• Uncategorized
  • 0

T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় মৌসুমী চৌধুরী

অক্সিজেন

লাঞ্চের ঘন্টা বেজে গেছে অনেক আগেই। সেল-বোকারোর অক্সিজেন তৈরির প্ল্যান্টের এই ইউনিটের শ্রমিকরা এখনও খেতে বের হয় নি। ইউনিটে উঁকি দিয়ে সুদীপ দেখতে পায় সামনে টিফিনক্যারিয়ার -গুলো রাখা। মাস্কপরা মুখগুলো মাথা নিচু করে দক্ষ হতে একমনে কাজ করে চলেছে। সুদীপকে দেখতে পেয়ে তাদের লিডার বুধুয়া বলে,
— ” আরও পঞ্চাশ টন অক্সিজেন তৈরি করবার পর আমরা খাবার খাব, স্যার।”
— ” না না খাবারটা টাইম মতো খেয়ে নাও। কাজের সাথে শরীরটাকেও তো রক্ষা করতে হবে। তোমাদের তৈরি অক্সিজেনের দিকে কত লোক তাকিয়ে বসে আছে।” চিন্তিত গলায় সুদীপ বলে।
— ” না না স্যার, বেশি দেরী হবে না। চিন্তা করবেনা। আপনি খেয়ে নিন।” উত্তরে বেশ দৃঢতার সঙ্গে বলে লোকেশ।
প্রোডাকশান রুম থেকে থেকে বেরিয়েই সুদীপ একবার তার ইমিডিয়েট বস মিঃ সুশান্ত পট্টনায়ে- কের চেম্বারে ঢোকে। আর মাত্র এক বছর চাকরি আছে ভদ্রলোকের। সুদীপকে ভীষন স্নেহ করেন। কেন যে বাঙালি বলে এবং টেগোরের গাঁয়ের লোক বলে সুদীপকে একটু যেন বেশিই সমাদর করেন তিনি। সুদীপ দেখে মাথাজোড়া টাকটা ঘরের এল.ই.ডি আলোয় চকচক করছে। ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে আতঙ্কিত গলায় তিনি বলেন ,
— ” ওহ্! ওয়েস্ট বেঙ্গলে কোভিড-১৯ সংক্রমণ তো একেবারে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, সুদীপ! তোমার বাবা-মা, বাড়ির পরিজনেরা ভালো আছেন তো?”
— ” হ্যাঁ স্যার। সবাই সুস্থ আছেন এখনও। জানিনা, ভবিষ্যতে কি হবে! পাড়া-পড়শীরা অনেকেই অসুস্থ, কেউ কেউ মারাও গেছেন। ”
বিমর্ষ গলায় মিঃ পট্টনায়েক বলেন,
— ” সবচেয়ে দুশ্চিন্তার ব্যাপার হল অক্সিজে- নের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অক্সিজেন তৈরির বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরাও করোনাভাই- রাসে সংক্রমিত হচ্ছে বলে চাহিদানুসারে অক্সিজেনের জোগানে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।”
—” ওখানকার নির্বাচনী মিছিল-মিটিংয়ের জন্য সংক্রমণের হার আরও বেড়ে গেছে। কি যে হবে!” অসহায় গলায় বলে সুদীপ।
— ” তা তোমার ইউনিটের প্রোডাকশান কেমন? জানতে চান মিঃ পট্টনায়েক।
— ” বেশ ভালো, স্যার। ওরা তো না খেয়ে, না
থেমে প্রোডাকশান বাড়াতে চেষ্টা করছে।”
— ” যাও যাও লাঞ্চ সেরে নাও। বিকেল চারটার পর এম.ডির সঙ্গে একটা মিটিং আছে। তখন দেখা হবে।” আবার ল্যাপটপে মন দিলেন মিঃ পট্টনায়েক।
মিঃ পট্টনায়েকের চেম্বার থেকে বেরিয়ে নিজের চেম্বারে এসে ঢোকে সুদীপ। টেবিলের ওপরে রাখা ট্যাপারওয়্যারের লাঞ্চ -বক্সটার দিকে চোখ পড়ে। এই করোনাকালে প্রমিতা বেশ গুছিয়ে লাঞ্চ দেয়। ঠিক মতো না খেলে রাগ করে খুব। এখন তার ডায়েটের ওপর প্রমিতার কড়া নজর। শ্রমিকদের সার দেওয়া সস্তার স্টিলের, অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন- ক্যারিয়ারগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুদীপের। মনে মনে বলে,
— “নাহ্, এখন খাব না। আগে ওদের দিনের টার্গেটটা পূরণ হয়ে যাক। ওরা না খেলে আমি কি খেতে পারি?”
বৈশাখ শেষ হয়ে এসেছে। বেশ গরম পড়েছে। ফ্যান আর এয়ারকুলার দুটোই চালিয়ে দেয় সুদীপ। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে জানালার ধারে দাঁড়ায়। আজ এক বছরের ওপর হল এই ইউনিটের আধিকারিক হিসেবে কাজ করছে সে। এই করোনাকালে তার ইউনিটে ১২২ জন শ্রমিক আর ২০ জন আধি কারিক ৩-৩ সিফ্টে অক্লান্ত পরিশ্রম করে কাজ করে চলেছেন যাতে প্রতিদিন ১৫০ টন অক্সিজেনের জোগান দেওয়া যায় দেশকে।
সুদীপ দেখল জানালার বাইরে ক্যান্টিন চত্বরটা একেবারে খাঁ খাঁ করছে। গুটি কয়েক স্টাফ বসে খাচ্ছে। অন্যসময় হলে একে একে বেরিয়ে আসত শ্রমিকরা। বুধুয়া, লোকেশ, সেলিম, মজনু, প্রমোদ, লক্ষ্মণ, আনোয়ারদের লাঞ্চ খাওয়া এবং হাসি-গল্পে সরগরম হয়ে উঠত চারপাশ। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ভরে উঠত ক্যান্টিন চত্বর। আজ ওরা কেউ নেই। ওদের কাজ চলছে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। চারদিকে তো হাহাকার চলছে, জীবনদায়ী অক্সিজেন আরও আরও আরও চাই…
ক্যান্টিনের পাশে বিরাট কৃষ্ণচূড়া গাছটা
যেন লাল চেলিতে নিজেকে মুড়ে দাঁড়িয়ে আছে নববধুর মতো। আর লাল কার্পেটে মুড়ে আছে গাছের তলাটা। বৈশাখের এমন মন- কেমনিয়া কৃষ্ণচূড়া দিনে সুদীপের মন ছুটে যায় পিছনের দিকে। খুব মনেপড়ে তাঁর কথা। যাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে পাড়ার রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সাদা খোলের লালপেড়ে শাড়িতে রমা কাকীমা গাইতেন,
—”ওই মহামানব আসে /দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/ মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে ।।”…দরাজ গলায় সুদীপ আবৃত্তি করত,
— ” ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে…”
গত সপ্তাহে মায়ের ফোনে সুদীপ জানতে পেরেছে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বীরভূমে তাদের সেই মফস্বল শহরে অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু হয়েছে রমাকাকীমার।
—” আসতে পারি, স্যার? ”
চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায় সুদীপের। দেখে দরজায় মুখ বাড়িয়েছে আনোয়ার।
— ” এসো, এসো, আনোয়ার। কিছু বলবে?”
—” হ্যাঁ স্যার। কিছু টাকার খুব দরকার ছিল। সপ্তাহ তিনেক আগে বিবি শ্বশুরঘরে গিয়েছিল। জ্বর, শ্বাসকষ্ট নিয়ে সেখানেই হসপিটালে ভর্তি হয়েছে। জানি না বাঁচবে কিনা।”
চমকে ওঠে সুদীপ,
—” তোমার বিবি অসুস্থ? তবুও তুমি কাজে আসছ, আনোয়ার?”
— ” কি করব স্যার? দেশে অক্সিজেনের ঘাটতি। ইউনিটের অনেক শ্রমিকও তো কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে হসপিটালে ভর্তি আছে। তারা কাজে আসতে পারছে না। ইউনিটে শ্রমিক অনেক কম আছে স্যার।”
চোখটা ঝাপসা হয়ে যায় সুদীপের। মনটা দ্রব হয়ে আসে। এমন মানবিকতা আর জাতীয়তাবোধের রোমাঞ্চ ছড়িয়ে এরাই তো প্রকৃত মহামানব! এদের জন্যই তিনি লিখেছিলেন,
— ” ওরা চিরকাল/ টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল,/ ওরা মাঠে মাঠে /বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে।/ ওরা কাজ করে /নগরে প্রান্তরে।/ রাজছত্র ভেঙে পড়ে, রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে,/ জয়স্তম্ভ মূঢ়সম অর্থ তার ভোলে,/ রক্তমাখা অস্ত্র হাতে যত রক্ত-আঁখি/ শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি।/ওরা কাজ করে দেশে দেশান্তরে…”
চোখের সামনে সুদীপ যেন দেখতে পায় আনোয়ারের তৈরি অক্সিজেনে মৃত্যুকে তুড়ি মেরে জীবনে ফিরে আসছে কত শত রমা কাকীমারা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।