• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১০)

আমার কথা

৩৭
আমাদের এই যে নীল গ্রহ পৃথিবী এর গঠনটা ঠিক কেমন, কেমন ভাবে কত বেগে চলছে এই গ্রহ, আর কাকে ঘিরে ঘুরছে সে, এ নিয়ে এখন আমাদের মনে আর কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু একদিন এই সহজ সরল কথাগুলি বলবার জন্য মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। জেলখানায় নিপীড়িত হতে হয়েছিল। ধর্মের নাম করে সাংঘাতিক ত্রাস ছড়িয়ে রাখা হয়েছিল। বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে কোনোদিন ধর্মধ্বজীরা ভালো চোখে দেখে নি। এই ত্রাস যে কী ভয়ানক ছিল নিজের মৃত্যু দিয়ে কোপারনিকাস তা প্রমাণ করে দিয়ে গিয়েছেন। ১৫৪৩ সালে ২৪ মে তারিখে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যু শয্যায় তাঁর গবেষণা সঞ্জাত উপলব্ধির কথায় সমৃদ্ধ পুস্তক দ্য রেভোল্যুশনিবাস অরবিয়াম কোয়েলেস্টিইয়াম De revolutionibus orbium coelestium (On the Revolutions of the Celestial Spheres), প্রকাশ পায়।

৩৮
পুলিশ সম্পর্কে লাঠিচার্জ নিয়ে অভিযোগ আজ নতুন নয়। বাম আমলে ভাষা নিয়ে আন্দোলনে বাসভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রীদের উপর লাঠি চলতে দেখেছি। মানুষ বাঁচার লড়াই গড়লে, সেটা যাঁরা ক্ষমতায় আসীন, তাঁদের ছক অনুযায়ী না হলে, গোঁসা হবেই। বাম আমলে হত, এখন না হবার কারণ নেই। আগামী দিনেও হবে। রাষ্ট্রের একটা শ্রেণীচরিত্র থাকে। সেই শ্রেণীবিভক্ত সমাজ থাকবে, শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে পার্টিরাজ থাকবে আর পুলিশের হাতে লাঠি থাকবে না , এ একেবারে দিনে দুপুরে গাঁজায় দম না দিলে বলা যায় না। দুষ্টু লোকে বলে ক্যাডারের পিঠে লাঠি পড়লে সেই অনুপাতে পার্টির পলিটিক্যাল মাইলেজ বাড়ে। অবিশ্যি পুলিশের খারাপ কাজের প্রতিবাদ করতে হয়। নইলে লোকের কাছে মান বাঁচে না। তবে প্রমোদ দাশগুপ্ত একবার বলেছিলেন পুলিশের বন্দুকে কি কনডম পরানো ছিল? মনের কথা বেশ চাঁছা ছোলা ভাবে বলার শিক্ষা তাঁর ছিল।

৩৯
মানুষের শরীর, সে যে মানুষের নিজস্ব প্রচেষ্টায় তৈরী। সেই মানব শরীরকে খুঁটিয়ে না জানলে কি করে তার চিকিৎসা পদ্ধতি বের হবে? অথচ ধর্মীয় অভ্যাস মতে, আর ধর্মনেতাদের নির্দেশে মানুষের মরদেহ কাটা ধর্মবিরোধী। তাই গোটা মধ্যযুগে লুকিয়ে লুকিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা কবর খুঁড়ে টাটকা মৃতদেহ দেখে রাত জাগতেন।
আমাদের দেশেও অন্যথা হয় নি। সব কুসংস্কার বর্জন করে কলকাতায় প্রথম লাশ কাটলেন মধুসূদন ঘোষাল। যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমুখী এই কাজকে তোপধ্বনি দিয়ে সম্মান করেছিল সেদিনের ব্রিটিশ ভারত।
আজও বিস্তর পথ চলা বাকি। মরণোত্তর দেহ দান করে মানুষের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসুন সকলে।

৪০
আমার বাবার মৃত্যু হয়েছিল ২০১২ সালের ১২ জানুয়ারি। আমার মায়ের সমর্থনে আমরা ভাইবোনেরা মিলে তাঁর মরণোত্তর দেহ দান ও চক্ষুদান করি। দু দিনের মধ্যে দিশা চক্ষু হাসপাতালের সার্টিফিকেট এল, আমার বাবার চোখের কর্ণিয়া কাজে লাগিয়ে দুজন মানুষ দৃষ্টি ফিরে পেয়েছেন, তখন খুব ভাল লেগেছিল।
মনে হয়েছিল মরণ হতে যেন জাগি…
আজকের বাংলায় আমরা খুব সহজেই পার্থিব মানবতাবাদী জীবন যাপন করতে পারি। এর পথটা গড়ে দিয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়। ১৭৭২ মতান্তরে ১৭৪৪ সালের ২২ মে তারিখে তাঁর জন্মদিন।
রাজার প্রতি প্রণত শ্রদ্ধা।
প্রবর্তক নিবর্তক সম্বাদ ইত্যাদি কথোপকথন রীতিতে সংবাদ পত্রে তিনি সামাজিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা চালিয়ে একদিকে যেমন দেশজোড়া জড়ত্ব কে ধাক্কা দিয়ে যুক্তিশীল, ইহমুখী চিন্তার বিকাশ ঘটাতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তেমনি, বাংলা ভাষায় যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা সম্ভব, এটাও তিনি হাতে কলমে করে দেখান।
ভারতীয় সমাজে বিস্তর ধর্মীয় গোষ্ঠী রয়েছেন, আর তাঁদের যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি রয়েছে। এটাও ঘটনা যে এদেশে ইতিবাচক অর্থে নাস্তিকের চাইতে ধর্মভীরু লোকের সংখ্যা বহুগুণ বেশি। আমি ধর্মধ্বজী ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের কথা বাদই দিলাম। তাই ধর্মের ভিতরের কথাটা জেনে, ধর্মে ধর্মে প্রাণসত্ত্বায় যে মৌলিক বিভেদ নেই, এটা দেখিয়ে দেওয়া বড় মানুষের দায়িত্ব। যাঁরা কেবল শুষ্ক কাষ্ঠ পণ্ডিত, তাঁদের পক্ষে গণ্ডগোল পাকানো সম্ভব। কিন্তু সুস্থ সমন্বয় করতে কিছুটা হৃদয় আর প্রতিভা লাগে। রাজা ছিলেন সেই হৃদয়বান প্রতিভাধর পণ্ডিত।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।