|| মানচিত্র আর কাঁটাতার, হৃদয় মাঝে একাকার || বিশেষ সংখ্যায় নবনীতা চট্টোপাধ্যায়

আমরা এখনো

ছয় বছরের সমীর মাঠে খেলছিল| তার বাল্যবন্ধু রহিম ছুটতে ছুটতে এসে বলল “সমু বাড়ি যা| খানসেনা আইসে তোগো ঘরে| ” রহিমের সাথে ছুটতে ছুটতে বাড়ীর সামনে এসে যা দেখল সমীরের শিশুমন আমৃত্যু তাকে বহন করে যেতে হবে সেই স্মৃতি| টিনের চালার মাটির দেওয়ালের তাদের বাড়ীর উঠানে খানসেনার ভিড়| তার পরমপ্রিয় জেঠু কি বোঝাচ্ছেন খানসেনাদের| কিন্তু পলকের মধ্যে হাঁসুলির কোপে আলাদা হলো জেঠুর ধড় ও মুন্ডু| রক্ত۔ ۔۔রক্ত۔ ۔۔আর রক্ত| সেই মূহুর্তে পিছন থেকে একটা হাত তাকে কোলে নিয়ে ছুট লাগলো| তার বাবার হাত| তারপর অনেক পথ হেঁটে লুকিয়ে রাতের অন্ধকারে প্রাণভয়ে বনগাঁ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকলো তারা| সময়টা সত্তর দশকের| বনগাঁতে প্রথমে রিফিউজি ক্যাম্পে তারপর দূরসম্পর্কের মাসীর বাড়িতে প্রায় ভৃত্যবৃত্তি করে পরিবারটি প্রাণ বাঁচালো| আজ সমীর এখানকার রাস্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মচারী| এখানে তার নিজস্ব বাড়ি, ছেলেমেয়েরা সুপ্রতিষ্ঠিত| তবুও অন্ধকারে চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে এক রক্তাক্ত অস্ত্র আর এক নিরপরাধ প্রৌঢের জবাই| তারা পাকিস্তানে থাকত| তখনো বাংলাদেশের জন্ম হয়নি| ১৪ই অগাস্ট ইস্কুলে সে পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত গেয়ে বাহবা কুড়িয়েছিল| এখন এসব ভাবলেই তার গায়ে কাঁটা দেয়| ভূখন্ডের অন্য মানচিত্রে সে এখন বাস করে| পূর্বপাকিস্তানের নদীর ধারে তার সেই ছেলেবেলার গ্রাম ও এখন স্বাধীন বাঙলাদেশের অন্তর্গত| চারপাশে বসে গেছে কাঁটাতার| মনে পড়ে রহিম,আসিফ,ভোলা,বাচ্চুকে| ওরা এখন কোন মানচিত্রে বাস করে?
ছেলেবেলার এক্কাদোক্কার ঘরের মত মানুষ ভাগ করে নিয়েছে সারা পৃথিবী| এটা আমার…ওটা তোমার…| রৌদ্রতপ্ত দুপুরে অস্ত্ররা উষ্ণতা পায়,সন্ধ্যার অন্ধকারে ঝনঝন করে ওঠে| গোলাগুলিতে নিহত সেনাদের পরিবার জানে এই ঝনঝনানির বাস্তব মূল্য| রাজনীতিকরা জানেন এই ঝনঝনানি যতদিন থাকবে ততদিন বেঁচে থাকবে সীমান্তসমস্যা| আর এই সমস্যার কাছে চাপা পড়ে যাবে দেশের অনান্য সমস্যা ও উন্নতি| হাজার কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হবে প্রতিরক্ষা খাতে| সাধারণ মানুষ তাজ্জব বনে যাবে|
সীমান্তের এপারেও সাধারণ মানুষের বাস সীমান্তের ওপারেও| সুখে দু:খে,চিন্তা ভাবনায়,সরলতা জটিলতায় উদ্বেল হন প্রত্যেকেই| অথচ নির্মম এক কাঁটাতার,নো ম্যানস ল্যান্ড আসল সত্যকে কবরে ঢুকিয়ে আপাত শান্তির পরিবেশ রক্ষা করে| প্রতিটা সীমান্তের মধ্যে তাই গল্পেরা মুখিয়ে থাকে উচ্চারিত হবার জন্য|
আমরা মানুষেরা যখন সীমান্ত সমস্যায় জেরবার হই তখন কত সহজে সুদূর অস্ট্রেলিয়া,সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসে পরিযায়ী পাখির দল ভারতের অখ্যাত গ্রাম বা শহরের ঝিলে| শীত কাটিয়ে আবার নিশ্চিন্তে ফিরে যায় সেখানে| আমরা যখন প্রতিরক্ষা দপ্তরের ভাষণ,সেনাদের কুচকাওয়াজে মগ্ন ,তখন এইসব দৃশ্যের বাইরে কখন নীরবে কলমির ডগা থেকে পাখা তুলে নীরবে উড়ে যায় বকবালিকার দল|
আমরা এখনো পাখিদের বুঝতে শিখিনি|
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।