ক্লাস আছে। আবার শিফটিং করতে হবে!
অনসূয়া বললেন, যে রকম কাকুতি মিনতি করছিল, মায়া হল রে। তোকে খুবই ভালবাসে।
শ্যামলী অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের জল আড়াল করার চেষ্টা করে। পারে না। মুক্তোর ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়ে।
অনসূয়া হিসহিস করে বলেন চুমু খাবার সময় মনে ছিল না মুখপুড়ি?
শ্যামলী বলল, উনি যে বলছেন, ঘরভাড়া নিয়ে ফেলেছেন, আর একসাথে থাকতে চাইছেন।
অরিন্দম বললেন, সে কি, এতবড় একটা ডিশিসন এত হড়বড় করে করে ফেললে কি করে হবে?
অনসূয়া ছদ্মধমকের সুরে তাঁকে বললেন, দ্যাটস নান ইওর বিজনেস। ওরা কি করবে, ওদের বুঝতে দাও।
আবার ফোন বাজল। অনসূয়া উঠে শান্ত গম্ভীর স্বরে বললেন, রমানাথবাবু, এত রাতে ফোনে কোনো বিতর্ক আমি চাইছি না। কাল খুব ভোরে চলে আসবেন। শ্যামলী চা বানিয়ে খাওয়াবে। আসবেন কিন্তু। আর অনেকগুলো শাদা শাদা ফুল কুড়িয়ে আনবেন। গুড নাইট।
শ্যামলী ডিভানের উপর মুখ নিচু করে বসে আছে। অরিন্দম তার উলটো দিকে সোফায়। অনসূয়া নিজের আরাম কেদারা হতে উঠে এসে শ্যামলীর পাশে বসে তার পিঠে হাত রাখলেন। শ্যামলী অনসূয়ার বুকে মুখ রাখল।
অরিন্দম সোফার উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন।
ঘড়িতে টং করে একটা বাজল। ঊনিশ শো চুরাশি সাত নভেম্বর চিরতরে বিদায় নিয়েছে একঘণ্টা হয়ে গেল।