• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে পাপিয়া ভট্টাচার্য (পর্ব – ৫)

আলোধুলোর দিন

আমাদের বাড়িতে রাজনীতির পরিবেশ ছিল পুরো মাত্রায়।বাবা সক্রিয় রাজনীতি করত , কট্টর কংগ্রেসী।পার্টির সেক্রেটারি ছিল ,প্রায়ই এ সম্মেলন ও সম্মেলনে যেত রাজ্যের বাইরেও । পার্টির ছেলেরা দিনরাত বাড়িতে আসত ,প্রায়ই মিটিং বসত চাতালে । মা কেটলির পর কেটলি চা করে যেত ।কিন্তু নিজে কোনো পার্টির সমর্থক ছিল কিনা জানতাম না ,আজও জানি না। মায়ের নিজস্ব মতামত বরাবরই কম ,যে পাত্রে ঢালা হয় সে পাত্রেরই আকারে থাকে। মনে হয় খুব ছোটতে মাতৃহীন হলে আত্মবিশ্বাস এরকম নড়বড়ে হয় ।তবে তাই বা কেন !আমার অন্য মাসিদের সবারই যথেষ্ট নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ও মতামত ছিল।সম্ভবত মেনে নেওয়া ব্যাপারটা ছিল মায়ের স্বভাবের মধ্যেই ।জীবনে পুকুরে স্নান করেনি ,কিন্ত বছরের বিশেষ বিশেষ কোনো পুজো টুজোর দিনে যখন ঠাকুমা বলত ডুব দিয়ে অবগাহন স্নান করলে শরীর শুদ্ধ হয় , পুকুরের ব্যাপারে ভয় থাকলেও সমস্তরকম সংস্কারে বিশ্বাসী মা একটা মগ নিয়ে আমাদের খিড়কি লাগোয়া ষষ্ঠী পুকুরে যেত। তারপর খুব ভয়ে ভয়ে হাঁটু অবধি নেমে মগ ডুবিয়ে মাথায় জল ঢালত।ঘাটের সিঁড়ির ধাপে দুজন সঙ্গীর একজন ঠাকুমা বলত , ‘আর এক মগ ঢালো বউমা। আহা ,মাথা শুকনো রইল যে!’
অন্য আর একজন , আমাদের গৃহসহায়িকা পিসি ব্যস্ত হত ,’হয়েছে হয়েছে গো বউদিদি , উঠে এসো দিনি ।ওই তো সব চুল ভিজেছে ।’
এই ছিল মায়ের অবগাহন স্নান ।তেরো বছরের শহর জীবন থেকে ছিটকে বরাবর গ্রামে থেকেও পুকুর ভীতি কাটেনি মায়ের।এমনকি আমরা সাঁতার শিখছি,তাতেও ভয় পেত।
তো এই মানুষের রাজনীতি নিয়ে মাথা ব্যথা থাকার কথা নয় , থাকেও নি। কিন্তু বাবা বামফ্রন্ট আমলের চরম সময়েও ,যখন লাল ছাড়া কোথাও আসন নেই ,তখনও বাড়ির সবার অমতে ভোটে দাঁড়িয়ে শুধু একা জিতেছে দেখেছি।
রাজনীতি নিয়ে উত্তেজনা ঝগড়া চরমে উঠত বড়মামা এলে । আজীবন মার্কসবাদে বিশ্বাসী বড়মামা রাত্রে বাবার সঙ্গে পার্টি নিয়ে ঝগড়া করে ভোরে বেরিয়ে যাচ্ছে বাড়ি থেকে, মা হাত ধরে টানাটানি করলেও ‘ আর জন্মেও আসব না তোদের বাড়ি ‘ বলে ,এ ঘটনা বহুবার ঘটতে দেখতাম। আমার অতি মাটির মানুষ বড়মামাকে তার এই পার্টির ব্যাপার ছাড়া অন্য কিছুতেই কক্ষনো রাগতে দেখিনি।
এর মধ্যে আবার মেজদাদু এসে পড়লে রণক্ষেত্র বাঁধত । সিপিএম আর কংগ্রেস মিলে গঠিত পঞ্চায়েতের প্রধান আর অধ্যক্ষ ছিল বাবা আর মেজদাদু। বাবা কংগ্রেস আর মেজোদাদু সিপিএম , পুরোনো জমিদারবাড়ির অন্ধকার অন্ধকার শেষ মহলটি ছিল ওই দাদুর।ওই বাড়িটার চিলেকোঠা আর ছাদ ছিল আমাদের কার্বাইডে পেকে ওঠার জায়গা ।
ওদের ঝগড়া ভারি মজার ছিল।মেজদাদূ বিকেলে আড্ডা দিতে এলো ,মা চা করছে ,হঠাৎ চেঁচামেচি শুরু হল।এক পর্বে গিয়ে মেজদাদু ‘ ধুর বাবু , মার্কসবাদের তোরা কী বুঝিস ,শুধু আনাড়ি তর্ক ‘ বলে উঠে চলে যেত। মা চা এনে দেখত এই কান্ড । মেজদাদুর ভক্ত ছিল খুব ,বলত ‘এই তো দিব্যি গল্প করছিলে ,এর মধ্যে এমন ঝগড়া করলে যে কাকাবাবু চা না খেয়ে চলে গেলেন !’
বাবা তখন’ হ্যাঁ আমিই তো সব বলি, তোমার মেজকাকাবাবু তো কিছুই বলে না ‘ বলত ,আবার ডাকতেও যেত।কিংবা পরদিন মেজদাদু নিজেই নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে বসত।হাসিমুখে বলত,’চা করো কৃষ্ণা ।’
তো তখন ছিল এরকম। আমাদের ঘাটাল মহকুমার বিধানসভা লোকসভার সিট বহুবছর ধরে বামফ্রন্টের বাঁধা ছিল। পরপর একটানা জিতে আসা সিপি এমের এম এল এ নন্দরানি ডাল মাঝে মাঝেই আসতেন কাজে। সিপিএম নেতা নেত্রী কংগ্রেস নেতা মিলে তুমুল হাসি তর্ক চা সবই হত আমাদের চাতালে বসে।
একবার ,তখন বেশ ছোট আমরা ,প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় , সংগে সুশীল ধাড়া ( দুজনেই আমাদের মেদিনীপুরের ,দুজনেই স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন ,ওঁদের নিতান্ত সাধারণ জীবন যাপনের গল্প শুনতে শুনতে বড় হওয়া আমাদের )। আর ছিলেন ফুলরেনু গুহ ,আরো কে কে সব নেতা মনে নেই, পার্টির মিটিংয়ে এসে আমাদের বাড়ি এলেন।খাবার ব্যবস্থা হয়েছিল আমাদের বাড়িতে । ফুলরেনু গুহ তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পরে জেনেছিলাম, পুলিশ ছিল বাড়ির বাইরে।আমার শুধু এইটুকু মনে আছে যে ফুলরেনু গুহ বাইরের ঘর থেকে ভেতরে এসে বাথরুমের খোঁজ করছিলেন। মা অতিথি আপ্যায়নে ওদিকে ব্যস্ত, কাঠের উনুনে আমাদের হরিপিসি লুচি ভাজছিল। উনি আমার নাম জিজ্ঞেস করে কদমছাঁট চুল আর আট হাতি কালো পেড়ে ধুতির ছোট্টখাট্টো পিসিকে দুহাত জড়ো করে বলেছিলেন ,’নমস্কার দিদি, ভালো আছেন তো ?’
পিসি তো লজ্জায় জড়োসড়ো।সবাই চলে যাবার পর এই নমস্কার দিদি নিয়ে খুব হাসি ঠাট্টা চলত। বাবা রসিক ছিল খুব। বলত , হরিদিকে রাগিও না কেউ ,ও কী যে সে লোক !খোদ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাড়ি এসে নমস্কার করে কুশল জেনে যায় ইত্যাদি ।
সাম্প্রতিক কালে পঞ্চায়েতের এই পুকুর চুরির সময় আমার বাবা দাদুদের কথা মনে পড়ে খুব।
বরাবরই বন্যা প্রধান অঞ্চল আমাদের।বিদেশ থেকে সাহায্য আসত প্রচুর।গায়ে ইউ এস এ লেখা বিশাল বড় বড় গুঁড়ো দুধের প্যাকেট ,কম্বলের বস্তা দেখেছি যেগুলো আমাদের বাড়িতে থাকত ।আর আসত চাল ,গম , মাইলো।পঞ্চায়েতের অফিস তখন এরকম বিশাল আকারের থাকেনি । ছোট জায়গায় কুলোত না ,নিরাপদও ছিল না। তো সেইসব গুঁড়ো দুধ রোজ সকালে বিরাট বিরাট গামলায় গুলে বিলি করা হত গর্ভবতী মা আর তাদের সন্তানদের।কাজটা করতেন অনেক দুর দুর নৈহাটী বারাসত থেকে চাকরি করতে আসা নারী কল্যাণ সমিতির মেয়েরা, তাঁরা থাকতেন বাগানের পুরোনো ঘর ভাড়া নিয়ে। মা তখন এই জোনের নারী কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারি। কাজ ছিল না কিছুই ,মাঝে মাঝে শাড়ি কম্বল বিতরণের সময় বিডিওর জিপে করে যেতে হতো অন্য গ্রামে। কিছু কাপড় মায়ের হাত দিয়ে দেওয়া হত। নারী কল্যাণ সমিতির মেয়েরা যে কোনো প্রয়োজনে আমাদের বাড়িতে আসতেন।ভালমন্দ খাবার হলেই ডাকা হত ওঁদের।আহা,বাড়ি ছেড়ে সব কত দুরে পড়ে থাকা ! উমাপিসি শিপ্রপিসি ইলাপিদি এইসব বলতাম তাদের।
বাবার কড়া নির্দেশ ছিল সকালে দুধ বের করতে এলে একদম মাপের বাইরে যেন এক ফোঁটা দুধ না নষ্ট হয়। লাল চা খাওয়ায় দিন ছিল না তখন ,চা করতে করতেই কড়ার সব দুধটুকু চলে যেত মায়ের।একবার মা বলে ফেলেছিল,’তোমার লোকজনের জন্যেই তো এতবার চা হয়। ওখান থেকে এক কৌটো দুধ দিলে সেই দুধে চা হত আর বাড়ির দুধটা থাকত।’ সেই নিয়ে বাবার কী চিৎকার !
‘কী বললে ?সাহায্যের জন্যে পাঠানো গরিবের জিনিস আমি চুরি করব ? ছি ছি ! এক আধদিন দুধ কম পড়লে ছেলে মেয়েরা মরে যাবে না ।খবরদার এখানে হাত দেবে না কেউ।’
ওই ঘরের চাবিটি শুধু সকালে খুলে দিত দুধ বিলির সময়। তবে মিথ্যে বলব না ,বাবার সততা বোঝার বয়স তখন নয় বলে ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ ছিল না আমার।
আহা,কী অপূর্ব যে স্বাদ ছিল সেই বিদেশি দুধের! একটু খেতে দিত না ,এত নিষ্ঠুর বাবাও হয় , এরকমই ভাবতাম। আর বাবা বেরিয়ে গেলেই শিপ্রাপিসিদের কাছে গিয়ে চুপ করে দাঁড়াতাম।ওঁরাও এদিক ওদিক দেখে তাড়াতাড়ি দু চার চামচ হাতে ঢেলে বলতেন ,’পালা এক্ষুনি ।একবার যদি সুনীল দা দেখে ফেলেন…!’
চেটে চেটে আঙুল গুলো অবধি খেয়ে ফেলতে ফেলতে দেখতাম ঠান্ডাবালা দাসী ,গুনমনি রুইদাসদের কত ভাগ্য! ছেলে কোলে ঘটি ভরে কতখানি করে দুধ নিয়ে যাচ্ছে ।
এই নামগুলো মনে আছে ,কারণ প্রায়ই বাবার অনুপস্থিতিতে এরা কেউ এসে বলত , ‘বাবুকে একটু বলো দিনি মা আমার ডাইডোলের জন্যি। আমার নাম ঠান্ডা বালা দাসী।’
বাবার অর্ডার ছিল তার অনুপস্থিতিতে কেউ এলে কী দরকার জেনে যেন নাম লিখে রাখা হয়। কে কোন দল এসবের ব্যাপারই ছিল না । যুক্তাক্ষর ভালো করে লিখতে শেখার আগেই আমি বানান করে করে ঠান ডা বালা দাসি এইভাবে লিখেছিলাম বলে বাবা ফিরে এসে হো হো করে হেসেছিল খুব । এই নামটা বিশেষ করে মনে আছে তাই ।
তবে ডাইডোলটা কী জিনিস ,খায় না মাথায় দেয় জানতাম না ।
বাড়িতে এত দুধের প্যাকেট ,তবু ছেলেমেয়ের ভাগের দুধ দিয়ে চা করতে হয় ,একটু দুধ চেয়ে অপমানিতও হতে হয়েছে মাকে। আমাদের কাজের সাহায্যকারী ছেলেটির একটি কম্বল দরকার। নরম কম্বলগুলি বিলির সময় মা বলল, ওর জন্যেও তো চাই একটা । ওও তো গরিবের ছেলে।
বাবা বলল,’ ও আমাদের কাছে থাকে ,ওর দরকারে আমিই কিনে দেব।এর থেকে কখনই নয়। ‘
এসব দিন আমার চোখের সামনে ছিল।কী সব যে বোকা বোকা কিছু লোকজন দেশ দেশ করে মরত তখন ! মানে হয় কোনো!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।