দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২৩৩)

পর্ব – ২৩৩

অরিন্দম সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। নিচু গলায় কে ডাকছে, অরিন্দম, অরিন্দম, আমাদের বাগানের কাঁচা আম, থেঁতো করেছি, খাবি? না বললে ঠোঁট ফুলিয়ে কষ্ট পাচ্ছে। অরিন্দম, আমার বাবা আমাকে একটা সাইকেল এনে দিয়েছে। কিন্তু এটা তোর আর আমার দুজনের। অরিন্দম, অরিন্দম, জানিস সুরথ নামে একটা রাজা আর সমাধি নামে বৈশ‍্য, মানে ব‍্যবসায়ী, প্রথম দুর্গাপুজো করে ছিল। মেধা মুনি বুদ্ধি দিয়েছিল। দুর্গাপুজো করলে বিপদ কেটে যায়। তাই জন্যে তো রাম দুর্গাপুজো করল। তখন অবশ‍্য লক্ষ্মী সরস্বতী চ‍্যাং ব‍্যাং কেউ ছিল না। একা দুর্গা। অরিন্দম অরিন্দম, রাম রাবণের যুদ্ধ করবি? আমি রাম হব। তুই রাবণ। তোকে হেরে যেতে হবে কিন্তু। একি, তুই হারছিস না কেন? তোকে তো হারতে হয়।
বালিশ ফেটে ঘরময় তুলো ছড়িয়ে পড়েছে। জজসাহেব কাণ্ড দেখে থ।
গায়ে একটা কম্বল চাপিয়ে দিচ্ছে কেউ। শীত করছিল। শ‍্যামলী হাসছে। আপনাদের জন‍্য নতুন পাঞ্জাবি পাজামা। পরে শোবেন। আর তোয়ালে। স্নান করতে কাজে লাগবে। এই হাতব‍্যাগে টুথব্রাশ টুথপেস্ট সেভিং সেট আছে। নিজেই বলছে, অসুবিধা হবে না। পরদিন ভোরবেলা ফার্স্ট ট্রাম বেরিয়েছে। প্রবাল শ‍্যামলীর একটা হাত ধরেছে। শ‍্যামলীর কোনো আপত্তি নেই। হাসছে। অরিন্দমের ওই নরম হাতটা ধরতে ইচ্ছে করছে। ধরল। শ‍্যামলীর কোনো আপত্তি নেই। হাসছে।
কম্বলটা ভাল। খাঁটি উলের কম্বল পাওয়া যায় কলকাতায়। হরলালকার দোকানে। বড়বাজারে লাল ইমলি দোকানের কম্বল‌ও ভাল। কাশ্মীর থেকে শাল‌ওয়ালারা এসে পড়েছে। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে শাল বিক্রি করছে। কাশ্মীরে ভেড়াওয়ালারা সারা গরমকাল পাহাড়ের উঁচু জায়গায় ভেড়াদের ঘাস খাওয়ায়। শীতে নেমে আসে। ভেড়ারা কি রকম একটুখানি জায়গা দিয়ে চলতে পারে। কাশ্মীরে ছাগলগুলোও বড়সড়। বাবা আর জজসাহেব দুজনের পরিবার একসাথে কাশ্মীরে গিয়েছে। ডাল লেকে হাউসবোটে আছে দুটো পরিবার। বাবা বলছেন আমাদের দেশে প্রতিটি মেয়েরও একটা করে নিজস্ব নৌকা থাকত। অনসূয়াটা বোকার মতো জিজ্ঞেস করছে, নৌকা কেন? ধুর বোকা, চারদিকে জল যে। নৌকো করে স্কুলে যাও, নৌকা করে বাজারে যাও, ইলিশের নৌকা আসে। হেই কুবির, মাছ কিবা! কপিলা জলে নেমেছে। মাঝি, আমায় ধরো ক‍্যান, কলস ধরো।
কোথায় পাবো কলসি ক‌ইন‍্যা, কোথায় পাবো দড়ি,
তুমি হ‌ও গহীন গাঙ, আমি ডুইব‍্যা মরি।
অপু জিজ্ঞেস করছে, রাণুদি, তোরা চলে যাবি? আর আসবি না? বালিকাটি তাকে জিজ্ঞাসা করছে, একি, খুঁটেছিস কেন? খুঁটতে নেই। একদম খুঁটবি না। সে বলছে, ভেতরে কি একটা থাকে। সাদা নরম। চাপ দিলে বের হয়ে আসে। বালিকা বলে, না, খুঁটতে নেই। মুখে দাগ হয়ে যায়।
বাগানে হনুমানের দল নেমেছে। টপাটপ জামরুল ছিঁড়ে মুখে পুরছে। ও মা, অরিন্দম, তুই কিছু করবি না? এই দ‍্যাখ, আমার বুক ধড়াস ধড়াস করছে। বালিকার বুকে বেলকুঁড়ি। নরম জিনিসটা শক্ত হয়ে গেল। অরিন্দম জানিস, মা বলেছে আর কদিন বাদেই আমি বড় হয়ে যাবি?
তুই একলাটি বড় হবি অনু? আমিও তো হব। বালিকা হেসে বলে, ধুস্, তুই তো ছোটো থাকবি। তুই যে আমার চেয়ে ছয়মাসের ছোটো। সব সময় তুই ছোটো থাকবি।
বাবা দামি শাল পরিয়ে দিচ্ছেন জজসাহেবকে। আমাদের যখন এক‌ই জায়গায় বাড়ি, দেখা হবেই, কি বলেন?
জজসাহেব হাসছেন। কি জানেন, মনের মিলেই মানুষ মানুষকে কাছে টানে। ন‌ইলে ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই। ইংরেজ দেশভাগ করতেই পারত না, সাহস‌ই করত না, যদি আমরা না চাইতাম। মানুষ যদি এক থাকতে চাইত, কে তাদের আলাদা করতে পারত?
ডিভানে শ‍্যামলী ঘুমোচ্ছে। তাকে জড়িয়ে ধরে অনসূয়া ঘুমোচ্ছে। ঘুম জড়ানো চোখে পাশ ফিরে দেখেন। ওরা দুজনে মিলে একটা বড়ো কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছে। কলকাতার হোটেলে তার মনে হয়েছিল, এই তো মাত্র একটা দেয়াল। দেয়ালের ওপারে শ‍্যামলী শুয়ে আছে। আর এখানে দেয়াল নেই। অনসূয়ার কোল ঘেঁষে শ‍্যামলী ঘুমোচ্ছে। ঘরে হালকা নীল আলো। আস্তে আস্তে উঠে বাথরুম গিয়ে হালকা হলেন। তারপর ঘরে এসে ফ্লাস্ক থেকে জল বের করে খেলেন। অনসূয়া গুছিয়ে রেখেছিল। শীতের দিনে ঠাণ্ডা জল খেতে কষ্ট হতে পারে। ফ্লাস্কে হালকা গরম আছে। খেতে অসুবিধা হল না।
কফি হাউসে ডাকল অনসূয়া। তখন কলকাতায় ও আইন নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়ছে। অরিন্দম দিল্লিতে যাবে। সেখানে পড়বে। কফিহাউসে বসে অনসূয়া বলল, আমি তোকে বিয়ে করব।
অরিন্দম বলেছিল, তার মানে? মেয়েরা বিয়ে করে নাকি? তাদের তো বিয়ে হয়।
অনসূয়া বলেছিল, বাজে কথা রাখ্। তোকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করে আমি সুখী হব না। তোকেই আমি বিয়ে করব।
অরিন্দম বলেছিল, তা হয় না।
হিসহিস করে অনসূয়া বলেছিল, কেন হয় না?
অরিন্দম বলেছিল, আমার কেরিয়ার তৈরি করতে হবে। আমি এখন বিয়ে করার কথা ভাবছি না।
অনসূয়া বলল, তোকে আমি খাওয়াতে পারব। কেরিয়ার কর্, আপত্তি নেই। বিয়েটা করে রাখি।
অরিন্দম বলল, কি যে বলিস না, ভাল লাগে না। বৌয়ের পয়সায় বর খায়?
অনসূয়া বলল, আইনে কোথায় বলা আছে, বৌ বরকে খাওয়াতে পারবে না? আমি তোর বৌ হব।
অরিন্দম বলেছিল, তা হয় না।
অনসূয়া কাতর চোখে তাকিয়ে বলেছিল, কেন রে?
নিষ্ঠুরের মতো অরিন্দম বলেছিল, আমি তোর থেকে ছয়মাসের ছোট না?
অনসূয়া প্রতিবাদ করেছিল। ছমাসের ছোটটা কি আদৌ ছোট? এটাকে তুই এত ইমপরট‍্যানস দিচ্ছিস কেন?
অরিন্দম বলেছিল, আমার মন সায় দিচ্ছে না।
সেই রাতেই ট্রেন ধরে দিল্লি চলে গিয়েছিল অরিন্দম।
তারপর থেকে মাঝে মাঝেই তাড়া করেছে অনসূয়া। এই অরিন্দম, তোকে আমি বিয়ে করব।
ঘুম ভেঙে মুখে চোখে জল দিয়ে ঠাণ্ডা করেছে অরিন্দম।
কঠিন হয়ে বলেছে, তুই বয়সে বড়। তুই বিয়ের পর আমাকে মানতে চাইবি না। এই বিয়েতে অশান্তি হবে।
অনসূয়া কেঁদে ফেলে বলেছে, দেখবি আমি খুব ভাল বৌ হব। তোকে খুব আদর করব। আমি তোকে ছাড়া ভাবতে পারি না।
চতুর্দিক ভীষণ শান্ত। শুধু ঘড়ির কাঁটা বলে চলেছে, ঠিক ঠিক ঠিক।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।