ঊনিশ বছরের একটা মেয়েকে থামে বেঁধে পুড়িয়ে মারছে সভ্যতা। পুড়িয়ে মারছে চার্চের ক্ষমতা। মেয়ে অবিচল। মরণের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়ে ধর্মীয় বিচারকদের নির্দেশ দিচ্ছে, আমার সামনে পবিত্র ক্রশ রাখো।
মেয়েটাকে পোড়ানোর দায়িত্ব যার কাঁধে ছিল, সেই জিওফ্রয় থেরেজ ভীষণ রকম ভয় পেয়েছিল। পরবর্তীকালে অনেক হাহুতাশ করেছিল, আমি একটা পবিত্র মানুষকে পুড়িয়ে মারলাম গো!
ফ্রান্সের ডমরেমি গাঁয়ের ঊনিশ বছরের চাষি মেয়ে দৈবাদেশ পেয়েছিল, তোমাকে স্বদেশভূমির তরে যুদ্ধযাত্রা করতে হবে। মাতৃভূমি করে আহবান।
ইংল্যাণ্ড আর ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল। সংঘাত বেধেছিল ফ্রান্সের রাজমুকুট কার মাথায় থাকবে, সেই নিয়ে। উত্তরাধিকারী কে? যুদ্ধ বেধেছিল ১৩৩৭ সালে। ইতিহাসে তার নাম শতবর্ষের যুদ্ধ। যুদ্ধ শুরুর পঁচাত্তর বছর পরে ১৪১২ সালে ডমরেমি গ্রামের মণ্ডল মশায়ের মেয়ে জোয়ানের জন্ম। গেঁয়ো নিরক্ষর মেয়ের মনে হয়েছিল তাকেই যুদ্ধ করে দেশ বাঁচাতে হবে। কেননা তার স্বপ্নে এসে কথা কয়ে গিয়েছিলেন আর্ক অ্যাঞ্জেল সেন্ট মাইকেল, সেন্ট মার্গারেট, আর আলেকজান্দ্রিয়ার সেন্ট ক্যাথারিন। তেরো বছরের মেয়ে বাপের বাগানে বসে দিব্যদৃষ্টিতে আকাশমার্গে সন্তদর্শন করে নির্দেশ পেয়েছিল। বছরের পর বছর ধরে লোকের মুখে মুখে ভেসে বেড়াত একটাই কথা। দূর অজ পাড়া গাঁ থেকে একটা মেয়ে উঠে আসবে। সেই বাঁচাবে ফ্রান্সকে। জোয়ানের মনে হল, আমি সেই মেয়ে। সে কাছের মানুষদের বলল, নিয়ে চলো আমাকে রাজার কাছে। সন্তরা আমাকে বলে গেছেন রাজা সপ্তম চার্লসের পাশে দাঁড়াতে।
দিনের পর দিন মাতৃভূমি ফ্রান্সের ভূখণ্ড হাতছাড়া হয়ে যেতে থাকে। প্যারিস হাতছাড়া হয়ে গেছে। রুঁয়ে হাতছাড়া হয়ে গেছে। গেঁয়ো মেয়ে জোয়ান ভাবে কবে তার সঙ্গে রাজার দেখা হবে। রাজার হয়ে সে যুদ্ধে যাবে। দেশমাতৃকার হৃতসম্মান পুনরুদ্ধার করবে।
এক আত্মীয়কে ধরে করে কোনোমতে কাছের শহরটায় পৌঁছতে পেরেছিল জোয়ান। তখন সে ষোড়শী বালিকা। শহরে ছিল একটি দুর্গ। জোয়ান দুর্গাধিপের কাছে আবেদন করল, তাকে যেন রাজার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সে নিজে রাজাকে বাঁচাতে যুদ্ধে না নামলে রাজার আর কোনো আশা নেই। ষোলো বছরের মেয়ের মুখে এমন বাগবিন্যাস শুনে দুর্গের অধিপতি ফুঃ ফুঃ করে উড়িয়ে দিলেন। তবুও জোয়ান আশা ছাড়ল না। শেষ পর্যন্ত সতেরো বছর বয়সে রাজার বাড়ি ঢুকতে পেল জোয়ান। ফ্রান্সের রাজা সপ্তম চার্লস তখন শিনন শহরে রাজদরবার করেন। রাজ দরবারে পৌঁছে জোয়ান রাজাকে বলল, আমি আপনার সাথে একান্তে একটু কথা বলতে চাই। একান্তে তার সাথে কথা বলে রাজা প্রসন্ন হলে। চলল মেয়ে রণে চলল।
আকাশ থেকে চতুর্দশী চাঁদ অকৃপণ আলো ঢালছে। শ্যামলী মনশ্চক্ষে দ্যাখে, বর্ম পরা ঘোড়ায় চড়া একটা মেয়ে তরোয়াল উঁচিয়ে এগিয়ে চলে।