• Uncategorized
  • 0

|| আলোর দিশারী বিজ্ঞানসাধক আইজ‍্যাক নিউটন || লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

আলোর দিশারী বিজ্ঞানসাধক আইজ‍্যাক নিউটন

আজ মহাবিজ্ঞানী আইজ‍্যাক নিউটনের প্রয়াণদিবস। ১৭২৭ সালে পঁচাশি বৎসর বয়সে নিউটনের জীবনাবসান হয়। যে সকল বিজ্ঞানীর ভাবনাপদ্ধতি মানব সভ‍্যতার বিকাশের পথে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করেছে, আইজ‍্যাক নিউটন তাঁদের মধ্যে সবচাইতে উজ্জ্বল একটি নাম। পদার্থ বিজ্ঞান, বলবিদ‍্যা, গণিত, জ‍্যোতির্বিজ্ঞান, এমনকি অর্থনীতি, জ্ঞান জগতের কোণে কোণে তাঁর দৃপ্ত পদচারণা।
নিউটন যখন জন্মেছিলেন, সেদিন তারিখটি ছিল পঁচিশ ডিসেম্বর, ১৬৪২। পরে ক‍্যালেণ্ডারের সংশোধন করা হলে তারিখটি দাঁড়াল ০৪ জানুয়ারি, ১৬৪৩। আজ নিউটনের প্রয়াণদিবস। ১৭২৭ সালে ৩১ মার্চ তারিখে তিনি প্রয়াত হন।
১৬৬৯ সাল থেকে ১৭০২ সাল পর্যন্ত নিউটন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের লুকাসিয়ান প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৬৮৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বিখ্যাত ব‌ই ফিলজফিয়া ন‍্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম‍্যাথমেটিকা। আর ১৭০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আলোকসংক্রান্ত বিপুল গবেষণা সংকলন অপটিকস।
আলোর ধর্ম ও চারিত্র‍্য এবং ভারাকর্ষণের নিয়ম এর পরবর্তী যুগে পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় খুব বড় ভূমিকা নিয়েছে। বিশ্বনিয়ম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
নিউটনের সমাধিলিপি বা এপিটাফ লিখেছিলেন ইংরেজ কবি আলেকজান্ডার পোপ। সেটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করলে শোনাবে, “বিশ্বনিয়ম ঢাকা ছিল অন্ধগহনতলে/নিউটনের আবির্ভাবে উঠল আলো জ্বলে।”
 মহাকর্ষ বা ভারাকর্ষণের তত্ত্ব এবং গতিবিদ‍্যা নিয়ে নিউটনের অবদান অনেকেই ছোটবেলা থেকে জানেন।কিন্তু আলোক নিয়েও তাঁর গবেষণার সুদূরপ্রসারী ফল রয়েছে। ১৬৬৬ খ্রীস্টাব্দে নিউটন লক্ষ করেছিলেন, একটি প্রিজমের মধ‍্যে আলোকরশ্মি প্রবেশ করলে তা ভিন্ন ভিন্ন কোণে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের আলোকরশ্মি হিসেবে প্রতিসরিত হয়। এ থেকে নিউটন ধারণা করলেন যে বর্ণ বা রঙ জিনিসটা আলোর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।
 যাতে বিভিন্ন বর্ণের আলোর ভিন্ন ভিন্ন মাপের প্রতিসরণের জন‍্য গবেষণার ক্ষেত্রে ভ্রান্তি না দেখা দেয়, তার জন্য ১৬৬৮ সালে নিউটন নিজের মনের মতো একটি প্রতিফলক দূরবিন বানিয়েছিলেন। ১৭৭২ সালে তাঁর তৈরি দ্বিতীয় দুরবিনটি তিনি রয়‍্যাল সোসাইটিতে দান করেন।
 নিউটন বলেছিলেন, আলো কতকগুলি কণা বা করপাসলের যোগে তৈরি। এই কারণে আলো লঘুতর মাধ‍্যম থেকে কোনো ঘনতর মাধ্যমে প্রবেশ করলে তা ভিন্ন ভিন্ন রঙের ছটায় ভেঙে গিয়ে প্রতিসরিত হয়।
 অবশ‍্য ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস (১৪.০৪.১৬২৯ – ০৮.০৭.১৬৯৫) ১৬৭৮ সালে প‍্যারিসের সায়েন্স আকাদেমিতে আলোকের তরঙ্গ তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা পাঠিয়েছিলেন। ১৬৯০ সালে হাইগেনস এর আলোকসংক্রান্ত গবেষণার ব‌ই বেরোলো ট্রেইট দে লা লুমিয়ের। হাইগেনস  বলেছিলেন, আলো তরঙ্গ হিসেবে চলে। হাইগেনস নিউটনের থেকে বয়সে চৌদ্দ বছরের বড় ছিলেন। নিউটন হাইগেনস এর তত্ত্ব মানলেন না। জোর দিয়ে বললেন, আলো কণা আকারে চলে। কিন্তু নিউটনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ছিল হাইগেনস এর তুলনায় অনেক বেশি। সে সময় আলো সম্পর্কে লোকে নিউটনের কণাতত্ত্বকে মান‍্যতা দিয়েছিল। হাইগেনস এর তরঙ্গ তত্ত্ব গুরুত্ব পায় নি। পরে দুই তত্ত্বের সমন্বয় ঘটান অগাস্টিন জাঁ ফ্রেসলেন এবং টমাস ইয়ুং।
আলোর কথা বলি। আলো দিয়ে যে মহাজাগতিক হিসেব নিকেশ করা যায়, তা দেখিয়েছিলেন প্রাচীন গ্রীকবিজ্ঞানী এরাটোস্থেনিস। তিনি মিশরের বিখ‍্যাত আলেকজান্দ্রিয়া নগরীতে বসবাস করতেন। আলেকজান্দ্রিয়া থেকে বেশ কিছু দূরে আরো একটি বিখ‍্যাত জনপদ ছিল সাইন। এরাটোস্থেনিসের কানে গিয়েছিল যে বছরের কোনো একটি দিনে মধ‍্যদিনের সূর্যালোক সাইন নগরীর একটি গভীর কূপের একেবারে তলদেশে পৌঁছায়। কিন্তু ঠিক ওই তারিখে কখনোই আলেকজান্দ্রিয়ার কোনো কূপের তলদেশে সৌর আলোক পৌছয় না।
যেদিন সাইন নগরীতে সৌর আলো কূপের একেবারে তলদেশে পৌঁছে যাচ্ছে, সেদিন বিজ্ঞানী এরাটোস্থেনিস আলেকজান্দ্রিয়া থেকে সৌর অবস্থানের কোণটি মাপলেন। সেটা ছিল সাত ডিগ্রি। এরাটোস্থেনিস সাত ডিগ্রিকে পূর্ণবৃত্ত অর্থাৎ ৩৬০ ডিগ্রির পঞ্চাশ ভাগের একভাগের নিকটবর্তী ধরে নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে সাইন নগরীর দূরত্বকে  পঞ্চাশ দিয়ে গুণ করলেন। এভাবে তিনি পৃথিবীর পরিধি মেপে ফেললেন। এরাটোস্থেনিসের গণনা আজকের দিনের সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক গণনার সাথে পুরোপুরি মিলে না গেলেও খুব একটা ভুল ছিল না। মাত্র পাঁচ শতাংশের হেরফের হয়েছিল।
সেই থেকে বহু বিজ্ঞানী আলো নিয়ে মহাজাগতিক হিসেব নিকেশে কৌতূহলী হয়ে পড়েন। নিকোলাস কোপার্নিকাস সৌরকেন্দ্রিক জগতের সন্ধান দিয়েছিলেন।
তাঁর বিখ্যাত ব‌ই ডি রিভলিউশনিবাস অরবিয়াম কোয়েলেসটিয়াম বেরিয়েছিল ১৫৪৩ সালে। কোপার্নিকাসের যুগে বিজ্ঞানীর হাতে টেলিস্কোপ ছিল না। চশমার কাচ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ১৬০৮ সালে  হান্স লিপারসে একটি চোঙের দুই প্রান্তে লেন্স লাগিয়ে দূরের জিনিসকে কাছে এনে দেখার সরঞ্জাম তৈরি করেন। এই বিষয়টি শুধুমাত্র কানে শুনে লেন্সের ফোকাস দূরত্ব হিসেব করে গাণিতিক সূত্র দিয়ে টেলিস্কোপ বানালেন গ‍্যালিলিও। সেই হল প্রথম বৈজ্ঞানিক টেলিস্কোপ। সেটা ১৬১০ সাল। এই টেলিস্কোপ বাগিয়েই গ‍্যালিলিও বৃহস্পতির চারিচন্দ্র ক‍্যালিস্টো, ইউরোপা আইও আর গ‍্যানিমিড দেখে ফেললেন। দেখলেন শনির বলয় আর পৃথিবীর চাঁদের এবড়ো খেবড়ো পৃষ্ঠতল।
১৬১১ সালে জার্মান জ‍্যোতির্বিজ্ঞানী জোহান্স কেপলার লেন্স এর বৈশিষ্ট্য লক্ষ করে ব‌ই লিখেছিলেন ডায়োপট্রিসে। ১৬২১ সালে ডাচ জ‍্যোতির্বিজ্ঞানী উইলব্ররড স্নেল দেখালেন, দুই ভিন্ন ধরণের মাধ‍্যমের মধ্য দিয়ে যাবার সময় আলো ভিন্ন ভিন্ন গতিবেগে চলে।
এদের গাণিতিক সম্পর্ক তিনি দেখালেন।
 ১৬৩৭ সালে ফরাসি গণিতজ্ঞ দার্শনিক রেনে দেকার্তে লা ডাই অপট্রিক নামে ব‌ই লিখলেন। ১৭৫৭ সালে বিজ্ঞানী পিয়ের দ‍্য ফার্মা বললেন, একটি বিন্দু থেকে আরেকটি বিন্দুতে যেতে আলো আলো সেই পথটিই বেছে নেয় যাতে সময় লাগবে সবচাইতে কম।
১৬৬৫ সালে ফ্রানসেসকো গ্রিমালডি আলোকের প্রতিসরণ সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরলেন। বললেন, বাধা পেরিয়ে যাবার সময় আলো কোনো বস্তুর ছায়া এলাকার মধ‍্যেও কিছুটা ঢুকে পড়ে। ১৬৭৬ সালে ডেনিশ জ‍্যোতির্বিজ্ঞানী ওলে খ্রীস্টেনসেন রোমার আলোর গতিবেগ নির্ণয় করলেন। এঁদের সকলের বহু আগে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি আলো নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা ভেবেছিলেন। তাঁর লাস্ট সাপার ছবিটি লক্ষ করলে বোঝা যায়, আলো সম্পর্কে তিনি কত গভীর ভাবে ভেবেছিলেন।
 আলো হাতছানি দিয়েছে পরবর্তী কালের মহাবিজ্ঞানীদের‌ও। বিদ‍্যুৎ এবং চৌম্বক ক্ষেত্র নিয়ে গবেষণা করতে করতে বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম‍্যাক্স‌ওয়েল দেখালেন, দৃশ‍্য আলো, অতিবেগুনি রশ্মি ও অবলোহিত রশ্মি, সবগুলিই আসলে বিভিন্ন কম্পাঙ্কের তড়িৎ চুম্বক তরঙ্গ মাত্র।। আলো নিয়ে ভাবতে গিয়ে ম‍্যাক্স প্ল‍্যাঙ্ক, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, লুই ভিক্টর ডি ব্রগলি, আর্থার কম্পটন, নিলস বোর প্রমুখ বিস্তর গবেষণা করে বললেন, সকল কণার‌ই একটা তরঙ্গধর্মিতা আছে। আবার, সব তরঙ্গের‌ই কিছু কিছু কণাধর্মিতা আছে। ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ এই প্রশ্নটিকে আরো বিকশিত করে কোয়ান্টাম ধারণাকে গড়ে তুললেন। ১৯০২ সালে বিজ্ঞানী ফিলিপ লেনার্ড দেখিয়েছিলেন, ধাতুর উপর আলো পড়লে তা থেকে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসে। এবং সেই বেরিয়ে আসা ইলেকট্রনের পরিমাণ আলোর তীব্রতা নয়, কম্পাঙ্কের উপর নির্ভর করে। ১৯০৫ সালে ফোটো ইলেকট্রিক এফেক্ট নিয়ে গবেষণা করে আইনস্টাইন দেখালেন, আলো থেকে শক্তি শোষণ করে পরমাণু থেকে ইলেকট্রন বিকীর্ণ হয়। ১৯২৪ সালে লুই ভিক্টর ডি ব্রগলি দাবি করলেন, সকল পদার্থের একটা তরঙ্গধর্মী আচরণ আছে। পরে জর্জ প‍্যাগেট টমসন এবং ক্লিন্টন জোসেফ ডেভিসসন ও লেস্টার হ‍্যালবার্ট জার্মার বিজ্ঞানী ডি ব্রগলির তত্ত্ব প্রমাণ করে দেখান। বিজ্ঞানী ব্রগলি তাঁর তত্ত্বের জন‍্য ১৯২৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আর তাঁর তত্ত্ব প্রায়োগিক পরীক্ষায় প্রতিষ্ঠা করে টমসন ও ডেভিসসন যৌথভাবে ১৯৩৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছিলেন। মহাকর্ষ নিয়ে ফিলজফিয়া ন‍্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম‍্যাথমেটিকা (১৬৮৭) এবং আলোকতত্ত্ব নিয়ে অপটিক্স (১৭০৪) , আইজ‍্যাক নিউটনের এই দুটি বিখ্যাত ব‌ইয়ে ধৃত ধারণাগুলি আত্মস্থ করে, বিকশিত করে, ও বিনির্মাণ করে পরবর্তীকালে পদার্থবিজ্ঞান অনেক দূর এগিয়েছে। পরবর্তীকালের সবসেরা বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন, তারার আলো যদি সূর্যের কাছ দিয়ে আসে, তাহলে সেই আলো সূর্যের মহাকর্ষের প্রভাবে কিছুটা বেঁকে যাবে। আইনস্টাইন আরো বলেছিলেন যে, তারার আলোর এই বক্রতা কেবল সূর্যগ্রহণের সময়েই লক্ষ করা যাবে, কেননা সাধারণ দিনে সূর্যালোকের তুলনায় দূরাগত নক্ষত্রের আলোকে নিতান্তই ম্লান দেখাবে। আইনস্টাইনের এই বক্তব্য ১৯১৯ সালের ২৯ মে তারিখে ঘটে যাওয়া একটি সূর্য গ্রহণে বিজ্ঞানী আর্থার স্ট‍্যানলি এডিংটন প্রমাণ করে দেখান। মহাকর্ষ ও আলো নিয়ে যে বিপুল গবেষণা নিউটন করেছিলেন, আইনস্টাইন যেন তাকে অন‍্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।